রিজার্ভে সমস্যা নেই

আরো উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছ থেকে আবারো নৌকায় ভোট চাইলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, নৌকায় ভোট দিয়ে আমাদের নির্বাচিত করে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। আমি আপনাদের কাছে ওয়াদা চাই- আগামী নির্বাচনেও নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে সেবা করার সুযোগ দেবেন। দেবেন কিনা? আপনারা হাত তুলে ওয়াদা করেন। আওয়ামী লীগ সভাপতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে উপস্থিত জনতা সমস্বরে চিৎকার করে ‘ভোট দেব’ বলে ওয়াদা করেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান। গতকাল বৃহস্পতিবার যশোরের শামস্-উল হুদা স্টেডিয়ামে যশোর জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতা দেন শেখ হাসিনা। এ সময় গত নির্বাচনে যশোরের সবকটি আসন থেকে নৌকাকে বিজয়ী করায় যশোরের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। যশোরের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, জরাজীর্ণ যশোর স্টেডিয়াম ভেঙে ১১ স্তর বিশিষ্ট গ্যালারি তৈরি করা হবে। তরুণ সমাজকে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা ও লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করতে হবে। যুব সমাজ আমাদের ভবিষ্যৎ। ফলে মাদক, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস থেকে দূরে থাকতে হবে।

বেলা ২টা ৩৮ মিনিটে শেখ হাসিনা নৌকা আকৃতির মঞ্চে উঠলে বিভিন্ন স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তাকে স্বাগত জানানো হয়। যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সম্পাদক শাহিন চাকলাদারের সঞ্চালনায় জনসভায় আরো বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য, কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক ও জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক ও এস এম কামাল হোসেন, সংসদ সদস্য শেখ হেলাল, কাজী নাবিল আহমেদ প্রমুখ।

শেখ হাসিনা বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর জয় বাংলা স্লোগান ও জাতির পিতার নাম নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ছিল ইতিহাস বিকৃতি আর হত্যা ক্যু ষড়যন্ত্র। হাজার হাজার সেনা-বিমান বাহিনীর অফিসারকে হত্যা করা হয়েছিল। একের পর এক ক্যু হয়েছে আর সারারাত কারফিউ- এই ছিল তখনকার অবস্থা। আর এই হত্যাকাণ্ডে ছিল খুনি জিয়া-মোশতাক। বিচার চাওয়ার অধিকার আমার ছিল না। মা-বাবা-ভাই হারিয়েও বিচার চাইতে পারব না! তারপরও সবকিছু মাথায় নিয়ে ফিরে এসেছি বাংলার জনগণের কাছে। একটাই কারণ, এই জাতির জন্য আমার বাবা সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। আমার একটাই লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনাদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে বারবার ক্ষমতায় এসেছি বলেই এত উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে। যে বাংলাদেশকে ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত করেছিল, বিদেশ থেকে পুরনো কাপড় এনে এদেশের মানুষকে পরাত, মানুষের পেটে খাবার ছিল না, মাথা গোজার ঠাঁই ছিল না, রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। আমরা ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিক করে দিয়েছি। সেখান থেকে বিনা পয়সায় ৩০ ধরনের ওষুধ পাওয়া যায়। ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি। এখন সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন। আর বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় থাকতে কী দিয়েছিল? দিয়েছে অস্ত্র-খুন-হত্যা। এই যশোরে শামসুর রহমান ও মুকুলকে হত্যা করা হয়েছে, খুলনায় মঞ্জুরুল ইমাম, মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির বালুুসহ সাংবাদিকদের একে একে হত্যা করা হয়েছে। শুধু রক্ত আর হত্যা ছাড়া বিএনপি তো আর কিছুই দিতে পারেনি। আর নিজেরা লুটপাট করেছে। নিজেরা মানুষের অর্থ পাচার করেছে। মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। নিজেদের উন্নয়ন করেছে।

বিএনপির কাজই গুজব ছড়ানো: প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়া যখন মারা যায় কোনো কিছু রেখে যায়নি। ভাঙা সুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি। কিন্তু সেই ভাঙা সুটকেস হয়ে গেল জাদুর বাক্স। যে বাক্স দিয়ে কোকো আর তারেক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে। তার শাস্তিও হয়েছে। আজকে তারেক সাজাপ্রাপ্ত আসামি। দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করার মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধে সাত বছরের জেল আর ২০ কোটি টাকা জরিমানা হয়েছে। অস্ত্র চোরকারবারি করতে গিয়ে দশ ট্রাক অস্ত্র নিয়ে ধরা খেয়েছে। সেখানেও সাজা হয়েছে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে আমাকেসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হত্যা করতে চেয়েছিল। সেই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। আর খালেদা জিয়া এতিমের টাকা মেরে দিয়ে সাজাপ্রাপ্ত। যে দলের নেতা সাজাপ্রাপ্ত তারা জনগণকে কী দেবে? তারা কিছুই দিতে পারে না। শুধু মানুষের রক্ত চুষে খেতে পারে। এটাই হলো বাস্তবতা। বিএনপির সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, গুজবে কোনো কান দেবেন না। বিএনপির কাজই হচ্ছে গুজব ছড়ানো। ওরা নিজেরা তো কিছু করতে পারে না। ক্ষতায় এসে লুটপাট করে খেয়েছে।

রিজার্ভের কোনো সমস্যা নেই: রিজার্ভের কোনো সমস্যা নাই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো অর্থনীতিকে আমরা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছি। অনেকেই রিজার্ভ নিয়ে কথা বলেন। রিজার্ভের কোনো সমস্যা নেই। অনেকে বলেন, ‘ব্যাংকে টাকা নাই’। ব্যাংক থেকে টাকা তোলেন। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ঘরে রাখলে তো চোরে নিয়ে যাবে। চোরের জন্য সুযোগ করে দেয়া। ব্যাংকে টাকা নেই কথাটি ঠিক নয়। গতকালও (বুধবার) আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মিটিং করেছি। আমাদের এই বিষয়ে কোনো সমস্যা নেই। প্রত্যেকটি ব্যাংকে যথেষ্ট টাকা আছে। আমাদের রেমিটেন্স আসছে। বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আসছে। রপ্তানি আয় বেড়েছে। আমাদের ট্যাক্স কালেকশন বেড়েছে। অন্য দেশ যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী আছে।

বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের ও উন্নয়নশীল দেশ : সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ যাতে পৃথিবীর বুকে সম্মান নিয়ে চলতে পারে সেভাবে দেশকে উন্নয়ন করেছি। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ, উন্নয়নশীল দেশ। সরকার কৃষকের কল্যাণে সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমরা ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। কৃষি উপকরণ কার্ড দিয়েছি। দুই কোটি কৃষক সেই উপকরণ কার্ড পায়। এক কোটি কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে। তাদের টাকা তাদের কাছে চলে যায়। ৯০ টাকায় সার কিনে ১৬/১৭ টাকায় আমরা সার দিচ্ছি। কোনো দেশ, এমনকি উন্নত দেশও করোনা ভ্যাকসিন বিনা পয়সায় দেয়নি। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মান সব দেশে টাকা দিয়ে ভ্যাকসিন নিতে হয়েছে। আর আমরা ভ্যাকসিন কিনে বিনা পয়সায় আপনাদের দিয়েছি। অনেকে রিজার্ভ নিয়ে কথা বলে, রিজার্ভ গেল কোথায়? রিজার্ভ কোথাও যায়নি। মানুষের কাজে লেগেছে। যে গম ২শ ডলারে কিনতাম, তা এখন ৬শ ডলার। পরিবহন খরচ বেড়েছে। তারপরও আমরা কিনে এনেছি যাতে খাদ্য ঘাটতি না দেখা দেয়। এজন্য আমি জমি অনাবাদি না রেখে উৎপাদন করার কথা বলেছি।

দেশের কোনো মানুষ ঠিকানাবিহীন থাকবে না: শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা চেয়েছিলেন দেশের একটি মানুুষও গৃহহীন থাকবে না। তিনি যে প্রকল্প শুরু করেছিলেন, সেই পথ ধরে সারাদেশে গৃহহীনদের তালিকা করে বিনা পয়সায় জমিসহ ঘর করে দিয়েছি বিনা পয়সায়। প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ এই ঘর পেয়েছে যাদের কোনো ঠিকানা ছিল না। এটা তাদের জীবন পাল্টে দিয়েছে এই দেশের কোনো মানুষ ঠিকানাবিহীন থাকবে না। যে বাংলাদেশ খালেদা জিয়ার সময় ৪০ ভাগ দারিদ্রতার হার ছিল। এটা আমরা ২০ ভাগে নামিয়ে এনেছি। যে হতদরিদ্র ২৫ ভাগ ছিল তা আমরা ১০ ভাগে নামিয়ে এনেছি।

যশোরে আমার নাড়ির টান আছে: যশোরে জনসভা করতে পেরে আনন্দিত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনার সময়ে বাইরে জনসভা করতে পারিনি। আজকে আমার প্রথম জনসভা এই যশোরে। যে যশোরে আমার নাড়ির টান আছে। এখানকার মাটিতে আমার নানা শেখ জহুরুল হক শুয়ে আছেন। তিনি যশোরে চাকরি করতেন। আমার মায়ের বয়স যখন তিন বছর, তখন তিনি মারা যান। ওই সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা এতই খারাপ ছিল যে এখানে আসা যায়নি। আমার নানাকে এখানে দাফন করা হয়েছে। এখানে আমার নানার স্মরণে আইটি পার্ক করা হবে। যশোরের উন্নয়নের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলেছি। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এই যশোর থেকে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম। এখানে নির্মাণ হয়েছে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইটি পার্ক, যেখানে দেড় থেকে দুই হাজার কর্মসংস্থান হয়েছে। যেখানে বিদেশ থেকে অনেক বিনিয়োগ আসছে। যশোরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করে দিয়েছিলাম। খালেদা জিয়া এসে অনেকগুলো বন্ধ করে দেয়। আমরা সেই বিশ্ববিদ্যালয় চালু করেছি। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা সবগুলোর উন্নয়নে কাজ করেছি। স্বাক্ষরতার হার যেখানে বিএনপির সময়ে ৪৫ ভাগ ছিল সেটিকে আমরা ৭৫ ভাগে উন্নীত করেছি।

পদ্মা সেতু ও মধুমতি সেতু হওয়ায় এই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তনের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী যশোর বিমানবন্দরকে আরো আধুনিকায়ন করার কথাও জানান। পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে মোংলা সমুদ্রবন্দরের কার্র্যকারিতার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এখন ঢাকা থেকে অনেক মাল কিন্তু চট্টগ্রামে যায় না, মোংলা বন্দরে যায়। এটা খালেদা জিয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। আমরা এসে চালু করেছি। অভয়নগরে ইপিজেড করার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে জমি নেয়া হয়ে গেছে। ৫শ একর জমি আমরা নিয়েছি। সেখানে ৪শটা শিল্প প্লট হবে। বহু লোকের কর্মসংস্থান হবে। এখানে যে স্থলবন্দর, যেহেতু এখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে আমাদের যুব সমাজের কর্মসংস্থান হবে। শুধু চাকরির পেছনে ছোটা নয়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, নিজে কাজ করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল, খুলনা-যশোর-কুষ্টিয়া, যশোর-খুলনা-মোংলা এই রাস্তাগুলো সব জাতীয় সড়কে উন্নীত করে দিচ্ছি পদ্মা সেতু থেকে যেন যশোরে সরাসরি আসতে পারে। ভাঙ্গা-যশোর রাস্তাও মহাসড়কে উন্নীত হবে। ২০১০ সালে যশোরে একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ৫শ শয্যাবিশিষ্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণের প্রাথমিক কাজ এখন চলমান আছে। প্রত্যেকটি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ বেডের ছিল আমরা তা ৫০ বেডে উন্নীত করে দিয়েছি। যশোরে কপোতাক্ষ জলাবদ্ধতা দূরে একটি প্রকল্প শেষ হয়েছে। এবার আমরা দ্বিতীয় প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এর ফলে যশোর খুলনা সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা দূর হবে। ৮২ কিলোমিটার নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে কাজ হাতে নিয়েছি। কপোতাক্ষের মতো ভবদহের জলাবদ্ধতা না থাকে সেই বিষয়েও আমরা পদক্ষেপ নেব। দারিদ্র বিমোচনের জন্য ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা নিচ্ছি।

LEAVE A REPLY