আগামীর তারকা আলভারেজ

ছবি: সংগৃহীত

ক্রোয়েশিয়াকে ৩-০ গোলে হারিয়ে ২০১৪ সালের পর আবারো বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে উঠেছে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের বিপক্ষে হারের পর যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে আলবিসেলেস্তেরা, তা দেখে আর কোনো প্রতিপক্ষই তাদের নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে না। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে সব থেকে বেশি নজর কেড়ে নেয়া খেলোয়াড় হলেন হুলিয়ান আলভারেজ। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে মেসির কাছ থেকে দুটো পাস পেয়ে দুটো গোল করে যিনি এখন শিরোনামে।

আলভারেজের জন্মস্থান ক্যালচিন, কর্ডোবা, আর্জেন্টিনা। তিনি আর্জেন্টিনার জাতীয়তা ধারণ করেন। একইভাবে তার ধর্ম ক্যাথলিক এবং তার জন্ম তারিখ ২০০০ সালের ৩০ জানুয়ারি। তার বাবার নাম গুস্তাভো আলভারেজ এবং মায়ের নাম মারিয়ানা আলভারেজ। তিনি তার ভাইদের সঙ্গে বড় হয়েছেন। দুই ভাই রাফেল এবং আগু আলভারেজ। তিনি রিভেরা ইন্দারতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন।

আলভারেজের গল্পের শুরুটা করডোবার স্থানীয় এক ফুটবল স্কুলে, হুগো রাফায়েল ভারাসের হাত ধরে। ওই ভদ্রলোক বিখ্যাত কোচ নন, মূলত পিৎজা ও রুটি বিক্রি করে বেড়াতেন, পাশাপাশি চালাতেন ছোট একটা ফুটবল স্কুল। ওই স্কুলেই আলভারেজের হাতেখড়ি। একটু একটু করে বেড়ে উঠতে লাগলেন আলভারেজ। বুঝে নিলেন প্রিয় শিষ্যটিকে আরেকটু বড় আঙিনায় ছেড়ে দেয়ার সময় হয়েছে। আথলেটিকো কালচিন ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, তাদের যুব দলে ঢুকিয়ে দিলেন। আলভারেজের সামনের আঙিনা বড় হতে থাকল।

আলভারেজের পরিবারের সবাই মেসির ভক্ত। শৈশব থেকে মেসির খেলা দেখা বড় হয়েছেন। বাড়ির সদস্যরাও চাইলেন আলভারেজ ফুটবল খেলুক। ১০ বছর আগে মেসির সঙ্গে ছবি তোলার সুযোগ হয়েছিল আলভারেজের। তখন থেকেই চাইতেন আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল খেলতে ও সঙ্গে থাকুক মেসি। কাতার বিশ্বকাপে এসে সেটা পূর্ণ হলো। ২০২১ সালে জাতীয় দলে সুযোগ পান। এরপর ইকুয়েডরের বিরুদ্ধে যোগ্যতা অর্জনকারী ম্যাচে প্রথম গোলটা পান।

প্রথম পছন্দের স্ট্রাইকার মার্তিনেজের জায়গায় আলভারেজের শুরুর একাদশে থাকা অনেকের জন্যই বড় চমক হয়ে আসে। তবে ক্লাব ফুটবলে যারা তাকে দেখেছেন, তাদের জন্য হয়তো এটা স্বাভাবিকই। রিভার প্লেটে একসময় আলো ছড়ানো এই তরুণ এবার বিশ্ব মঞ্চে দিয়েছেন নিজের আগমনী বার্তা। প্রতিপক্ষের গোলমুখে আক্রমণের জাল বিছিয়ে রাখতে আলভারেজ এমনই পারদর্শী যে, রিভার প্লেটে খেলার সময় দলটির সমর্থকরা তাকে ডাকত, ‘লা আরানা’ বা ‘দ্য স্পাইডার’ বলে। ২০১৮-১৯ মৌসুমে আলভারেজ আর্জেন্টিনার ক্লাব রিভার প্লেটের হয়ে খেলা শুরু করেন। ৫ বছর আর্জেন্টিনার প্রিমিয়ার ডিভিশনে খেলেছেন। রিভার প্লেটের হয়ে ৯৬টা ম্যাচে ৩৬ গোল করেন।

১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যারাডোনা অসাধারণ এক গোল করেন। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনালে ম্যাচের ৩৯ মিনিটে যে গোলটা করলেন হুলিয়ান আলভারেজ, সেটা ম্যারাডোনাকে মনে করিয়ে দেয়। মাঝমাঠেরও নিচে নিজেদের সীমানায় পাওয়া বল নিয়ে দৌড় শুরু করেছিলেন আলভারেজ। পেছনে তিন ক্রোয়াট ডিফেন্ডার ছুটছিলেন ধাওয়া করে, সামনে আরো একজন। কাউকেই পাত্তা দিলেন না, একেবারে বক্সের ভেতর যাওয়ার পর এক ডিফেন্ডারের বাধায় বলের নিয়ন্ত্রণ একটু ছুটে গিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গেই সেটা আবার পায়ে নিয়েছেন।

তারপর আরেক ডিফেন্ডার বোরনা সোসাকে অবিশ্বাস্যভাবে কাটিয়ে গোলরক্ষকের মুখের সামনে দিয়ে শট জালে। এ রকম বাহাদুরি এই বিশ্বকাপে আর কে দেখিয়েছে। মনে রাখার মতো বেশ কিছু গোল দেখেছে এবারের বিশ্বকাপ। কিন্তু সেমিফাইনালের মঞ্চে ক্রোয়েশিয়ার মতো বলের দখল রাখা দলের বিপক্ষে মাঠের মাঝ দিয়ে একলা দৌড়ে এভাবে গোল দিয়ে আসা, এটাকে সেরা গোলের তালিকায় সবার ওপরে না রাখলে অন্যায় ভাবতে পারেন অনেকেই। এবারের বিশ্বকাপে ৫ গোল করেছেন মেসি ও এমবাপ্পে। আর ৪ গোল করে এ তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছেন জুলিয়ান আলভারেজ। মেসি ও আলভারেজের পারফরম্যান্সেই বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছে আর্জেন্টিনা।

এরপরই নেট দুনিয়ায় ঝড় তোলে দুজনের যুগলবন্দি একটি ছবি। ১০ বছর আগে তোলা সেই ছবিতে দুজনের গায়েই জাতীয় দলের জার্সি। দুজনেই একদৃষ্টে চেয়ে আছেন ক্যামেরার দিকে। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে মেসির সঙ্গে আলভারেজের নানা মুহূর্তের ছবি দেখার পর যে কারো মনে হবে, ভাগ্যের কী লীলা।

সত্যি, স্বপ্ন মানুষকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে। ইতালিয়ান সংবাদকর্মী ফ্যাব্রিজিও রোমানো তার টুইটে জানিয়েছেন, মেসির সঙ্গে এই ছবিটি ১০ বছর আগে তুলেছিলেন আলভারেজ। একজন ভক্ত হিসেবে ছবিটি তুলেছিলেন। তখন আলভারেজের বয়স ১২ বছর। অর্থাৎ আলভারেজ তখনো কোনো ক্লাবের বয়সভিত্তিক দলে যোগ দেননি। তবে সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, তখন থেকে আলভারেজ নাকি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বিশ্বকাপে মেসির সঙ্গে খেলবেন।

ম্যানচেস্টার সিটির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে এ নিয়ে আলভারেজের বক্তব্যও আছে। আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড এর আগে বলেছিলেন, ‘শৈশব থেকেই মেসি আমার আদর্শ। সে আমার পরিবারেরও আদর্শ। ভাইয়ের আদর্শ। তাই মেসি আমার কাছে নায়ক। শৈশব থেকেই স্বপ্ন দেখেছি জাতীয় দলে মেসির সঙ্গে খেলব।’

এছাড়া টুইটারে ছড়িয়ে পড়া আলভারেজের শৈশবের একটি ভিডিও দেখেও বোঝা যায়, মেসিকে তিনি কতটা পছন্দ করেন। তার স্বপ্ন কী জানতে চাওয়া হলে আলভারেজ উত্তর দেন, ‘বিশ্বকাপে খেলা।’ আদর্শ কে জানতে চাওয়া হলে এককথায় বলেন, ‘মেসি।’কেএইচ

LEAVE A REPLY