রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। রাশিয়া গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত পশ্চিমা মিডিয়া রুশ প্রেসিডেন্ট ভ­াদিমির পুতিনের সম্ভাব্য পরিকল্পনা সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছে, তার প্রায় কোনোটিই সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়নি।

অপরদিকে এখন পর্যন্ত পুতিন যেসব লক্ষ্য হাসিলের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন, তার প্রায় সবকটিই অর্জন করেছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিশ্ব পুতিনকে পাঠ করতে অক্ষম। সেপ্টেম্বরে পুতিন ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল রুশ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার পর আক্রমণের ধার কমিয়ে দেন।

এ সুযোগে পাশ্চাত্যের অস্ত্র সহায়তা পেয়ে ইউক্রেন তার হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধারে মরিয়া হয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে। গত ২ অক্টোবর ইউক্রেন উত্তরাঞ্চলের দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের সীমান্তসংলগ্ন গুরুত্বপূর্ণ লাইমান শহর দখল করে নিলে রুশ বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়।

ইউক্রেন বাহিনী শহরটিকে ঘিরে ফেললে আত্মরক্ষার জন্য রুশ বাহিনী শহরটি ছেড়ে দিয়ে পশ্চাৎপসারণ করে। অতঃপর ৮ অক্টোবর রুশ অধিকৃত ক্রিমিয়ার কার্চ ব্রিজে ঘটে ভয়ংকর ট্রাকবোমা হামলা, যে হামলায় এ ব্রিজের সড়ক ও রেলপথের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ ব্রিজটি রাশিয়া থেকে ক্রিমিয়ায় রুশ সৈন্যদের অস্ত্র ও রসদ সরবরাহের একমাত্র পথ। এটি ছিল পুতিনের সক্ষমতার প্রতীক।

এটি অক্রান্ত ও বিধ্বস্ত হওয়ায় রাশিয়ার মর্যাদা ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছিল। এমনকি এ ঘটনার পর পশ্চিমারা বলতে থাকে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার জয়লাভের সম্ভাবনা তিরোহিত হয়ে গেছে এবং রুশ বাহিনী লজ্জাজনক পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে। এরপরই পুতিন ইউক্রেনে তার সেনা কমান্ডার পরিবর্তন করেন এবং সের্গেই সুরুভিকিনকে নতুন কমান্ডার নিয়োগ করেন।

নিযুক্ত হয়েই সুরুভিকিন যুদ্ধকৌশল পরিবর্তন করেন এবং ইউক্রেনের ওপর ত্রিমাত্রিক মিসাইল আক্রমণ পরিচালনা করেন। মাত্র দুদিনেই রাশিয়া জল, স্থল ও আকাশপথে ইউক্রেনে এত ব্যাপক মিসাইল আক্রমণ করে যে, তাতে ইউক্রেনের প্রায় প্রতিটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বিধ্বস্ত হয়ে যায়। শহরগুলো বর্তমানে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

এ ভয়ংকর মিসাইল আক্রমণে মুহূর্তেই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং প্রমাণ হয়ে যায়, রাশিয়া ও পুতিন সম্পর্কে পশ্চিমাদের ধারণা একবারেই সঠিক নয় এবং রাশিয়াকে পর্যুদস্ত করা সম্ভব নয়। এদিকে শীত সমাগত হওয়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ পুনরুদ্ধার করতে না পারলে ইউক্রেনের মানুষ মারাত্মক সংকটে পড়বে।

ইতোমধ্যে রাশিয়ার পারমাণবিক ওয়ারহেডবাহী পসেইডন স্ট্যাটাস-৬ সাবমেরিনের স্থান পরিবর্তনে পুরো পশ্চিমা বিশ্ব আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। রাশিয়া এ সাবমেরিনটির কার্যক্রম পরীক্ষা করার ঘোষণা দিয়েছে। এটি যদি আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে কাছাকাছি দূরত্বে পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়, তাহলে সমুদ্রাভ্যন্তরে এমন সুনামির সৃষ্টি হতে পারে, যার ফলে সমুদ্রতীরবর্তী নিউইয়র্ক শহর পানিতে তলিয়ে যেতে পারে অনায়াসেই।

এদিকে নর্ডস্ট্রিম-২ নাশকতার কারণে রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি বন্ধ থাকায় এবং রাশিয়ার নেতৃত্বে ওপেক দেশগুলো তেল উৎপাদন সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আসন্ন শীতে ইউরোপ ভয়ংকর জ্বালানি সংকটে পড়তে যাচ্ছে। ন্যাটো জোটে ভাঙন ধরানোর জন্য রাশিয়া নর্ডস্ট্রিম ২-এর বিকল্প হিসাবে তুরস্কে গ্যাসের মজুত গড়ে তোলার বিকল্প জ্বালানি রুটের প্রস্তাব দেওয়ায় তুরস্ক তা লুফে নিয়েছে।

একদিকে জ্বালানি কূটনীতি, অপরদিকে পারমাণবিক হুমকির মাধ্যমে রাশিয়া পশ্চিমা জোটকে ইতোমধ্যেই বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। ফলে ন্যাটো কাজ করতে পারছে বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় রাশিয়ার রিজার্ভ ফোর্স প্রস্তুত হয়ে গেলে ইউক্রেনের আর বাঁচার কোনো পথ খোলা থাকবে না বলেই মনে হচ্ছে। এরূপ সম্ভাব্য পরিণতির কথাই যুদ্ধের শুরুতে হেনরি কিসিঞ্জার উল্লেখ করেছিলেন।

ফ্রান্স ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, রাশিয়া যদি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে তাহলে তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেবে না, কারণ তারা নিজ দেশের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করবে। জার্মানিও জ্বালানি প্রশ্নে পুতিনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে যাওয়ার পথ খুঁজছে বলে মনে হচ্ছে।

তবে সামরিক জোট হিসাবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো রাশিয়ার বিরুদ্ধে সমর প্রস্তুতি অব্যাহত রেখেছে। রাশিয়ার হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও ন্যাটোভুক্ত বেশিরভাগ রাষ্ট্র পারমাণবিক মহড়া পরিচালনার সিদ্ধান্তেও অটল রয়েছে। এক্ষেত্রে বরাবরের মতো ইঙ্গ-মার্কিন আঁতাত অক্ষুণ্ন রয়েছে। এ আঁতাত ন্যাটোকে কার্যকর ও ঐক্যবদ্ধ রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে জাতিসংঘে মিসাইল হামলা ও ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল দখল করে নেওয়ায় রাশিয়ার বিপক্ষে নিন্দা প্রস্তাব আনা হয়েছে। বাংলাদেশ এ প্রস্তাবে রাশিয়ার বিপক্ষে ভোট দিয়েছে, যা কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি করেছে। হঠাৎ বাংলাদেশের কেন এ অবস্থান, যেখানে ভারত ও চীন নিরপেক্ষতা বজায় রেখে ভোটদানে বিরত ছিল?

রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু হওয়ায় দেশটির বিপক্ষে ভোট দেওয়া বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ বৈকি। কারণ বন্ধু হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই আনপ্রেডিক্টেবল। তাছাড়া যেখানে চীন-ইরান-রাশিয়া জোট গঠনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে এবং রাশিয়া এশিয়াভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার দিকে আগ্রহী হয়ে উঠেছে, সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন বলয়ে অবস্থান নেওয়া যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ নয় কি? বাংলাদেশ কি নিরপেক্ষতা বজায় রেখে ভোটদানে বিরত থাকতে পারত না? তাহলে কেন বাংলাদেশ এ প্রকাশ্য অবস্থান নিল?

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র সচিব অবশ্য এর যথার্থ ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং এতে বাংলাদেশ-রাশিয়া চিরন্তন সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তাদের বক্তব্য হলো, বাংলাদেশের এ অবস্থান আসলে জাতিসংঘ সনদের প্রতি বাংলাদেশের দৃঢ় সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ, কারণ বাংলাদেশ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতায় বিশ্বাস করে। কূটনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান খুবই যৌক্তিক। তবে বাংলাদেশের এ অবস্থানের পেছনে অন্য কারণ থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়।

বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান যতটা না তার প্রথাগত কূটনীতির ধারবাহিকতা, তার চেয়েও বেশি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বাস্তবতা ও বৈশ্বিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বিচারে ভারসাম্যাবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা। অভ্যন্তরীণ নীতিনির্ধারণে সরকারকে বিএনপি জোটের হঠাৎ আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিতে হয়েছে বৈকি। আগামী বছরটি বাংলাদেশের জন্য নির্বাচনের বছর হওয়ায় সরকারের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

কারণ পররাষ্ট্রনীতি আসলে স্বরাষ্ট্রনীতিরই প্রলম্বিত রূপ, যা মূলত জাতীয় স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বর্তমান স্বার্থ কী? এ প্রশ্নের জবাবের মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক অবস্থানের ব্যাখ্যা। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লেনদেনগুলো পাশ্চাত্যের সঙ্গে যতটা সম্পর্কিত, রুশ নিয়ন্ত্রিত বলয়ের সঙ্গে ততটা নয়। এটি রাশিয়াও বোঝে।

সে জন্য রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি বরাবরই প্রান্তিক অবস্থানে। এ জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই পাশ্চাত্যের নীতি-কৌশল বিবেচনায় রেখে পলিসি নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কূটনীতি হলো ‘অর্থনৈতিক কূটনীতি’ এবং এ জন্যই পশ্চিমা বলয়ের সঙ্গে তিক্ততা কাম্য নয়। তাই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং সামগ্রিক বিষয়ে পশ্চিমা কূটনীতিকদের সাম্প্রতিক অকূটনৈতিকসুলভ তৎপরতা এবং এর পেছনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক দেশবিরোধী লবিস্ট গ্রুপের তৎপরতা বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে।

আমাদের যে ভৌগোলিক অবস্থান এবং রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা, তাতে নীতিগতভাবে বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া উচিত নয়; কারণ এতে রাষ্ট্রের নিজস্ব নিরাপত্তার বিষয়টি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ এখন একটি সাধারণ নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে অবস্থান করছে।

২০২৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরে দেশের সরকারবিরোধী শিবির ক্রমেই সক্রিয় হয়ে উঠছে। এ শিবিরের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর কূটনীতিকদের নানা ধরনের যোগাযোগ ঘটছে। এসব দেশের কূটনীতিকদের শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ ও বক্তব্যের মধ্যেই তাদের অভিপ্রায় প্রকাশ পেয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির সিংহভাগ এসব দেশের সঙ্গে যুক্ত। এরা সরকারবিরোধী জোটকে সমর্থন দেওয়া শুরু করলে সরকার বিপাকে পড়তে পারে। কারণ রাশিয়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করার কোনো ইঙ্গিত দেয়নি কখনো। দৃশ্যত সে সক্ষমতাও তার নেই। তাছাড়া রাশিয়ার বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে তারা তাদের বিপক্ষে আনিত নিন্দা প্রস্তাবে বাংলাদেশের সমর্থনদানকে খুব একটা গুরুত্ব দেবে বলে মনে হয় না।

কারণ এ মুহূর্তে তাদের দরকার বেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযোগ, যা বাংলাদেশ অব্যাহত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারাও চায় বর্তমান সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। কারণ এ সরকারের আমলেই রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুমাত্রিক রূপ নিয়েছে। সে জন্য তারাও বাংলাদেশের বাস্তবসম্মত অবস্থানের বিষয়টি বুঝতে সক্ষম। সুতরাং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অবস্থানটি সাময়িক এবং এ কারণে এটি বাংলাদেশ-রাশিয়া সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না বলেই মনে হয়।

ড. সৈয়দ আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী : সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY