অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন (১ হাজার কোটি) ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ পেয়েছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি। দুই বছরের করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় চাপে পড়া অর্থনীতিকে সামাল দিতে কম সুদের বিশাল অঙ্কের এই ঋণ বেশ অবদান রেখেছিল। কিন্তু বিদেশি ঋণে সেই জোয়ার আর নেই, এখন প্রতি মাসেই কমছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে মোট ১৩৪ কোটি ৯২ লাখ (১.৩৫ বিলিয়ন) ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ দশমিক ৩৮ শতাংশ কম। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের এই ৩ মাসে ১৯৩ কোটি ৮০ লাখ (১.৯৪ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ ছাড় করেছিল দাতারা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) মঙ্গলবার এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় বিদেশি ঋণপ্রবাহের উল্লম্ফন নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২২-২৩ অর্থবছর। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রায় ৪৯ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণসহায়তা এসেছিল, যা ছিল গত জুলাইয়ের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। কিন্তু দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসে হোঁচট খায়। ওই মাসে ৩৭ কোটি ৬৩ লাখ লাখ ডলারের ঋণ ছাড় করে দাতারা, যা ছিল আগের মাস জুলাইয়ের চেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ কম। তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে এসেছে ৪৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের চেয়ে অনেক কম বিদেশি ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈশ্বিক কারণে পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে। এই চাপ সামলাতে এই মুহূর্তে কম সুদের বেশি বেশি বিদেশি ঋণের খুব দরকার ছিল। কিন্তু উল্টো কমে গেছে। সরকারকে চাপমুক্ত হতে বেগ পেতে হচ্ছে। দুই-এক মাসের মধ্যে যদি আমরা আইএমএফের ঋণটা পেয়ে যাই, তাহলে কিন্তু আমাদের সংকট অনেকটাই কেটে যাবে। রিজার্ভ কমার যে ধারা রয়েছে, সেটা আর থাকবে না। দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা মহামারি করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ঋণসহায়তা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এখন তো আর কোভিডের ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। অস্থির বিশ্ব পরিস্থিতিতে অন্যরাও আগের চেয়ে কম ঋণ নিচ্ছে। সে কারণেই বিদেশি ঋণ কমছে। আমার মনে হচ্ছে, এবার গতবারের চেয়ে ঋণ বেশ খানিকটা কম আসবে।
ইআরডি সূত্র জানায়, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে দাতাদের কাছ থেকে যে ১৩৫ কোটি ডলারের ঋণসহায়তা পাওয়া গেছে, তার মধ্যে প্রকল্প সাহায্য এসেছে ১২৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আর অনুদান পাওয়া গেছে ৫ কোটি ১২ লাখ ৩০ হাজার ডলার। গত বছরের একই সময়ে প্রকল্প সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল ১৮৬ কোটি ২৯ লাখ (১.৮৬ বিলিয়ন) ডলার। অনুদান এসেছিল ৭ কোটি ৫১ লাখ ৩০ হাজার ডলার। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭৯৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার (৭.৯৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণসহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ৭৩৮ কোটি (৭.৩৮ বিলিয়ন) ডলার। বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ৬৫৪ কোটি ডলার।
জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সবচেয়ে বেশি অর্থ ছাড় করেছে জাপান, প্রায় ৪৬ কোটি ডলার। চীনের কাছ থেকে পাওয়া গেছে ২৭ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) দিয়েছে ১৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার। বিশ্বব্যাংক ছাড় করেছে ১৯ কোটি ২১ লাখ ডলার। ভারত দিয়েছে ১০ কোটি ১৬ লাখ ডলার। এছাড়া রাশিয়ার কাছ থেকে পাওয়া গেছে ৭ কোটি ৬৫ লাখ ২০ হাজার ডলার। এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) দিয়েছে ২২ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
ইআরডির তথ্য বলছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে দাতাদের ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই ৩ মাসে ৯ কোটি ৪০ লাখ ৩০ হাজার ডলার ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দাতারা। এই বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ৪০ কোটি ৫০ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এ হিসাবে প্রতিশ্রুতি ৪ গুণের বেশি বেড়েছে। আর জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে আগে নেয়া ঋণের আসল ও সুদ বাবদ ৫২ কোটি ৫৬ লাখ ১০ হাজার ডলার পরিশোধ করেছে সরকার।
গত বছরের একই সময়ে সুদ-আসল বাবদ ৫৯ কোটি ৩৮ লাখ ৬০ হাজার ডলার শোধ করা হয়েছিল। এ হিসাবে এই ৩ মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধ বাবদ ১১ দশমিক ৫ শতাংশ কম অর্থ শোধ করতে হয়েছে সরকারকে।এমকেঋ