ছবি: সংগৃহীত
জলবায়ু পরিবর্তন ও নানা প্রতিকূলতায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও নানা প্রতিকূল পরিবেশে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। বাঘ, হরিণসহ ১৯ প্রজাতির শ্বাসমূলীয় বৃক্ষ ও ৩৩ প্রজাতির প্রাণী সুন্দরবনে কমতে শুরু করেছে। এই সম্পদকে টিকিয়ে রাখতে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি জানিয়েছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে সুন্দরবন বাঁচাতে তৎপর রয়েছে বন বিভাগ। চলতি অর্থবছরে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরার বন এলাকায় বিশেষ অভিযানে ১৪০ জনের বিরুদ্ধে ২৯২টি মামলা করা হয়েছে। এছাড়া আটক করা হয়েছে ১২১ জনকে। অন্যদিকে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা জন্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সুবিধার্থে আন্দার মানিক, আলিকান্দা, কালাবগি ও শেকের টেক এলাকায় পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। যেখানে বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার। এখানে রয়েছে বিশাল জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডার। জীববৈচিত্র্যের প্রাচুর্যের জন্য ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। আর ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেসকো সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে।
দেশের অন্তত ৫০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বে মোট ৪৮ প্রজাতির শ্বাসমূলীয় বৃক্ষ রয়েছে, যার ১৯ প্রজাতিই রয়েছে সুন্দরবনে। এমনকি বিশ্বের ৩৩ প্রজাতির বিপন্ন প্রাণী সুন্দরবনকে আশ্রয় করে টিকে আছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও নানা প্রতিকূল পরিবেশে হুমকির মুখে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষণ দেখা গেলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। সাগরে পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে সেই পানি খেয়ে বাঘ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের কোলে অবস্থিত সুন্দরবন। ভারতের ২৪ পরগনার দক্ষিণ ভাগও সুন্দরবন। পশ্চিমে ভাগীরথি নদীর মোহনা থেকে পূর্বে মেঘনার মোহনা
পর্যন্ত সুন্দরবন বিস্তৃত। ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত সুন্দরবনের ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার ভূভাগ আর ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জলভাগ। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ক্রমাগতভাবে ডুবে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, সাপ, শূকর, বানর, কাঠবিড়ালি, বাজপাখি ও শকুনসহ বিভিন্ন পশুপাখি বিলুপ্তির পথে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঘন ঘন ছোট-বড় সাইক্লোন, নদনদীতে পলি জমে যাওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তন ও গাছপালা মারা যাওয়ার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই সুন্দরবনের চেহারা বদলে গেছে।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০০৯ সালের ২৪ মে জলোচ্ছ্বাস আইলা উপকূলীয় সুন্দরবনকে তছনছ করে দিয়ে যায়। সৌন্দর্যবৃদ্ধি এবং প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী বনসম্পদের বিরাট ক্ষতি হয়েছে। কাছে অতীতের যে কোনো দুর্যোগের চেয়ে ওই দুটি আঘাত ছিল নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। তাতে সুন্দরবনকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা মূল্যবান গাছ পরিচর্যার কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা আয় হচ্ছে সুন্দরবন থেকে। গাছ কাটা, মাছ ধরা ও মধু আহরণসহ সুন্দরবনকে ঘিরে অসংখ্য উপকূলীয় মানুষের জীবনজীবিকা নির্ভরশীল। অথচ অনন্য সম্পদ সুন্দরবনকে রক্ষায় ভূমিকা বরাবরই অনুপস্থিত।
সুন্দরবনের ক্ষতি ছাড়াও উজান থেকে অভিন্ন নদনদীর পানি প্রত্যাহারের ফলে গড় উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর ও পূর্বাঞ্চল এবং মধ্যভাগসহ গোটা বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যে নেমে আসছে ভয়াবহ বিপদ জলবায়ু ও ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তন। পানি প্রতিবন্ধকতা ক্রমেই এতটা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে যে, খরা ও মরুকরণ প্রবণতা বাড়ছে। মানুষের জীবন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে নদনদীর। জলবায়ু ও ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তনে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতি বছর উপকূলীয় অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। নদী ভাঙনে উদ্বাস্তু হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ।
পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিন্ন নদ-নদীর পানি প্রতিবন্ধকতায় নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদী ও জলাশয়গুলো শুকিয়ে যাচ্ছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসার ড. মাহমুদ হোসেন বলেন, সুন্দরবন প্রকৃতিগতভাবে অভিযোজন ক্ষমতায় সক্ষম। তারপরও মনুষ্য সৃষ্ট বেশ কিছু তৎপরতা নানাভাবে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, সুন্দরবনে চোরকারবারিদের যে তৎপরতা তাতে বন্যপ্রাণি এবং বিশেষ করে হরিণ, বাঘসহ বেশ কিছু প্রাণির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা বন্ধে বন বিভাগ নানা কর্মপন্থা নিয়েছে। তবে সন্নিহিত এলাকার জনগোষ্ঠী এবং যারা বিভিন্ন কাজে বনে যান তাদের দায়দায়িত্ব বেশি। এক্ষেত্রে আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ ও জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং মানসিক পরিবর্তন জরুরি। প্রফেসার ড. মাহমুদ হোসেন আরো বলেন, সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ নিধন এক বড় সমস্যা।
এর ফলে কেবল মাছ নয়, অন্যান্য জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্যও তা ক্ষতিকর। এ অবস্থায় সুন্দরবনের যে সব নৌযান প্রবেশ করে তা তল্লাশি করা দরকার। একই সঙ্গে বিষ দিয়ে মাছ ধরার অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। কোনো অবস্থাতেই যেন সুন্দরবনে কেউ বিষ বা ক্ষতিকর কীটনাশক নিয়ে প্রবেশ করতে না পারে। তিনি বলেন, সুন্দরবনকে নিরাপদ রাখতে হলে, ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে হলে মনুষ্য সৃষ্ট যে সমস্যাগুলো সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, ব্যবস্থাপনাকে আরও যুগোপযোগী করা, বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, বন রক্ষায় জনবল বৃদ্ধি, বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনা এবং সন্নিহিত জনগোষ্ঠীর বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা জরুরি বলেও মনে করেন ড. মাহমুদ হোসেন।
সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কাদির বলেন, সুন্দরবন একদিকে যেমন জীববৈচিত্র্যের আধার অন্যদিকে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের রক্ষাকবজ। তাই এটা মানুষের স্বার্থের জন্যই রক্ষা করতে হবে।
তিনি বলেন, সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে একশ কিলোমিটার দূরে মোংলা পোর্ট সেখানে প্রতিদিন শত শত জাহাজ আসছে। এটা সুন্দরবনের জন্য চরম ক্ষতিকর।
আনোয়ারুল কাদির আরো বলেন, সুন্দরবনকে পর্যটন মন্ত্রণালয় , বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, নৌ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বেশ কিছু মন্ত্রণালয় পরিচালনা করছে। যে কারণে রক্ষণাবেক্ষণের কাজে অনেক সমস্যা হচ্ছে। সুন্দরবন রক্ষার জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। এতে সুন্দরবন সুরক্ষা অনেক সহজ হবে, সঠিক সময়ে সঠিক পরিকল্পনা করা যাবে।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ-জামান বলেন, ভৈরব নদ ও কপোতাক্ষ নদের শাখা-প্রশাখা সুন্দরবনের মিঠা পানির অন্যতম উৎস। উজানে মিঠা পানির প্রবাহ না থাকায় সুন্দরবনে মাথামরা রোগ দেখা দিয়েছে। ধীরে ধীরে সুন্দরী. গেওয়া, শাল, কেওড়া, বাইন, কাকড়া, পশুর, ধন্দুল ও গোলপাতাসহ উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী গ্রিন বেল্ট হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত।
তিনি বলেন, সুন্দরবনের নদী রায়মঙ্গল ও আড়পাঙ্গাসিয়াসহ ছোট-বড় দেড় সহস্রাধিক খাল ও নালা রয়েছে। যা কখনোই সংস্কার কিংবা খনন করা হয় না। সুন্দরবনের অনেক নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা সুন্দরবনকে বাঁচাতে এখনই মহাপরিকল্পনা নেয়া দরকার বলে মনে করেন এই নাগরিক নেতা।
খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, সুন্দরবন প্রকৃতিগতভাবেই সৃষ্টি, প্রকৃতিই এর রক্ষক। এটা কখনো ধ্বংস হয়ে যাবে না। তারপরও সুন্দরবন ও এর জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ জায়গা অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কয়েকটি ডলফিন অভয়াশ্রমও গড়ে তোলা হয়েছে। বনের মধ্যে মিষ্টি পানি সংরক্ষণে ৪টি পুকুর নতুন করে খনন করা হয়েছে, পুনর্খনন করা হয়েছে ৮০টি পুকুর। সুন্দরবন বাঁচাতে ব্যাপক তৎপর রয়েছে বন বিভাগ।
চলতি অর্থবছরে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরার বন এলাকায় বিশেষ অভিযানে ১৪০ জনের বিরুদ্ধে ২৯২টি মামলা করা হয়েছে। এছাড়া আটক করা হয়েছে ১২১ জনকে। এ ছাড়া সুন্দরবনের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা জন্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সুবিধার্থে বাগেরহাট জেলার আন্দার মানিক, আলিকান্দা এবং খুলনার কয়রা উপজেলায় কালাবগি ও শেকের টেক এলাকায় পর্যটক কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে।কেএইচ