দৃষ্টিনন্দন সড়ক
এক দশকের ভোগান্তির অবসান ঘটিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ স্থলভাগের সর্বশেষ ঠিকানা শাহপরীর দ্বীপ। এটি পর্যটননগরী কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের একটি বড় গ্রাম। বঙ্গোপসাগর আর মিয়ানমারের সীমান্ত ঘেঁষে নাফ নদীর মোহনা, সর্বদক্ষিণে নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যরে সমৃদ্ধ জনপদ এই শাহপরীর দ্বীপ। জনশ্রুতি রয়েছে- সম্রাট শাহ সুজার ‘শাহ’ এবং তার স্ত্রী পরী বানুর ‘পরী’ মিলিয়ে নামকরণ করা হয় এ দ্বীপের।
৪০ হাজারের বেশি মানুষের বসতি এ দ্বীপে। সড়ক পথে উপজেলা সদরের সঙ্গে দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। ২০১২ সালের জুন মাসে দ্বীপের পশ্চিমের বেড়িবাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি ঢুকে যাতায়াতের প্রধান সড়কটির কয়েক কিলোমিটার অংশ ভেঙে যায়। তখন থেকে জোয়ার-ভাটার বৃত্তে বন্দি হয়ে পড়ে দ্বীপবাসী। সড়ক বিলীন হয়ে সাবরাং হারিয়াখালী থেকে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ৫ কিলোমিটারের বেশি ভঙ্গুর রাস্তা পাড়ি দিতে হতো পায়ে হেঁটে এবং নৌকায়। দীর্ঘ এক দশক সীমাহীন ভোগান্তিতে কেটেছে দ্বীপের মানুষের যাতায়াতে। এসময় শিশু, বৃদ্ধ, রোগী ও নারীদের সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।
টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপের মানুষের এই দুর্ভোগ লাঘবে ৫ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের জন্য ২০১৮ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় কমিটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেন। টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জে কে এন্টারপ্রাইজ সড়কটির কাজ পায়। গত ২০২০ সালে শুরু করা সড়কের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। জোড়া লেগেছে শাহপরীর দ্বীপ সড়কের দুই প্রান্ত। সড়কটি এরই মধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজারের এসে তা উদ্বোধন করেন।
শাহপরীর দ্বীপ সড়ক সংস্কার প্রকল্পের ঠিকাদার ও জে কে এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আব্দুল জব্বার চৌধুরী বলেন, শাহপরীর দ্বীপ সড়কটি যে অবস্থায় ছিল, দেখতে মনে হয়েছিল যেন ধ্বংসস্তূপ। এখানে কাজ করা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার ছিল। তারপরও এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ সময়ের ভোগান্তির কথা ভেবে কাজটি নিয়েছি। আল্লাহর অশেষ কৃপায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পেরে খুশি লাগছে। আয়তনে কম হলেও সড়কটি এখন দেশের অন্যতম একটি দৃষ্টিনন্দন ও পর্যটক-আকর্ষণী সড়ক। প্রতিদিন এ সড়ক দেখতে এখন এলাকার লোকজন ও পর্যটকরা ভিড় করেন।
দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময়ের ভোগান্তির অবসান ঘটিয়ে সড়কপথে যাতায়াত শুরু হওয়ায় দ্বীপবাসীর খুশির শেষ নেই। বিশেষ করে গত কুরবানির ঈদের আগে যোগাযোগে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে দৃষ্টিনন্দন সড়কটি। প্রতিদিন শত শত মানুষ সড়কের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে আসেন। অনেক যাত্রী গাড়ি থেকে নেমে ছবি তোলেন। সড়কটিকে এ অঞ্চলের কিশোরগঞ্জের মিঠাইন বা পদ্ম সেতুর সংযোগ সড়ক বলছেন অনেকে।
শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা ও টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাস্টার জাহেদ হোসেন বলেন, সড়কটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর দ্বীপের মানুষের প্রতি ভালোবাসার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এক সময় দ্বীপের মানুষ বেড়িবাঁধ ভেঙে অরক্ষিত এবং বিলীন সড়ক নিয়ে চরম ভোগান্তিতে ছিলেন। বর্তমানে বেড়িবাঁধ হয়েছে এবং যোগাযোগের প্রধান সড়কটিও সংস্কার হয়েছে। গ্রামীণ জনপদে সরকারের এমন উন্নয়ন কোনো আমলে হয়নি।
স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী শরীফ হোসেন বলেন, একসময় সড়কের বেহাল দশার কারণে সাগর থেকে ধরা মাছ অন্যত্র পরিবহন করতে না পারায় তা পচে যেত। আমরা ১০ বছর পর্যন্ত এ ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। বর্তমানে সড়ক জোড়া লেগেছে। অনায়াসে আমাদের পণ্য সরাসরি চট্টগ্রাম বা ঢাকায় নিয়ে যেতে পারছি।
দ্বীপের সত্তরোর্ধ্ব নারী মদিনা খাতুন বলেন, জীবনে ভাবিনি এ সড়ক দিয়ে ফের টেকনাফ আসা-যাওয়া করতে পারব। স্বপ্নের মতো লাগছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
এদিকে ,সড়কে যাতায়াত সুবিধা পেলেও দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দারা রাতের বেলা যান চলাচলে ঝুঁকির কথা বলছেন। সড়ক বাতি না থাকায় রাতে ডাকাতিসহ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। দ্বীপবাসী দৃষ্টিনন্দন শাহপরীর দ্বীপ সড়কের দু’পাশে সড়ক বাতি স্থাপন ও হারিয়াখালী থেকে শাহপরীর দ্বীপের মাঝামাঝি স্থানে একটি পুলিশ বক্স বসানোর দাবি জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, সড়ক বাতি বা সৌর বাতি ব্যবহার করে এটিকে আকর্ষণী করার উদ্যোগ নেয়ার জন্য উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন সভায় প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে।
কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) উপসহকারী প্রকৌশলী ক্ষীর্তি চাকমা বলেন, দীর্ঘ কয়েক বছর ভোগান্তির পর বেড়িবাঁধ সংস্কার হলে আমরা সড়ক সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছি। সাফল্যের সঙ্গে সড়কের সংস্কার কাজও সম্পন্ন হয়েছে। এটি শেখ হাসিনা সরকারের একটি অর্জন। এ সড়কের সংস্কারের মাধ্যমে টেকনাফ দক্ষিণ জনপদে উন্নয়নের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।কেএইচ