বাধা পেরিয়ে খুলনায় জনস্রোত

সব বাধা উপেক্ষা করে শনিবার খুলনায় বিএনপির গণসমাবেশে জনতার ঢল নেমেছে। বাস, লঞ্চ বন্ধ থাকায় ট্রাক, পিকআপ, বালুবাহী ট্রলার ও ট্রেনে নেতাকর্মী সমর্থকরা খুলনায় পৌঁছান। অনেকে মাইলের পর মাইল হেঁটে সমাবেশে যোগ দেন। সকাল থেকেই খুলনার প্রবেশপথে ক্ষমতাসীনরা লাঠিসোঁটাসহ অবস্থান নেন। কিন্তু সংঘাতে না জড়িয়ে কৌশলে এসব বাধা পেরিয়ে সমাবেশ যোগ দেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।

এদিকে সমাবেশ ঘিরে টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে যাওয়া এবং আসার পথে কয়েকটি স্থানে নেতাকর্মীরা হামলার শিকার হন। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। দুপুরে দৌলতপুরে নতুন রাস্তায় আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর করে বিএনপি নেতাকর্মীরা। পরে বিকালে খালিশপুরের বৈকালীর মৌড়ে বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুর করে আগুন জ্বালিয়ে দেয় ক্ষমতাসীনরা। এ ছাড়া রেলস্টেশনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পালটাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে তিন নেতাকর্মী আহত হন।

গণসমাবেশে অংশ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, ন্যক্করজনক বাধা সত্ত্বেও নেতাকর্মীদের আটকাতে পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না। আমাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই। আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করা হবে। রাজপথেই হবে ফয়সালা। তাই সরকারকে বলছি, মানে মানে সরে যান।

এদিকে গণসমাবেশ কেন্দ্র করে দুদিন ছিল পরিবহণ ধর্মঘট। বন্ধ ছিল নৌযানও। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। হেঁটে কিংবা নসিমন-করিমনে করে তারা নির্দিষ্ট গন্তব্যে যান। বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার অভিযানের পাশাপাশি পথে পথে বসানো হয় তল্লাশি চৌকি। এমন প্রতিকূলতা পেরিয়েই গণসমাবেশে অংশ নেন নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। বাধা এড়াতে খুলনা বিভাগের ১০ জেলা থেকে অনেক নেতাকর্মী আগেভাগেই শহরে পৌঁছান। বাস ও লঞ্চ বন্ধ থাকলেও চালু ছিল রেল যোগাযোগ। যশোর, মাগুরা, মেহেরপুর, নড়াইল, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা জেলার নেতাকর্মীরা ট্রেনে করে খুলনা যান। এ ছাড়া ট্রলারে করেও আসেন অনেকে। নেতাকর্মীরা জানান, তাদের পুলিশের বাধার সম্মুখীনও হতে হয়েছে। তবে তারা কৌশল অবলম্বন করে খুলনা এসে পৌঁছেছেন। উঠেছেন নিকট-আত্মীয়দের বাড়িতে। এ ছাড়া স্থানীয় বিএনপি নেতারা দূর থেকে আসা নেতাকর্মীদের আবাসন ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

শুক্রবার বিকালে খুলনা শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ করে ছাত্রলীগ। শহরের বিভিন্ন মোড়ে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ক্ষমতাসীনরা মহড়া দেন। এ সময় পুরো শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে সন্ধ্যার পর তাদের আর রাস্তায় দেখা যায়নি। শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিএনপি নেতাকর্মীরা সন্ধ্যার পর খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে জড়ো হন। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি। মধ্য রাতে নেতাকর্মীরা ডাকবাংলো সোনালী ব্যাংক চত্বর মোড়ে সমাবেশ স্থলে অবস্থান নেন। রাতে শহরের রাজপথে দেখা গেছে অভিনব সব দৃশ্য। হাজার হাজার নেতাকর্মী নির্ঘুম রাত যাপন করেছেন রাজপথে। ছিল না কোনো বিছানা। অনেককে চিড়ামুড়ি খেতে দেখা গেছে। সকাল থেকেই নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে সমাবেশ স্থল আসতে শুরু করেন। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সমাবেশ স্থল ও আশপাশের এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। শহরজুড়ে মিছিল করে শোডাউন দেওয়া হয়। সারাদিন শহরের কোথাও ক্ষমতাসীনদের দেখা যায়নি। সমাবেশ ঘিরে শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোতায়েন করা হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। তাদের অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। তবে আগের কয়েক দিন বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে অসংখ্য নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে অভিযোগ বিএনপির।

এদিকে নেতাকর্মীরা আগে থেকেই অবস্থান করায় সমাবেশের সময়সূচি এগিয়ে আনা হয়। পূর্বনির্ধারিত সময়সূচিতে দুপুর ২টায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা দুই ঘণ্টা এগিয়ে আনা হয়। শনিবারও বিভিন্ন জেলা থেকে নেতাকর্মীরা খুলনা আসেন। তবে শহরের বিভিন্ন প্রবেশপথে ক্ষমতাসীনদের লাঠি, রড নিয়ে অবস্থান করতে দেখা যায়। তারা কোনো গাড়ি প্রবেশ করতে দেয়নি। অনেকে গাড়ি কোথাও রেখে রিকশা কিংবা হেঁটে শহরে প্রবেশ করেন।

খুলনা পাওয়ার হাউজ মোড়ে সমাবেশে আসা বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা হয়। ডুমুরিয়া উপজেলা থেকে আসা আবুল কালাম নামে ষাটোর্ধ্ব এক কর্মী যুগান্তরকে বলেন, সরকার সবকিছু বন্ধ করে দেয়। ডুমুরিয়া থেকে বালুবাহী ট্রলারে করে আমরা এসেছি।

সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, তারা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করছেন। কোথাও সহিংসতা করছেন না। বরং আওয়ামী লীগ সহিংসতা করছে। তারা সন্ত্রাসের দল, দেশকে নরকে পরিণত করেছে।

নেতাকর্মীদের আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আন্দোলন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সরকারকে হটাতে হলে একমাত্র বিকল্প আন্দোলন, আন্দোলন এবং আন্দোলন। এখনো সময় আছে নিরাপদে চলে যান। না হলে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো হবে।

বিভাগীয় শহরগুলোতে গণসমাবেশ কর্মসূচির অংশ হিসাবে শনিবার খুলনায় সমাবেশ করে বিএনপি। জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, দলীয় কর্মসূচিতে গুলি করে পাঁচ নেতাকর্মী হত্যার প্রতিবাদ, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ও খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ কয়েক দফা দাবিতে এ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করা হয়। খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এসএম শফিকুল আলম মনার সভাপতিত্বে এবং মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন ও জেলা সদস্য সচিব আমীর এজাজ খান সঞ্চালনা করেন। সমাবেশে আরও বক্তৃব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, নিতাই রায় চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, মশিউর রহমান, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, মেহেদী আহমেদ রুমি, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, শহীদুল ইসলাম বাবুল, কামরুজ্জামান রতন, অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, রকিবুল ইসলাম বকুল, ড. ওবায়দুল ইসলাম, জয়ন্ত কুমার কুন্ডু, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, কৃষিবিদ শামিমুর রহমান, কমলেন্দু দাস অপু, আমিরুল ইসলাম শিমুল, ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন, সাইফুল ইসাম ফিরোজ, সাদেক খান, এস এম জিলানী, অধ্যাপিকা নারগিস বেগম, ফজলুর রহমান খোকন, কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ প্রমুখ।

দুপুর পৌনে ২টায় সমাবেশের মঞ্চে আসেন প্রধান অতিথি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের চিহ্ন থাকবে না। নির্বাচনে তারা ১০ আসনও পাবে না। ২০১৪ সালে বিনাভোটের নির্বাচনে ক্ষমতায় গিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ২০১৮ সালে নিশি রাতে ভোট হয়ে গেছে। দুই নির্বাচনেই কেউ ভোট দিতে পারেনি। ২০২৩ সালে নির্বাচন আসছে। এবারও ক্ষমতাসীনরা একই কায়দায় নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার পাঁয়তারা করছে। এ জন্য নিজেদের মতো নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, নিজেদের ভালো দেখানের জন্য সব রকম কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে তারা। গাইবান্ধায় ভালো নির্বাচন করেছে। কিন্তু ডিসি এসপিরাই তাদের কথা শুনে না। তারা কী নির্বাচন করবে? তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না।

তিনি দাবি করেন, সমাবেশকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিনে ৫ শতাধিক নেতা-কর্মী গ্রেফতার, সহস াধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালিয়েছে।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন। অথচ সরকারই বলেছিল দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ ধরনের মিথ্যা প্রচার করে তারা জনগণের সঙ্গে প্রতারণার পর এখন দুর্ভিক্ষের কথা বলছে। ’৭৪ সালেও আওয়ামী লীগের আমলে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার বইতে লিখেছেন, আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা ও লুটপাটের কারণে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, সমাবেশ সফল করতে কোথায় সহযোগিতা করা হয়েছে? উলটো নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে, কুপিয়েছে।

নেতাকর্মীদের আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আন্দোলন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সরকারকে হটাতে হলে একমাত্র বিকল্প আন্দোলন, আন্দোলন এবং আন্দোলন।

মির্জা ফখরুল বলেন, এখন পদত্যাগ না করলে পালানোর পথ খুঁজে পাবে না সরকার। এখনো সময় আছেন নিরাপদে চলে যান। না হলে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো হবে।

সমাবেশের শেষ পর্যায়ে ক্ষমতায় গেলে কী করবেন তার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। মির্জা ফখরুল বলেন, তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে বিচার বিভাগীয় কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হবে। বিদ্যুতের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে কমিশন গঠন করা হবে।

বক্তব্য চলাকালে অসুস্থ বোধ করায় চেয়ারে বসে তা শেষ করেন মির্জা ফখরুল।

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, অবৈধ ভোট ডাকাত সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে র‌্যাব পুলিশ ব্যবহার করছে। এসব অনেক করেছেন। সব খেলা শেষ। চেয়ে দেখুন কয়েক দিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু তিনি একজন আন্ডার সেক্রেটারির দেখাও পাননি।

দেশের নানাবিধ সংকট তুলে ধরে তিনি বলেন, কিছুই যদি না পারেন তাহলে আপসে সরে দাঁড়ান। অন্যথায় রাজপথেই ফায়সালা হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও গণসমাবেশের প্রধান উপদেষ্টা গয়েশ্বর রায় বলেন, সরকার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চাইতেও জঘন্য। ?তাদের ক্ষমতা থেকে নামতে হবে। না নামলে জনগণ জানে কিভাবে তাদের নামাতে হয়।

খুলনার পুলিশ কমিশনারকে চারবার ফোন দিয়েও পাননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আপনাদেরও বিপদে পরতে হবে। কথা দিচ্ছি সে সময় আমি রেসপন্স করব।

গয়েশ্বর রায় বলেন, পুলিশ শেখ হাসিনার বাড়ির চাকর-বাকর নয়। কোনো অন্যায় আদেশ আপনারা মানবেন না।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, আমাদের সংগ্রাম শুরু হয়েছে। চূড়ান্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দুর্নীতিবাজ, ডাকাতদের হাত থেকে এ দেশকে মুক্ত করতে হবে।

তিনি বলেন, এই সরকার স্বাধীনতার কথা বলে অথচ তারা যুদ্ধের সময় পালিয়ে গিয়েছিল। আর অন্যদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন জিয়াউর রহমান।

সমাবেশ শেষে মাইকে নেতাকর্মীদের সতর্ক থেকে গন্তব্যে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। হামলা হতে পারে এমন বার্তাও দেওয়া হয়।

LEAVE A REPLY