খুলনার ডুমুরিয়ায় চুইয়ের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। অনেকেই সাধারণ তরকারিতেও এই মসলা ব্যবহার করেন। ‘খুব তীব্র নয়, ঝাল ঝাল ভাব’ এটাই তরকারির স্বাদ আরো বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি এতে রয়েছে বিভিন্ন ঔষধিগুণ। জানা গেছে, ২০১২ সালে ডুমুরিয়া উপজেলার বান্ধা এলাকার অশোক বৈরাগী প্রথম ডগা কেটে মাটিতে লাগিয়ে বাণিজ্যিকভাবে চুই ঝালের চাষ শুরু করেন।
খুলনার কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি চুই মানভেদে ৩০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঈদের বাজারে এর দাম ২ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। এদিকে ২০২১-২২ সালে ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় ৬০ হেক্টর জমিতে চুইয়ের চাষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার উপপরিচালক হাফিজুর জানান।
জানা গেছে, খুলনা বিভাগের চার জেলা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইলে মোট ৯৯ দশমিক ৭ হেক্টর জমিতে চুইয়ের চাষ হচ্ছে। এর মোট উৎপাদন প্রায় ১৯০ টন। ৩ হাজার ৫৭০ জন কৃষক এসব জেলাতে চুই চাষের সঙ্গে যুক্ত।
এর আগে ২০২০-২১ সালে খুলনায় ৫৫ দশমিক ৫ হেক্টর জমিতে চুইয়ের চাষ হয়েছিল। ২০১৯-২০ সালে চাষ হয় ৪৭ হেক্টর জমিতে। ২০১৮-১৯ সালে চাষ হয় ৪১ হেক্টর জমিতে। ২০১৭-১৮ সালে চাষ হয় ৩৫ হেক্টর জমিতে।
আর খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইলে ২০২০-২১ সালে ৮৯ হেক্টর জমিতে চুইয়ের চাষ হয়েছিল। ২০১৯-২০ সালে এর পরিমাণ ছিল ৮০ হেক্টর জমিতে। ২০১৮-১৯ সালে চাষ হয় ৭৪ হেক্টর জমিতে। ২০১৭-১৮ সালে চাষ হয় ৬০ হেক্টর জমিতে।
খুলনা নগরীর গল্লামারি কাঁচাবাজারে প্রায় ৩৫ বছর ধরে চুই ঝাল বিক্রেতা শুকুর আলী বিশ্বাস জানান, রংপুর, কুড়িগ্রামের পাইকার ছাড়াও খুলনার ডুমুরিয়া, যশোরের কেশবপুর, মনিরামপুর ও বাগেরহাটের ফকিরহাট এলাকার চাষি-গৃহস্থদের কাছ থেকে চুই কিনে তার দোকানে বিক্রি করেন। আগের থেকে চাহিদা চারগুণ বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
একই বাজারের আরেক চুই ব্যবসায়ী আব্দুল গফফার বলেন, আমি ১৫ বছর ধরে বিক্রি করছি। আগের থেকে এই ঝালের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়েছে। নগরীর দৌলতপুর কাঁচাবাজারে প্রায় ৪০ বছর ধরে চুই বিক্রি করেন আবদুর শেখ। রংপুর, কুড়িগ্রামের পাইকারদের কাছ থেকে চুই কিনে বিক্রি করেন তিনি। চাহিদা বাড়ায় অনলাইনেও এখন চুইঝাল বিক্রি করছেন কেউ কেউ।
এখন বছরে চারা ও চুই বিক্রি করে ৬-৭ লাখ টাকা আয় করছেন জানিয়ে ডুমুরিয়ার অশোক বলেন, চুই সাধারণত দুই ধরনের হয়- ঝাড়চুই এবং গেছোচুই। চুইয়ের কাটিং যে কোনো হালকা উঁচু বা গাছের গোড়ায় রোপণ করা যায়। উঁচু জায়গায় চুইগাছ ভালো হয়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ও আশ্বিন-কার্তিক মাস চুইলতা লাগানোর উপযুক্ত সময়।
খুলনা বিভাগের যশোর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা জেলাতেও ব্যক্তিগত এবং বাণিজ্যিক দুভাবেই এর চাষ বাড়ছে। ঘেরের আইলেও এর চাষ করছেন কেউ কেউ। হেক্টরপ্রতি এর ফলন ২ থেকে ৩ টন। ২ থেকে ৩ শতক জমিতে চুই লাগালে ৩-৪ বছরের মধ্যে ২-৩ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব।
এক বিঘা জমিতে লাগানো যায় ৬০০-৭০০ চারা। ৫০ হাজার টাকা খরচ করলে একজন চাষি দেড় লাখ টাকার মতো চারা বিক্রি করতে পারেন। আর চারা লাগানোর এক বছর পরে চুই থেকে আয় আসে।
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর বাজারে আব্বাসের হোটেল বিখ্যাত হয়ে উঠেছে চুইঝাল দিয়ে খাসির মাংস রান্নায়। প্রতিদিন দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন এ খাবারের স্বাদ নিতে আসেন। চুইঝালের রান্না মাংস খুলনার চুকনগর, জিরোপয়েন্ট, সোনাডাঙ্গা ছাড়িয়ে এখন ঢাকায়ও প্রসার লাভ করেছে।
চুই নিয়ে খুলনা অঞ্চলের মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মোছাদ্দেক হোসেনের। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, অনেকটা পানের লতার মতো দেখতে চুই গাছের পাতায় ঝাল নেই। এর শিকড়, কাণ্ড বা লতা কেটে টুকরো করে রান্নায় ব্যবহার করা হয়। রান্নার পর কিছুটা গলে যাওয়া চুইয়ের টুকরো চুষে বা চিবিয়ে খাওয়া হয়। এর স্বাদ ঝাল তবে ঝালটার আলাদা মাদকতা আছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান জানান, চুই বর্তমানে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সম্ভাবনাময় কৃষিপণ্য। ঔষধিগুণ থাকায় এর চাহিদা ও ব্যবহার বেড়েই চলছে। খুলনা বিভাগে চুই এত জনপ্রিয় যে এটিকে খুলনার কৃষিপণ্য হিসেবে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে।কেএইচ