ভেজাল ওষুধের রমরমা ব্যবসা

চট্টগ্রামে পাইকারি ওষুধের সবচেয়ে বড় বাজার হাজারী গলি। এখানকার অধিকাংশ ফার্মেসিতে বিক্রি হয় অবৈধ ওষুধ। এছাড়া বিদেশি কসমেটিক্স পণ্যও বিক্রি হয়। ভেজাল ওষুধ ছাড়াও বিনামূল্যের সরকারি ওষুধ পাওয়া যায় ফার্মেসিগুলোয়।

মাঝেমধ্যেই এখানে ভেজালবিরোধী অভিযান হয়। কিন্তু তেমন ফল মিলছে না। এ কারণে বাজারটিতে নিবন্ধনবিহীন ওষুধ বিক্রি বন্ধ হচ্ছে না। তবে মঙ্গলবার জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ৪০ লাখ টাকার অনুমোদনহীন ওষুধ জব্দ হয়েছে।

যদিও এই অভিযান চালাতে গিয়ে বেগ পেতে হয়েছে আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্তদের। কারণ, অভিযানের সময় ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ করে সটকে পড়েন। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, চিকিৎসকরা রোগীর ব্যবস্থাপত্রে বিদেশি ওষুধ লেখেন বলে মুনাফার আশায় তারা এসব ওষুধ মজুত করেন।

সূত্র জানায়, মঙ্গলবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও পুলিশ হাজারী গলিতে অভিযান চালায়। এতে নেতৃত্ব দেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত ও আব্দুল্লাহ আল মামুন।

এ সময় সততা ফার্মেসি, নিয়ামত শাহ ফার্মেসি ও ক্যাল ফার্মা নামের তিনটি দোকানে ফিজিশিয়ানস স্যাম্পল পাওয়া যায়। এ কারণে দোকানগুলোকে ৮০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযানের সময় অধিকাংশ ব্যবাসয়ী তাদের দোকান বন্ধ করে সটকে পড়েন। দোকানগুলো বন্ধ থাকায় বেকায়দায় পড়তে হয় ভ্রাম্যমাণ আদালতকে।

পরে দুটি গোডাউন থেকে তালা ভেঙে বিপুল পরিমাণ অনিবন্ধিত ওষুধ জব্দ করা হয়। এসব ওষুধ ভারত, পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডের তৈরি। পরে সেগুলো নষ্ট করা হয়।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত বলেন, অভিযানে যাওয়ার পর ফার্মেসিগুলো বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা। ছবিলা কমপ্লেক্সে ঢুকতে গেলে বিপত্তি দেখা দেয়। ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ করে সড়কে অবস্থান নেন। মার্কেট কমিটি, ফার্মেসি মালিক সমিতি ও স্থানীয় নেতাদের অনুরোধ সত্ত্বেও দোকান খুলতে রাজি হননি তারা। পরে বাধ্য হয়ে তালা ভেঙে গুদামে প্রবেশ করেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ অবৈধ ওষুধ জব্দ করা হয়।

যে কারণে অভিযানের সুফল মিলছে না : নগরীর কোতোয়ালি থানার হাজারী গলি একটি গিঞ্জি এলাকা। ৭-৮ ফুট প্রশস্তের সড়কে মানুষের পাশাপাশি যানবাহনও চলাচল করে। এখানে ওষুধের পাইকারি দোকান ছাড়াও স্বর্ণালংকার তৈরির কারখানাও রয়েছে। অভিযানের সময় ওষুধ ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ করে সড়কে অবস্থান নেওয়ায় গলির একদিক থেকে অন্যদিকে মানুষ যাতায়াত করতে পারে না। এখানে স্বর্ণের গহনা তৈরির কারখানা থাকায় অধিকাংশ সময় অভিযান শেষ না করেই ফিরে যেতে হয় সংশ্লিষ্টদের।

বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতির চট্টগ্রাম শাখার তথ্যমতে, হাজারী গলির ২২ মার্কেটে প্রায় পাঁচশ ওষুধের দোকান রয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে চারশ দোকান সমিতির নিবন্ধিত। মঙ্গলবারের অভিযান শুরু হলে একের পর এক ওষুধের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে সমিতির নেতারা প্রতিষ্ঠান খুলতে অনুরোধ করলেও ব্যবসায়ীরা সেটি কর্ণপাত করেননি। পরে দুটি গোডাউনের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের লোকজন। সেখান থেকে প্রায় ৪০ লাখ টাকার অননুমোদিত ওষুধ জব্দ করা হয়।

অভিযানে অংশ নেওয়া ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন রাজু বলেন, ‘হাজারী গলিতে আমরা যে কয়টি দোকানে অভিযান চালিয়েছি, সবকটিতেই অনিবন্ধিত ওষুধ পাওয়া যায়। এসব ওষুধের প্যাকেটের গায়ে ডিএআর বা এমএ (মার্কেটিং অথরাইজেশন) নম্বর ছিল না। যে ওষুধ নিবন্ধিত নয়, সেগুলো বাজারজাত করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতির চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি সমীর কান্তি সিকদার বলেন, ‘মার্কেটের সাড়ে চারশ দোকানের মধ্যে ২০-৫০টি দোকানে অনিবন্ধিত ওষুধ বিক্রি হয়। এসব দোকান আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। আমরা তাদের আইনের হাতে সোপর্দ করার ভয়ভীতি দেখিয়ে থাকি। কিন্তু আমাদের তো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। যে কারণে অনেক সময় আমাদের কিছু করার থাকে না।’

অভিযানের সময় দোকান বন্ধ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগে হাজারী গলিতে র‌্যাব অভিযান চালিয়েছিল। সেসময় অনেক প্রতিষ্ঠানকে দুই থেকে তিন লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। এ কারণে ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে থাকেন। বিষয়টি নিয়ে বুধবার জরুরি সভা হয়েছে। সেখান থেকে যে কোনো অভিযানের সময় প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় সমিতি থেকে তাদের সদস্যপদ বাতিল করা হবে।’

অনিবন্ধিত ওষুধ বিক্রির বিষয়ে সমীর কান্তি সিকদার বলেন, ফার্মেসি সেসব ওষুধ সংরক্ষণ বা মজুত করা হয়, যেগুলো চিকিৎসকরা রোগীর ব্যবস্থাপত্রে দিয়ে থাকেন। এসব ওষুধ কোথাও না পেলে রোগী বা তাদের স্বজনরা হাজারী গলিতে আসেন। চিকিৎসকরা যদি অনিবন্ধিত ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে না লেখেন, তাহলে ব্যবসায়ীরা এসব ওষুধ বিক্রি করবেন না।

LEAVE A REPLY