করোনা মহামারির কারণে সারা বিশ্বে পর্যটন শিল্পে প্রভাব ফেলছে। এ কারণে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিপর্যস্ত হয়েছে। দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলো আবার প্রাণচাঞ্চল্যে মুখর হয়ে উঠলেও সাড়া মিলছে না বিদেশি পর্যটকদের। দিন দিন কমছে বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা। প্রকৃতির বহুরূপী সৌন্দর্যে ভরপুর এ দেশে রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা।
বিশ্বের যে কোনো পর্যটককে আকৃষ্ট করার মতো সব আকর্ষণীয় উপাদান থাকলেও সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অভাবে ভ্রমণ পিপাসু বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারছে না বাংলাদেশ। পর্যটকদের মানসম্মত সেবা ও নিরাপত্তার মান বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকায় বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারছে না।
জানা যায়, দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলোতে প্রতি বছর ভ্রমণ করছেন প্রায় দেড় কোটি পর্যটক। এর মধ্যে বিদেশি পর্যটক মাত্র তিন থেকে পাঁচ শতাংশ। দেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান শুধু ৪.৪ শতাংশ। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশগুলো ১০ শতাংশের উপরে অবদান রাখছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১১০ কোটি পর্যটক প্রতিবছর ভ্রমণ করে থাকেন। সামনে এ পর্যটকের সংখ্যা দেড়শ কোটি হবে বলে ধারণা করছেন পর্যটক বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে পর্যটক ভিসা নিয়ে যারা বাংলাদেশে আসছেন, তাদের বেশিরভাগই ব্যবসায়িক কাজ, উন্নয়ন সংস্থা ও দূতাবাসসংশ্লিষ্ট কাজে আসছেন। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ এশিয়া হবে পর্যটকদের গন্তব্য। তখন পৃথিবীর প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যটক ভ্রমণ করবে এশিয়া মহাদেশে। জানা যায়, বর্তমানে মোট কর্মসংস্থানের ৯.৯ শতাংশ তৈরি হয় পর্যটন খাতে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য সূত্রে জানা গেছে, দেশে ২০১৭ সালে বিদেশি নাগরিক আগমন করেছেন ৫ লাখ ৬৬৫ জন। এছাড়া ২০১৮ সালে বিদেশি নাগরিক এসেছেন ৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ জন। এছাড়া ২০১৯ সালে বিগত ১০ বছরে সর্বোচ্চ বিদেশি নাগরিক দেশে এসেছেন ৬ লাখ ২১ হাজার ১৩১ জন। করোনা মহামারির সময় ২০২০ সাল নাগাদ বিদেশি এসেছেন ১ লাখ ৮১ হাজার ৫১৮ জন। সর্বশেষ ২০২১ সালে বিদেশি নাগরিক এসেছেন শুধু ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৮৬ জন।
পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত বিদেশি নাগরিকরা পর্যটন ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। তবে মার্কিন উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইড বলছে, বাংলাদেশে যেসব বিদেশি পর্যটক আসছেন তাদের মধ্যে ভ্রমণের উদ্দেশে আসছেন মাত্র পাঁচ শতাংশ। বাকিরা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প, উন্নয়ন প্রকল্প ও এনজিওর কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাজে এসে থাকেন।
করোনা মহামারির কারণে সম্ভাবনাময় এ পর্যটন খাতে বিদেশি পর্যটকদের আসার গতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। এতে বিদেশি পর্যটক আসার হার আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। যার ফলে পর্যটন খাতে বিদেশি পর্যটকদের তেমন সাড়া না পাওয়ায় জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো অবদান রাখতে পারছেন না।
পর্যটন সূত্রে জানা যায়, দেশে মোট ১ হাজার ৫১টি ট্যুরিস্ট স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। আকর্ষণীয় পর্যটন খাতে যেসব উপাদান থাকা দরকার যেমন-সমুদ্র, নদী, বন, পাহাড়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ঋতুবৈচিত্র্য সবই বাংলাদেশে বিদ্যমান রয়েছে। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা রয়েছে ৩১০টি। এ ছাড়া রয়েছে অসংখ্য হাওড়-বাঁওড়-বিল। আছে সুবিশাল সমুদ্রতট।
দেশের দর্শনীয় স্থানগুলো নিয়ে গণমাধ্যমে যেমন নেই পর্যাপ্ত প্রচারণা, তেমনি সরকারি উদ্যোগেও পর্যটন খাতকে তুলে ধরতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। দেশের বাইরে দূতাবাসগুলো থেকেও পর্যটনবিষয়ক তথ্য পাওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ নেই, তথ্য নেই সরকারি ওয়েবসাইটগুলোতেও। পিএটিএ প্রকাশিত তথ্য ছকে আমাদের আশপাশের সব দেশের তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বাংলাদেশের কোনো তথ্য সেখানে নেই। সরকার নানা পরিকল্পনা নিলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
বিদেশি পর্যটকদের জন্য পর্যটন অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন আধুনিকমানের হোটেল, দক্ষ ও মানসম্মত সেবা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদেশি পর্যটকদের জন্য বিনোদন, নিরাপত্তা ও পর্যটনে সুষ্ঠু পরিবেশ বিকাশ করতে না পারাকেই দায়ী করছেন পর্যটনসংশ্লিষ্টরা। এদিকে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর না থাকায় বিদেশি পর্যটকদের অনীহার অন্যতম কারণ। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক থাকায় পর্যটকদের আগ্রহ দেখা যায় না।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) সূত্রে জানা গেছে, মাত্র ১৪০০ জন ট্যুরিস্ট পুলিশ বিস্তৃত পর্যটন এলাকার নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছে। সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে ঘাটতি থাকায় বিদেশি ভ্রমণপিপাসু পর্যটকরা আকৃষ্ট হচ্ছেন না।
পর্যটন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের পর্যটনের সড়কগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভার রয়েছে। সমুদ্রসৈকতে ময়লা ও আবর্জনা সরানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। পর্যটকদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। বিষয়গুলো সমাধানের উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন দেশে ব্র্যান্ডিং করতে পারলে বিদেশি পর্যটকদের সহজে আকৃষ্ট করতে পারবে বলে মনে করেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পর্যটন শিল্পকে তাদের মূল চালিকা শক্তি হিসাবে রূপান্তর করলেও বংলাদেশ সেই তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে আছে। সঠিক পরিকল্পনা ও প্রচারণার অভাব এই সম্ভাবনার খাতকে পিছিয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনা নিতে হবে। ওয়েবসাইটগুলোকে এখনো পর্যটকবান্ধব করে গড়ে তুলতে পারিনি। এসব ওয়েবসাইটকে আরও তথ্যবহুল করে গড়ে তুলতে হবে। যাতে একটি স্থান থেকে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা প্রয়োজনীয় সব রকম তথ্য পেতে পারেন। ফেসবুক, টুইটারসহ গণমাধ্যমে প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ বিশাল সেবা খাত কাজে লাগাতে পারলে পর্যটনে বাংলাদেশ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার সমকক্ষ হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান পরিবহণ ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী যুগান্তরকে বলেন, আমরা বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্তু বিদেশি পর্যটকদের যে চাহিদা তা পূরণ করার মতো মনমানসিকতা আমাদের নেই। সেই পরিবেশ বাংলাদেশে এখনো তৈরি হয়নি। তাই বিদেশি পর্যটক কম আসেন। আমাদের উদারনীতি অবলম্বন করতে হবে। অন্যান্য দেশে বিদেশি পর্যটকদের ব্যাপারে খুব উদার। তবে আমাদের দেশে-বিদেশি পর্যটকদের জন্য যে সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তা আরও বাড়াতে হবে।