তারল্য সংকটে বিপাকে ব্যাংক

ফাইল ছবি

এখনই সমাধান না করলে সংকট আরো গভীর হবে

সংকট উত্তরণে দরকার দৃশ্যমান রাজনৈতিক অঙ্গীকার

ডলার সংকটে ঘাটতিতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত (রিজার্ভ), একের পর এক ঋণ অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারি, নানা সুবিধার পরও লাগামহীন খেলাপি ঋণ, রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা, আমানতকারীদের আস্থাহীনতাসহ নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক খাত। আর এসব কারণে তারল্য বা নগদ টাকার সংকটে ভুগছে ব্যাংকগুলো। অনেক ব্যাংক নতুন করে ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে হিমশিম খাচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি এবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোও নগদ টাকার সংকটে ভুগছে। তবে সবচেয়ে বেশি সংকটে আছে নতুন ব্যাংকগুলো। প্রায় সব ব্যাংকই সুদের হারও বাড়িয়েছে। এমনকি আমানত তুলে নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। এতে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারির প্রভাব পড়ছে ব্যাংকিং খাতে। গত কয়েক বছর ধরে আমানতে সুদের হার কম থাকার কারণেও ব্যাংকে টাকা রাখছেন না অনেকে, এমনকি সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে নিচ্ছেন টাকা। ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করা, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও তারল্য ব্যবস্থাপনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা দুর্বল শাসন ও সংস্কারের অভাবে ব্যাংকিং খাতে গভীর সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডি। ব্যাংক খাতের সংকট উত্তরণে দৃশ্যমান রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন বলে মনে করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যদি দৃশ্যমান রাজনৈতিক অঙ্গীকার না আসে তবে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, দুদক বা অর্থঋণ আদালত- কারোর পক্ষেই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতে

যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তা সবই রাজনৈতিক। যা নির্বাচনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি বলেন, ব্যাংকে খেলাপি ঋণ অব্যাহত রয়েছে। একই সঙ্গে ঋণখেলাপিদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগসুবিধা দেয়া হচ্ছে। প্রতিটা ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা রাখা কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়া নতুন নয়-ছয় সুদহার নিয়েও সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা প্রতিনিয়ত বরখেলাপ হচ্ছে। এ বরখেলাপ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেআইনি কার্যকলাপে পরিণত হচ্ছে।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, কিছু কিছু ব্যাংকের অনিয়মের কারণে এ খাতে মানুষের একটা আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। তিনি আরো বলেন, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উদাসীনতার কারণে এ সংকট তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের সঠিক প্রয়োগ করেনি। ব্যাংকিং খাতে যেসব অনিয়ম হচ্ছে, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্পষ্ট কিছু বলছে না। এসব কারণে এখানে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এখনই এর সমাধান না করলে ভবিষ্যতে সংকট আরো গভীর হবে।

দেখা গেছে, গত এক দশকে বেশ কয়েকটি ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংকসহ আরো কিছু ব্যাংকে অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও অর্থ লুণ্ঠন হয়েছে। এসব কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িত কিছু কর্মকর্তা পর্যায়ের ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা গেলেও মূলহোতাদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। যদিও এখন পর্যন্ত আটটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হয়েছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেন, সাধারণ গ্রাহকদের ব্যাংক থেকে ন্যূনতম অঙ্কের ঋণ নিতে গেলে প্রচুর কাগজপত্র জমা দিতে হয়। সেখানে ভুয়া কিংবা নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের হাতে অবলীলায় হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে তুলে দেয়া হচ্ছে। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে বিদেশে অর্থ পাচারের নির্ভরযোগ্য বহু তথ্য প্রতিনিয়ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। বিবৃতিতে বলা হয়, যখন তখন রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের মালিকানায় কিংবা শীর্ষ পদে রদবদল ব্যাংকের আমানতের অর্থ লোপাটে সহায়ক হয়। ব্যাংকের মালিকপক্ষ বা পরিচালনা পর্ষদই তখন ঋণ জালিয়াতিতে যুক্ত হয়। ক্ষমতার অপব্যবহার করে যোগসাজশের মাধ্যমে লুটপাটে জড়িত হওয়ার সুযোগও বহুগুণ বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার ড. মিজানুর রহমান তার মতামত প্রকাশ করে একটি জাতীয় দৈনিকে লিখেছেন, ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট মূলত অর্থনৈতিক। তবে তার মতে, এই পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে অনেকটা দায়ী নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের দুর্বল তদারকি। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি স্বীকার করছেন না। মিজানুর রহমান আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এ তারল্য সংকট শুধু অর্থনৈতিক সক্ষমতার ক্ষেত্রেই ঝুঁকি তৈরি করবে না, বরং এটা অর্থনৈতিক এজেন্টদের মনেও ভয় ধরিয়ে দিতে পারে এবং সামগ্রিকভাবে আর্থিক বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ক্যালেন্ডার বছরের হিসাবে বিদায়ী ২০২২ সালে রিজার্ভ থেকে মোট ১২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর বিপরীতে বাজার থেকে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি তুলে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে অভ্যন্তরীণ তারল্যের ওপর চাপ বেড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন কারণে এমনিতেই সঞ্চয়প্রবণতা কমছে। ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকের জালিয়াতির তথ্য জানাজানির পর কোনো কোনো ব্যাংকে নগদ টাকার সংকট তৈরি হয়েছে। টাকার সংকট মেটাতে আমানতের সুদহার বাড়াচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক। যদিও ঋণের সুদে ৯ শতাংশের সীমা রয়েছে।

তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমদানি ব্যয় মেটাতে ধারাবাহিকভাবে বিক্রির ফলে তা থেকে কমে ২০২২ সালের অক্টোবরে ৩৫ বিলিয়নেরও নিচে নেমে যায়। আকুর নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১১২ কোটি (১ দশমিক ১২ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করার পর গত রবিবার ৮ জানুয়ারি দিনশেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন (৩ হাজার ২৫৭ কোটি) ডলার। রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আমদানি দায় কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন এলসি (ঋণপত্র) কমলেও আগের দায় পরিশোধের চাপের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমেনি। নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে আমদানি দায় পরিশোধ বেড়েছে ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। এ সময় বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারে। বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) ৫ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। অস্থির ডলারের বাজার সুস্থির করতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই (জুলাই-ডিসেম্বর) ৭৬৫ কোটি (৭ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর আগে ছয় মাসে রিজার্ভ থেকে এত ডলার কখনোই বিক্রি হয়নি। এর প্রভাবেও কমছে রিজার্ভ।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ যাবত যত অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে স¤প্রতি ঘটে যাওয়া ঋণের নামে ৩০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাটি সবচেয়ে বড়। জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংক থেকে ১১টি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে চারটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। জামানত ছাড়া, ক্রেডিট রিপোর্ট ছাড়া, ঠিকানাহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এবং কয়েকজন পরিচালক জড়িত বলে অভিযোগ আছে।

দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এ বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকায়। শুধু এ বছরের প্রথম ছয় মাসেই খেলাপি ঋণ ২১ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা বেড়েছে। অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে এখন ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার টান পড়েছে। কিছু কিছু ব্যাংক এমন তারল্য সংকটে পড়েছে যে, কোনো কোনো গ্রাহককে একসঙ্গে ২৫ লাখ টাকা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে। বর্তমানে গ্রাহকদের আমানতের টাকা ফেরত দিতেও সমস্যায় পড়ছে কোনো কোনো ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংকে ডলারের অভাবে আমদানি কমানোর পরও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। অনেক ব্যাংকই ডলারের অভাবে এলসি খোলা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হচ্ছে।

এদিকে ব্যাংক খাতে সম্প্রতি কিছু দুর্নীতির ঘটনায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। অন্যদিকে আস্থাহীনতার কারণে মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা রাখছেন না। ফলে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে আমানত কমেছে তিন হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ব্যাংক আমানত ছিল ১৪ লাখ ৯০ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। তা নভেম্বর মাসে কমে ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে মোট আমানত কমেছে ৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ। এর মধ্যে চাহিদা আমানত বাড়লেও মেয়াদি আমানত কমেছে। এক মাসে মেয়াদি আমানত কমেছে ৪ হাজার ৪২১ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ।

আমানত তুলে নেয়ায় ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্যতেও প্রভাব পড়েছে। এক মাসে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ১৬ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর হাতে সিআরআর ও এসএলআর রাখার পর গত ২০২২ সালের নভেম্বরে অতিরিক্ত তারল্য কমে ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। অক্টোবরে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ১৬ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দেশে অধিক মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকের আমানতের ওপর একটা প্রভাব পড়েছে। মূল্যস্ফীতির ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। সঞ্চয় করার সক্ষমতা নেই। তিনি আরো বলেন, স¤প্রতি ব্যাংক খাতে অতিমাত্রায় কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এমন একটি ব্যাংকের কাছ থেকে ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, যেটা সবচেয়ে বড় একটি ব্যাংক। এসব ঘটনার কারণেও ব্যাংক খাতের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। এজন্য মানুষ আতঙ্কিত হয়ে টাকা তুলে ফেলছে। যার প্রভাব পড়েছে ব্যাংক আমানতে।এমকে শেয়ার করুন

LEAVE A REPLY