রামগড়ে ভূমি অধিগ্রহণে নজিরবিহীন জালিয়াতি!

খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলায় ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতুর সংযোগ সড়কটির দৈর্ঘ্য রামগড় বাজার থেকে সোনাইপুল বাজার পর্যন্ত সাড়ে ৩ কিলোমিটারের বেশি। সড়ক ও জনপথ বিভাগের এ সড়কের জমির গায়েবি মালিকানা বানিয়ে রাতারাতি অধিগ্রহণ বাবদ ৭০০ কোটি টাকা ভুয়া জমির দলিল সৃজন করে জাল-জালিয়াতি ও আত্মসাতের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছে একটি প্রভাবশালী চক্র। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের আসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ও দলিল জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছে চক্রটি। এ অবস্থায় সরকারের বিপুল অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি রাস্তার দুই পাশের শতাধিক জমির মালিকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ বিষয়ে উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসন, ভূমি সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের লিখিত অভিযোগ দিয়েও

প্রতিকার পাননি ভুক্তভোগীরা। কঠোর আন্দোলনের পাশাপাশি অনেকে সপরিবারে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছেন।

অভিযোগ উঠেছে, সেভেন স্টার নামে একটি সাতজনের সিন্ডিকেটকে সামনে দিয়ে প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের আসাধু কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে সড়ক সম্প্রসারণ বাবদ অধিগ্রহণের এ ৭০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও লোপাট করার চেষ্টা করছে। এমনটাই দাবি করেছে জমি হারানোর শঙ্কায় থাকা ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।

আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, ইতোমধ্যে কোনো কাগজপত্র ছাড়াই জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া দলিলে সাতজন সদস্য তাদের নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে সমান ভাগবাঁটোয়ারায় ২ লাখ ৭০ হাজার ৭০০ টাকা করে ৬২ লাখ ৫২ হাজার ৫৬৩ টাকা অধিগ্রহণের কোষাগার থেকে তুলে নিয়েছেন তারা। যাদের নামে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে, তারা হলেন ছাবুরা খাতুন, মোহাম্মদ মোস্তফা, নুরের নবী চৌধুরী, শাহানা আক্তার, ফেরদৌস ইসলাম, পারভীন আক্তার এবং মোছা. সাজেদাতুন।

অথচ ভূমি জরিপ এবং ভূমি অফিসের রেকর্ডে কাগজপত্রে দেখা গেছে, ১৯৫৮ সনের জরিপে ৪৭৩নং খতিয়ানের দাগ ১১৫৩, ১১৫২, ১১৬৩, ১১৬৫, ১১৬৬ পরিবর্তিত হয়েছে। এই দাগের মধ্যে ১১৫৩, ১১৬৫, ১১৬৬ দাগগুলো ম্যাপে সি, অ্যান্ড বি সড়ক উত্তরে বর্ণিত আছে এবং এই দাগগুলোর মালিক সুলতান আহাম্মদ বর্ণিত আছে। ১৯৭১ সনের জরিপে ৬৯০নং খতিয়ানের ১১৫৩, ১১৫২, ১১৬৩, ১১৬৬, ১১৬৫ দাগের মধ্যে ১১৫৩, ১১৬৫, ১১৬৬, দাগগুলোর উত্তরে সি অ্যান্ড বি বর্ণিত আছে।

অপরদিকে সড়কের জমির মালিকানা দাবি করা জালিয়াতি চক্রের অনেকেই ১৯৮০ সালের পর শরণার্থী হিসাবে বিভিন্ন এলাকা থেকে রামগড়ে আসেন। তাদের কারও কোনো দলিলপত্র রেকর্ডে নেই। এমনকি তাদের পূর্বপুরুষদেরও ওই এলাকায় বা আশপাশে জমির মালিকনা নেই। সর্বশেষ ২০২১ সাল পর্যন্ত সৃজিত কোনো দলিলে এসব ভূমিদস্যুর মালিকানার কোনো অস্তিত্ব নেই। তবু ভূমি অধিগ্রহণ টাকা লোপাট করতে ভূমি অফিসের কানুনগো দেলোয়ার, সার্ভেয়ার জাহাঙ্গীর ও দলিল লেখক মোস্তফার সহায়তায় ভুয়া দাগ ও পর্চায় অন্তর্ভুক্ত করে দলিল বানিয়ে সরকারি সিএনবি জায়গা ও ভুয়া জমির মালিকানা সেজে অর্থ লোপাটের চেষ্টা করা হচ্ছে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বলছে, চিহ্নিত ভূমিদস্যু হাফেজ আহম্মদ ভূঁইয়া, মোস্তাফা রাইটার, নুর নবী চৌধুরী, জাহাঙ্গীর গংদের নেতৃত্বাধীন সেভেন স্টার সদস্যদের সামনে দিয়ে এ অর্থ লোপাটের চেষ্টা চলছে। এরা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এবং মহা জালজালিয়াতির মাধ্যমে সরকারের ৭শ কোটি টাকা ও শতাধিক স্থানীয় জনগণের অধিগ্রহণ বাবদ জমির টাকা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছে।

স্থানীয় যুবলীগ নেতা ফারুক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সেভেন স্টার নাম দিয়ে রামগড় উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ভূমিদস্যু, ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদের যৌথ নেতৃত্ব মহা জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি টাকা আত্মসাৎ এবং শতাধিক পরিবারের জমির ৭০০ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টা চলছে। জেলা কানুনগো দেলোয়ার হোসেন ও সার্ভেয়ার জাহাঙ্গীর টাকার বিনিময়ে ভূমিদস্যুদের জাল-জালিয়াতি করতে সহযোগিতা করছে। তিনি বলেন, ভূমি অফিস, ডিসি অফিস তাদের দখলে চলে গেছে। আমাদের জনগণের কোনো অভিযোগ তারা শুনছে না, আমলেও নিচ্ছে না। এমন অবস্থায় আন্দোলনের পাশাপাশি অনেকে সপরিবারে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছে।

অপর ভুক্তভোগী অধ্যাপক মো. ফারুকুর রহমান বলেন, ২২৯নং রামগড় মৌজার রামগড় বাজারের জিরো মাইল থেকে সোনাইপুল বাজার পর্যন্ত সাড়ে তিন কিলোমিটার সড়ক সম্প্রসারণের কাজ চলছে। সড়ক বড় করার জন্য দুই পাশের জায়গা অধিগ্রহণের কথা। কিন্তু হঠাৎ করে সেভেন স্টার নামে একটি চিহ্নিত ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট রাতারাতি নাকি সরকারি রাস্তার মালিক হয়ে গেছে। একইভাবে কোনো কাগজপত্র ছাড়া রাস্তার দুই পাশের জমিও নাকি তাদের। অথচ ১৯৭১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যত দলিল সম্পাদিত হয়েছে, সব দলিলে রাস্তাটি সি অ্যান্ড বি এবং বর্তমান সড়ক ও জনপথ বিভাগের। রাস্তার দুই পাশের জমির মালিক দলিলমূলে আমার পরিবারসহ স্থানীয়রা। কিন্তু কোনো রেকর্ড দলিল-কাগজপত্র ছাড়াই এ ভূমিদস্যুরা প্রশাসনের আসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কীভাবে টাকা উত্তোলন করছে। প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার রাস্তার ৭০০ কোটি টাকা আত্মসাতের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

রামগড় সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সি অ্যান্ড বি রাস্তার মালিক কী করে ভূমিদস্যুরা হয়। তাও ১৯৮০ সালে আসা শরণার্থী। জায়গার মালিক আমাদের সবার নাম নাকি মুছে দিয়ে কানুনগো ও ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার জাহাঙ্গীর মিলে ভূমিদস্যুদের নাম বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা কী করে সম্ভব, এটা আমাদের জানা নেই। জাল-জালিয়াতির বিষয়ে আমি একটা মামলা করেছি ভূমি অফিসের জাল-জালিয়াতির অন্যতম নায়ক উত্তম বড়ুয়াসহ জড়িতের আসামি করে। তিনি বলেন, আমাদের সাবেক এমপি এবং জেলা আওয়ামী লীগের ১নং সদস্য একেএম আলিম উল্লাহ আমাদের মতো ভুক্তভোগী। এবার সাধারণ মানুষের কী অবস্থা, আপনারা কল্পনা করে দেখেন।

এসব অনিয়মের স্থানীয় ভূমি অফিসের কিছু অসাধু কর্মচারী ও ভূমিদস্যুর দৌরাত্ম্যের তথ্য মিলেছে যুগান্তরের অনুসন্ধানে। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, বিধি মোতাবেক ভূমির প্রকৃত মালিককে দেওয়া হবে অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের ন্যায্য টাকা। তবে বাস্তবে তা ভিন্ন।

সত্তরোর্ধ্ব মনির আহমেদ। রামগড় উপজেলার দারোগাপাড়ার এ বৃদ্ধের এখন দিন কাটছে নিজের নামে রেকর্ডীয় ভূমি হারানোর শঙ্কায়। রামগড়ে প্রস্তাবিত স্থলবন্দরের সড়ক প্রশস্তকরণের লক্ষ্যে রামগড় বাজার থেকে সোনাইপুল পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশের ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। এতে মনির আহমেদের নিজের নামে থাকা ভূমির মালিক কাগজেপত্রে হয়ে গেলেন অন্যজন। ভুক্তভোগী মনির আহমেদ বলেন, তিনি ৭৭নং দাগে জমির মালিক। এখন ৭৮নং দাগ সৃষ্টি হয়েছে। এ ৭৮নং দাগের ভূমির মালিক কে জানতে চাইলে ভূমি অফিস কোনো তথ্য দিচ্ছে না, মালিক কে, সেটাও বলছে না।

নথি জালিয়াতিতে স্থানীয়দের পাশাপাশি উঠে এসেছে খাগড়াছড়ি সদর, দীঘিনালা, মাটিরাঙ্গা উপজেলা, চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলার বাসিন্দাদের নাম। ভূমি অফিসের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করে ভূমি ক্রয় ও বায়নার কথা স্বীকার করেছেন তাদের কেউ কেউ।

ভূমি জালিয়াতির তির রামগড় ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার জাহাঙ্গীর আলমের দিকে। রামগড় উপজেলা পরিষদের কর্মচারী মাহমুদুল হাসান ও স্থানীয় বাসিন্দা সুমন ধরকে কীভাবে ভূমির মালিক হয়েছে, তা অকপটে স্বীকার করেছেন।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা কানুনগো দেলোয়ার হোসেন কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়টার সঙ্গে আমি জড়িত না। আমি শুধু মাঠ পর্যায়ে জরিপের কাজ করছি। কোনো টাকাপয়সা আমি খাইনি। তবে কোনো ধরনের তথ্য বা এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কোনো কর্মকর্তা বা সার্ভেয়ার।

সেভেন স্টার গ্রুপের সদস্য মোস্তাফা রাইটার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি এতে জড়িত না। টাকা উত্তোলনের বিষয়ে তিনি তার নাম নেই বলে দাবি করেন। তবে তিনিও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এ মামলায় আসামি হয়েছেন বলে দাবি করেন। অন্য সদস্যরা ফোন রিসিভ না করায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এ ব্যাপারে রামগড় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কারবারি যুগান্তরকে বলেন, রামগড়ে স্থলবন্দর নির্মাণকে কেন্দ্র করে সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে নানা অভিযোগ আসছে। এখানে কোনো অসাধু ব্যক্তিকে সুবিধা দেওয়া হবে না। যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত ভূমির মালিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। ভূমি অফিসের কেউ যদি এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকে, তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ ব্যাপারে খাগড়াছড়ি জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ফেরদৌসী বেগম যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে অনেকে আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সময়মতো অভিযোগকারীদের ডাকা হবে। তিনি আরও বলেন, এখনো মাঠ পর্যায়ে সার্ভেয়ার ও কানুনগোরা কাজ করছে। ঠিক এ সময় কোনো টাকা উত্তোলন করতে পারার কথা নয়। যদি কোনো টাকা উত্তোলন হয়ে থাকে, সেটা তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সরকারি একটা টাকাও আত্মসাৎ করার সুযোগ পাবে না কেউ। সেভাবে প্রশাসন কাজ করছে। হয়তো অনেকে অনেক কথা এখন বলতে পারে।

LEAVE A REPLY