পণ্যের দাম লাগামছাড়া আয়ের ক্ষেত্র সীমিত

দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্যের দামে লাগামহীন গতি বিরাজ করছে। এর মধ্যে সরকারিভাবে চিনি ও সয়াবিন তেলের দাম বৃহস্পতিবার থেকে আরও এক দফা বাড়ানো হয়েছে। ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয় রেখে মানুষের আয় বাড়ছে না। উলটো অথনৈতিক মন্দায় আয়ের ক্ষেত্র আরও সংকুচিত হয়েছে। আয় কমেছে অনেকের।

এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে। দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর পর বেশিরভাগ মানুষ সঞ্চয় করতে পারছে না। বরং আগের সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে থাকায় ব্যাংকে রাখা আমানত বাড়ার পরিবর্তে কমে যাচ্ছে। সব মিলে এখন দুঃসময়ের মধ্যে আছে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষ।

এদিকে অর্থনৈতিক মন্দায় বিনিয়োগ কম হচ্ছে। বাড়ছে না কর্মসংস্থান। বেসরকারি খাতের বিকাশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এসব মিলে সরকারি খাত ছাড়া অন্য খাতের মানুষের আয় বাড়েনি। বরং কমেছে। আয়-ব্যয়ের এই ভারসাম্যহীনতায় বেড়েছে মানুষের কষ্ট। বাজারের তালিকা কাটছাঁট করতে হয়েছে। অনেক পণ্য বাদ দিতে হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানুষের পুষ্টির মধ্যে। খাবারে পুষ্টির মান কমে যাচ্ছে। যার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মানুষের শারীরিক কাঠামোতে।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের অক্টোবরে মানুষের আয় বেড়েছিল ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। চলতি বছরের অক্টোবরে আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে আয় বেশি বেড়েছে শূন্য দশমিক ৯৪ শতাংশ। একই সময়ের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ হয়েছে। আলোচ্য সময়ের ব্যবধানে এ হার বেশি বেড়েছে ৩ দশমিক ২১ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক বছরের ব্যবধানে আয়ের চেয়ে যেমন ব্যয় বেশি বেড়েছে। তেমনি আয় বৃদ্ধির হার কমেছে, ব্যয় বৃদ্ধির হার বেড়েছে। যদিও বিবিএসের মূল্যস্ফীতি ও আয় বাড়ার তথ্য নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বজুড়ে পণ্যের বাজারে অস্থিরতা চলছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহে ঝামেলা তৈরি হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতেও একশ্রেণির ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়ে অতি মুনাফা করার চেষ্টা করছে। দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ার কথা না থাকলেও বাড়ছে। তিনি বলেন, দেশে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। সুযোগ পেলেই তারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতার ভোগান্তিও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তিনি বলেন, একশ্রেণির মানুষের আয় বেড়েছে সেটা ঠিক। কিন্তু আরেক শ্রেণির মানুষের আয় কমছে। ফলে বৈষম্য বেড়েছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে দেখা যায়, স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় চাল ও আটা। এ দুটি পণ্যের দাম গত এক বছরের ব্যবধানে লাগামহীনভাবে বেড়েছে। নাজিরশাইলের কেজি গত বছরের অক্টোবরে ছিল ৬৯ টাকা ৭৭ পয়সা। গত অক্টোবরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ টাকা ৩৪ পয়সা।

একই সময়ের ব্যবধানে প্রতি কেজি খোলা আটার দাম ৪১ টাকা ৯৫ পয়সা থেকে বেড়ে ৫৫ টাকা ৮৭ পয়সা হয়েছে। এর মধ্যে চালের আমদানি খবুই কম। চাহিদার সিংহভাগই দেশে উৎপাদিত হয়। ফলে এর দাম এত বেশি বাড়ার পেছনে যুক্তি নেই বলে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকরা। তবে গমের প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন দাম কিছুটা কমলেও সে হারে দেশের বাজারে কমছে না।

বিবিএসের তথ্যে, আলোচ্য সময়ে মোটা চালের দাম ৫৩ থেকে বেড়ে ৫৭ টাকা হয়েছে। কিন্তু বাজারে ৬০ টাকার কম মোটা চাল মিলছে না। মসুর ডাল ১২০ থেকে বেড়ে ১৩৫ টাকা, মুগ ডাল ১২৯ থেকে ১৩৩ টাকা, চিনি ৮০ থেকে বেড়ে ৯৯ টাকা হয়েছে। তবে বাজারে ১১৫ টাকার কমে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। এ তিনটি পণ্যের বড় অংশই আমদানি করা হয়। কিন্তু এগুলোর দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে স্থানীয় বাজারে।

মাছ-মাংসের দামও বাড়ছে। গত বছরের অক্টোবরে গরুর মাংসের কেজি ছিল ৫৬৭ টাকা। গত অক্টোবরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১৮ টাকা। একই সময়ে খাসির মাংস বেড়েছে ৭৮০ থেকে ৯৫০ টাকা। অথচ দুটি প্রাণীই দেশের, আমদানি করতে হয় না। ফলে এগুলোর দাম এত বাড়াও যুক্তিযুক্ত নয়। মাঝারি আকারের রুই মাছের কেজি ৩৪০ থেকে বেড়ে ৪০০ টাকা হয়েছে।

ডিম আমদানি করতে হয় না। এর শুধু কিছু খাদ্য আমদানি করতে হয়। অথচ এর দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এ খাতের ছোট ব্যবসায়ীরাও অভিযোগ করেছেন, বড় কোম্পানিগুলো সিন্ডিকেট করে ডিম ও ফার্মের মুরগির দাম বাড়িয়েছে। ওই সময়ে ডিমের হালি ৩৯ থেকে বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে।

সয়াবিন তেল নিয়ে বাজারে তেলেসমাতি কর্মকাণ্ড ঘটেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে বাড়ানো হয়েছে। অথচ আমদানি করা অপরিশোধিত তেল কারখানায় পরিশোধন হয়ে বাজারে আসতে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ মাস সময় লাগার কথা। লবণের কেজি ৩২ থেকে বেড়ে ৩৮ টাকা হয়েছে। অথচ এই পণ্যটির চাহিদা বেশিরভাগই মেটানো হয় দেশের উৎপাদন থেকে। এর ব্যবহারও কম। তবে অত্যাবশ্যকীয়।

সবজির হিসাবে আলুর দাম সব সময়ই ওঠানাম করে। পুরোটাই দেশে উৎপাদিত। এর উৎপাদন খরচও বাড়েনি। কারণ গত শীতে উৎপাদিত আলুই এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি আলু গত বছরের অক্টোবরে ছিল সাড়ে ২৭ টাকা। গত অক্টোবরে তা বেড়ে হয়েছে ৩১ টাকা। সবজির মধ্যে প্রায় সবকিছুর দামই বেড়েছে। ৫৬ টাকার বেগুন এখন ৬০ টাকা। ৫০ টাকার নিচে সবজি নেই। টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা, শিম ৯০ থেকে ১০০ টাকা, মাঝারি আকারের ফুলকপি প্রতি পিস ৫০ টাকা, একই আকারের বাঁধাকপি ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বজুড়ে পণ্যের দামে টালমাটাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সব ধরনের আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে। সেই প্রভাব দেশেও পড়ছে। তবে কেউ যাতে পণ্যের দাম নিয়ে অসাধুতা করতে না পারে সেদিকে তদারকি করা হচ্ছে। কেউ যাতে কারসাজি করে পণ্যের দাম না বাড়াতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে। কোনো অনিয়ম পেলেই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

বিবিএসের হিসাবে মিল্কভিটার প্যাকেটজাত দুধ প্রতি লিটার ৭০ থেকে বেড়ে ৭৭ টাকা হয়েছে। বাস্তবে গত সেপ্টেম্বর থেকেই প্রতি লিটার ৮০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আড়ংয়ের প্যাকেটজাত দুধ বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ৯০ টাকা।

বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, একই সময়ে শিক্ষার অন্যতম উপকরণ সাদা কাগজের প্রতি দিস্তা ২৯ থেকে বেড়ে ৩৫ টাকা হয়েছে। ৫০ কেজির সিমেন্টের ব্যাগ ৪৪৮ থেকে বেড়ে ৫৫০ টাকা হয়েছে। মধ্যম মানের লুঙ্গি ৮০৫ থেকে বেড়ে ৮২১ টাকা, ভালো মানের থান কাপড় প্রতি মিটার ৮৫ থেকে বেড়ে ১০৭ টাকা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত কমেছে। সরকারি সঞ্চয়পত্রের বিক্রিও কমে গেছে। পণ্যমূল্য বাড়ায় বাজারের চাহিদা সামাল দিতে ভোক্তারা এখন হিমশিম খাচ্ছে। ফলে নতুন করে সঞ্চয় করতে পারছে না। বরং আগের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সঞ্চয় বেড়েছিল ৯ শতাংশ। চলতি বছরের একই সময়ে বেড়েছে মাত্র দশমিক ৭৬ শতাংশ। আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে ৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। সরকারি সঞ্চয়পত্র বিক্রিও কমে গেছে। আগে বিক্রি থেকেই সঞ্চয়পত্রের মুনাফাসহ মূল অর্থ পরিশোধ করা হতো। গত সেপ্টেম্বরে এসে তা সম্ভব হয়নি। ৭০ কোটি টাকা ঘাটতি হয়েছে।

এ অর্থ সরকার থেকে দিতে হয়েছে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ ব্যাংকে আমানতের গড় সুদের হার ৪ দশমকি ৯ শতাংশ। এর বাইরে ব্যাংক নানা ধরনের ফি কেটে রাখে, সরকারকে দিতে হয় দুই ধরনের কর। এসব মিলে সঞ্চয় কমে যাচ্ছে।

LEAVE A REPLY