কীর্তনখোলার পারে জনস্রোত

বিএনপির গণসমাবেশ কেন্দ্র করে কীর্তনখোলা নদীর পারে নেমেছিল নেতাকর্মীদের স্রোত। নানা বাধা উপেক্ষা করে শনিবার বরিশাল বঙ্গবন্ধু উদ্যানে বিভাগীয় গণসমাবেশে যোগ দেন তারা।

এ কর্মসূচি কেন্দ্র করে কয়েকদিন ধরে উত্তেজনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। গণসমাবেশে প্রধান অতিথি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, সামনে আন্দোলন-সংগ্রামের আরেকটি যুদ্ধ আছে।

সেই যুদ্ধে জয়ী হতে বিভেদ ভুলে সবাইকে একতাবদ্ধ হতে হবে। এবার ফয়সালা হবে রাজপথে। তিনি বলেন, আমরা জনগণের সঙ্গে আছি। আজকের সমাবেশে প্রমাণ হয়েছে, আমরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন নই। কথা দিচ্ছি, আমরা জনগণের সঙ্গে থাকব।

এদিকে সকালে বরিশালে আসার পথে গৌরনদীতে নেতাকর্মীদের গাড়িবহরে হামলা চালানো হয়। আরও কয়েক স্থানেও বাধার মুখে পড়েন তারা।

অসহনীয় দ্রব্যমূল্য, লাগাতার লোডশেডিং, দুর্নীতি-দুঃশাসন, লুটপাট, মামলা-হামলা, গুম, হত্যা ও খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ভোর থেকে খণ্ড খণ্ড কয়েকশ মিছিল নিয়ে নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধু উদ্যানে (বেলস পার্ক) উপস্থিত হন।

ব্যান্ডের তালে তালে ভুভুজেলা বাজিয়ে সমাবেশে অংশ নেন তারা। হাতে পতাকা মোড়ানো লাঠি দেখা গেছে। কেউ এসেছেন স্লোগান লেখা কাফনের কাপড় পরে। বেলা গড়ানোর আগেই সমাবেশসস্থল প্রায় পূর্ণ হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে অতিবৃষ্টির কারণে মাঠ কাদা থাকায় কিছু অংশ ফাঁকা ছিল। গরমের তাপের কারণে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতাকর্মীদের অনেকে আশপাশের সড়কে গাছতলায় অবস্থান নেন।

তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থান নেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। মাঠের উত্তর পাশে সার্কিট হাউজ, দক্ষিণে চাঁনমারি, পূর্বে পুলিশ লাইন্স ও পশ্চিমে লঞ্চঘাট পর্যন্ত নেতাকর্মীরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন। এ সময় তাদের বেশ উৎসবমুখর দেখা গেছে।

সমাবেশকে কেন্দ্র কয়েকদিন ধরে বরিশাল ও আশপাশের জেলাগুলোয় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। মহানগর এলাকায় কিছু না হলেও বিভিন্ন জেলায় নেতাকর্মীরা হামলা ও বাধার মুখে পড়েন।

বিএনপির সমাবেশ কেন্দ্র করে শুক্র ও শনিবার বন্ধ ছিল বাস, লঞ্চ, থ্রি-হুইলার, এমনকি খেয়াঘাটও। বাস ও লঞ্চ বন্ধের ঘোষণা দেওয়ায় কয়েকদিন ধরে বরিশাল শহর কার্যত সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। এতে সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েন। সবকিছু বন্ধ থাকবে-এমন আশঙ্কায় দুইদিন আগেই নেতাকর্মীরা শহরে চলে আসেন। পরিবহণ বন্ধ থাকায় পরে যারা এসেছেন, তারা ট্রলার, বালুর জাহাজ ও হেঁটে সমাবেশস্থলে পৌঁছান। সমাবেশের দিন মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সেবায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয়।

দুপুরে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বেলা ১১টায় সমাবেশ শুরু হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুক। মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদ, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আকতার হোসেন মেবুল ও উত্তরের সদস্য সচিব মিজানুর রহমান মুকুল সঞ্চালনা করেন।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগের চরিত্রের দুটি গুণ হচ্ছে ভোট চুরি ও সন্ত্রাস। এ দুটি বিষয় তাদের চরিত্রের সঙ্গে মিশে গেছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ ভোট চুরি করে ক্ষমতায় গিয়েছিল। এখন নতুন করে ভোট চুরি করে কোনো রকম ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করছে।

এজন্য নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ বলে ধারণা দিচ্ছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলছে। ইভিএম-এ ভোট নেওয়ার কথা বলে বিভ্রান্ত করছে। কিন্তু আমাদের কথা পরিষ্কার-শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। এ সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না।

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, নির্বাচন হতে হলে আগে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে। নতুন নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে। সেই সরকার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে নির্বাচন দেবে। তারপরই জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা হবে।

শেষ বিকালে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বক্তৃতায় বলেন, এত বাধার পর কাউকে আটকে রাখতে পারেননি। জনগণের স্রোত দাবিয়ে রাখা যায়নি। এটা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র ফিরে পাওয়াদের অধিকারের টান। এ অধিকার আওয়ামী লীগ ধ্বংস করে দিয়েছে। অথচ ১৯৭১ সালে গণতন্ত্র ও মুক্তচিন্তার স্বপ্ন নিয়ে মানুষ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে।

আওয়ামী লীগের শাসনামলের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ’৭৫ সালে বাকশাল কায়েম করেছিল। এখন গণতন্ত্রের মোড়কে একদলীয় শাসন কায়েম করতে চাইছে। ১৫ বছর হামলা-মামলা করছে। যারা হামলার স্বীকার হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা তাদের একমাত্র হাতিয়ার।

ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বিদেশে টাকা পাচার করার অভিযোগ এনে তিনি বলেন, বৈশ্বিক কারণে এখন ডলারের দাম বেশি। ডলার সংকটে দেশ। এখন সংকটের কথা বলছে সরকার। কিন্তু যখন হাজার হাজার কোটি টাকা কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়ায় পাচার হয়েছে, তখন খেয়াল ছিল না? বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ দাবি করে সরকার হাতিরঝিলে আতশবাজি উৎসব করেছে। এখন বিদ্যুৎ কোথায়? কুইক রেন্টাল করে হাজার হাজার কোটি লুটপাট করেছে। চুরি আর ঘুস-এটাই তাদের কাজ।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চিত্র তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার ছিল ১০ টাকায় চাল, ঘরে ঘরে চাকরি আর বিনা পয়সায় সার দেবে। কিন্তু সবকিছুর দাম বিএনপি আমলের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। ঘরে ঘরে চাকরি তো নেই, আওয়ামী লীগ লোকদের চাকরি পেতে ঘুস দিতে হয়।

মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ বর্গির সরকারে পরিণত হয়েছে। তাদের আচরণ বর্গিদের মতো হয়ে গেছে।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, সরকার দুর্ভিক্ষের পদধ্বনির কথা শুনাচ্ছে। কেন দুর্ভিক্ষ? এতদিন তো দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে ঢোল পিটিয়েছে সরকার। উন্নয়ন উন্নয়ন বলে চিৎকার করেছে। এজন্য দেশের মানুষ এখন আর কোনো কথা শুনতে চায় না। তাদের একটিই কথা-টেক ব্যাক বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যাবে কোন পথে, ফয়সালা হবে রাজপথে। তাই কারও সঙ্গে দ্বিমত নয়, সবাইকে এক হয়ে আন্দোলনে নামতে হবে।

গণসমাবেশে আরও বক্তব্য দেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বেগম সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর (বীর-উত্তম), মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন (বীরবিক্রম), এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন, আবদুল আউয়াল মিন্টু, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, জয়নাল আবেদীন, যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিবুন নবী খান সোহেল, সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন, সাবেক সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আলম, জহির উদ্দিন স্বপন, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা মাসুদ আহম্মেদ তালুকদার, এবিএম মোশাররফ হোসেন, অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভূইয়া, আকন কুদ্দুসুর রহমান, মাহবুবুল হক নান্নু, মো. মুনির হোসেন, আসাদুল করিম শাহিন, ডা. রফিকুল কবির লাবু, ফিরোজ জামান, কাজী রওনাকুল ইসলাম টিপু, বিএনপির কার্যনির্বাহী সদস্য ও সাবেক সংসদ-সদস্য হাফিজ ইব্রাহিম, মেজবাহ উদ্দিন ফরহাদ, আবুল হোসেন খান, গাজী নুরুজ্জামান বাবুল, এবায়দুল হক চান, ডা. শহীদ হাসান, নজরুল ইসলাম মোল্লা, হাসান মামুন, নুরুল ইসলাম নয়ন, দুলাল হোসেন, হায়দার আলী লেলিন, মাওলানা শাহ মো. নেসারুল হক, ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবাহান, কামরুল ইসলাম সজল, এলিজা জামান, আবু নাসের মো. রহমাতুল্লাহ। এছাড়াও যুবদলের সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, আবদুল মোনায়েম মুন্না, স্বেচ্ছাসেবক দলের এসএম জিলানী, রাজিব আহসান, কৃষক দলের শহিদুল ইসলাম বাবুল, মহিলা দলের আফরোজা আব্বাস, শ্রমিক দলের আনোয়ার হোসেন, ছাত্রদলের সাইদ মাহমুদ জুয়েল, বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির মজিবুর রহমান নান্টু, উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক দেওয়ান মো. শহিদুল্লাহ, ভোলা জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম নবী আলমগীর, পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব স্নেহাংশু সরকার কুট্টি, বরগুনা বিএনপির আহ্বায়ক মাহবুব আলম ফারুক মোল্লা, পিরোজপুর বিএনপির আহ্বায়ক আলমগীর হোসেন, ঝালকাঠি জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ হোসেন। সমাবেশে বরিশালে গুম হওয়া ছাত্রদল নেতা ফিরোজ খান কালু ও মো. মিরাজের মা এবং বরিশালে সম্প্রতি আন্দোলনে নিহত আবদুর রহমানের স্ত্রী খাদিজা বেগম বক্তব্য দেন।

গণসমাবেশে প্রধান বক্তা মির্জা আব্বাস বলেন, সব বন্ধ করে কোনো লাভ হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। বিএনপি চারটি সমাবেশ করার পর ওবায়দুল কাদের বলেছেন তিনি পালাবেন না। তাহলে আমি বলতে পারি-উনি পালাবেন কি না, জানি না। তবে নিশ্চিত জেলে যাবেন। যুগান্তরসহ কয়েকটি দৈনিকের শিরোনাম তুলে ধরে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার দেশ থেকে তিন লাখ কোটির বেশি ডলার পাচার করেছে।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, খেলা কার সঙ্গে হবে? প্রথম শ্রেণির সঙ্গে তো তৃতীয় শ্রেণির দলের খেলা হতে পারে না। আওয়ামী লীগ তো থার্ড ক্লাস পার্টি। সরকার বলে টাকা নেই অথচ ভোট চুরির মেশিন কিনতে টাকার অভাব হয় না।

বেগম সেলিমা রহমান বলেন, আপনারা যুদ্ধ করে এখানে এসেছেন। আপনাদের দাবি এই সরকারের পতন ঘটানো। আপনারা সেই আন্দোলনে সফল হয়েছেন। সরকারের পতন এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র।

আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, সরকার নাকি বিএনপির পতনের পদধ্বনি শুনতে পারছে। আসলে তারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে আসার পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। এদের পতন এখন সময়ের দাবি। ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের পতন ঘটানো হবে।

খাদিজা বেগম তার স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে বলেন, ‘আমি হত্যার বদলে হত্যা চাই, লাশের বদলে লাশ চাই। রক্তের বদলে রক্ত চাই।’ এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়ায় তিনি বক্তব্য শেষ করতে পারেননি।

গৌরনদীতে বিএনপি নেতাদের গাড়িবহরে হামলা : বরিশালের গৌরনদীতে বিএনপি নেতা ইশরাকের গাড়িবহরে হামলার পর একই স্থানে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম রিজু এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সহ-সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ উদ্দিন বকুল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদির ভুঁইয়া জুয়েলের গাড়িবহরে হামলা ও বাধার ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেত্রী সেলিনা সুলতানা নিশিতাকে বহনকারী গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এতে গাড়িবহরে থাকা বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তারা সবাই বরিশালে বিএনপির গণসমাবেশে যাচ্ছিলেন। শনিবার সকালে গৌরনদীর মাহিলাড়া বাজারের কাছে এ হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সকাল সাড়ে ৬টায় ইশরাকের বহরের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা বিল্লাল হোসেনকে মারধর করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়।

LEAVE A REPLY