সে এক নতুন দেশ, আমার জীবনের এক কঠিন সময়। সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৫০ হাজার সুইডিশ ক্রোনার ব্যাংকে জমা দিতে হবে নইলে ভিসা হবে না। বড় ভাই পিএইচডি করছেন, তার কাছে অত টাকা নেই। গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছে, শুরু করলাম কাজ। সকাল, সন্ধ্যা এবং রাত শুধু কাজ আর কাজ। ১৫ মে থেকে ১৫ অগাস্ট তিন মাসের কাজের অনুমতি, পুরো সময়টি শুধু কাজ আর কাজ। দিনে মোট সময় ২৪ ঘণ্টা, কাজ করি পুরো সময়, এর মাঝে খাওয়া, ঘুম, গোসল, বিশ্বাস হবে না, হবার দরকারও নেই, তবে এটাই সত্য। কাজ করি একটি হোটেলে, সকালে নাস্তা তৈরি পরে পরিবেশন করি। তারপর হোটেলের রুম পরিপাটি করা, প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ৭ দিন কাজ। সন্ধ্যায় ম্যাকডোনাল্ড’স কাজ রাত ৮ থেকে সকাল ৩টা অবধি, এখানেও সপ্তাহে ৭ দিন কাজ। এক মাস কাজ করতেই ট্যাক্স অফিস জানতে পেরেছে। আমার নরমাল কাজের রুটিন ৮ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে কাজ ৫ দিন। গ্রীষ্মের কাজে কিছুটা ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু, সেটা যে এত পরিমাণ এটা কেউ মেনে নিতে পারছে না। শেষে ৪ জায়গাতে কাজ করি, সব মিলে আমার কাজ সপ্তাহে ২৪ ঘণ্টা এবং ঘণ্টায় যে বেতন তা মিলে ৩ মাসে ৮০ হাজার সুইডিশ ক্রোনার ইনকাম, একজন ছাত্রের জন্য এটা একটি বিশাল ব্যাপার। পড়ার খরচ, আমার খরচ সবই নিশ্চিত। চলছে জীবন তার গতিতে। মাঝে মধ্যে বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্টিতে যাই তবে নতুন বছর উপলক্ষে পার্টিতে এর আগে কখনো কোথাও যাইনি।
তিন বান্ধবী ধরেছে নতুন বছরের পার্টিতে যেতে হবে। পার্টিতে যেতে কিছু নিয়ম কানুন আছে, যেমন বয়স ১৮ এর উপরে হতে হবে, একা যাওয়া চলবে না, বন্ধু-বান্ধব থাকা লাগবে। পার্টিতে ডিনার থাকবে পরে নাচগান হবে তার জন্য টিকিট কিনতে হবে। সব কিছুরই ব্যবস্থা করা হয়েছে। শনিবার রাতে বাইরে ডিনার, তারপর নাচগান, জীবনের প্রথম জার্নি। ডিনার শেষ করলাম, বসে বসে দেখছি, নাচ গান চলছে। নিজে এখনও ফ্লোরে নাচ-গানে অংশ নেইনি। কেউ এসে জিজ্ঞেসও করছে না আমি নাচবো কিনা। নিজে কাউকে জিজ্ঞেস করবো তাও সম্ভব হচ্ছে না, ইচ্ছে করছে কিন্তু লজ্জার কারণে কিছুই হচ্ছে না। হবে না, এমনটি মন মানসিকতার কারণে আমি মনের মাঝে আটকে আছি। জীবনে এসব তো এর আগে করিনি, হঠাৎ কিভাবে সম্ভব? তিন বান্ধবীর সঙ্গে এলাম, ডিনার খেলাম, তারপর তারা ভাগছে নাচে, আছে বেশ মজার সাথে, আমার খবর কে রাখে! হঠাৎ স্লো মিউজিক শুরু হয়ে গেল, ঘড়ির কাঁটায় ১২টা বাজে।
জনপ্রিয় সুইডিশ পপ মিউজিক ব্যান্ড, আব্বার বিখ্যাত গান ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ শুরু হয়ে গেছে। বন্ধু তার বান্ধবীরে আর বান্ধবী তার বন্ধুরে জড়িয়ে ধরে মনের সঙ্গে মন আর বুকের সঙ্গে বুক লাগিয়ে নেচে চলেছে। ডিস্ক টেকের বাতি মৃদু মৃদু জলছে। আমি মনের আনন্দে না তবে, বুক ভরা জ্বালা নিয়ে বসে বসে দেখছি। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন এসে হাত ধরেই বললো আসো নাচি। ধড়ফড় গতিতে উঠে গেলাম। আমার শরীর জড়িয়ে ধরে দিব্যি মেয়েটি গানের ছন্দে সুন্দর করে শিল্পীর সঙ্গে সুরে সুর মিলিয়ে গেয়ে চলছে- ‘ক্নোজ ইওর আইস, গিভ মি ইউর হ্যান্ড ডার্লিং, ডু ইউ ফিল মাই হার্ট বিটিং, ডু ইউ ফিল দ্য সেম’। আমি তো দেখছি গানের কথার সঙ্গে শরীরের যে অবস্থা তাতে সবকিছু মিলে গেছে? তারপরও কিছুই বলার নেই, হৃদয়ে তো কত কিছু বলছে কিন্তু মুখ তো নড়ছে না। আমি তো অসাড় হয়ে গেছি, শরীর তো ঠাণ্ডা, হবার কথা গরম। মেয়েটি কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পেরেছে। অবাক! সুন্দর করে ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করলো। ‘ইজ ইট ইউর ফার্স্ট টাইম? হোয়ার আর ইউ ফ্রম’? আমি উত্তর দিতে দিতেই সে বেশ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। নতুন গান শুরু হয়েছে, ‘হ্যালো ইজ মি ইউ লুকিং ফর’ আমি মনে মনে ভাবছি খাইছে আমারে, না চাইতেই সবকিছু মিলে যাচ্ছে! এতো দেখছি মিরাকেল কিছু ঘটতে চলছে, ডাকছি আল্লাহকে, ‘হে আল্লাহ! তুমি রহমানুর রাহিম!’ কিছুক্ষণ পর স্লো মিউজিক শেষ হলো, লাইট জ্বলে উঠলো, গান থেমে গেল। থামলো না আমাদের কথোপকথন।
হ্যাই আমার নাম জুলিয়া, আমি এই শহরের মেয়ে, তুমি?
আমি বললাম- আমার নাম রহমান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
কী পড়ো, কোথায় থাকো, কতোদিন এখানে এসেছো এবং কোথা থেকে এসেছো বলতে বলতে মুখে মুখ লাগিয়ে ছোট্ট করে একটি চুমো দিয়ে জুলিয়া চলে গেল। আমার যে কিছু বলার ছিল তাও সে জানলো না শুধু প্রশ্ন করে চলে গেল। যাবার বেলায় শুধু স্মৃতিটাই রেখে গেল ফেলে। এদিকে রাত ৩টা বেজে গেছে, ডর্মিটরিতে ফিরতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডর্মিটরির দূরত্ব খুব একটা বেশি না, হাঁটতে হাঁটতে রুমে এসে কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে গেলাম। নতুন বছর নতুন চেতনা, নতুন উদ্দীপনা নিয়ে জীবন শুরু করতে হবে। এসেছি বিদেশে শিক্ষা গ্রহণ করতে সেটা ঠিক রেখে বাকি সব। অতএব গত রাতে কী হয়েছিল সেটার পিছে সময় দিলে আগামীকাল কী হবে তা নিয়ে ভাবার সময় হবে না। নতুন বছর কেন যেন ভাবনায় ঢুকল।
উইকেন্ডে যে সময়টুকু (শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে রোববার বিকাল অবধি) এ সময়কে বরং ক্রিয়েটিভভাবে কাজে লাগাতে চেষ্টা করতে হবে।
কী করা যায়! শহরে নতুন একটি ম্যাকডোনাল্ড’স ওপেন করেছে। উইকেন্ডে সারা রাতই খোলা থাকে, ভাবলাম সেখানে গিয়ে নক করি। কথা বললাম ম্যানেজারের সঙ্গে, আমি স্টকহোমে এক সামার ম্যাকডোনাল্ড’স-এ কাজ করেছি, অভিজ্ঞতা আছে। সেই সুবাদে সপ্তাহে দুইদিন কাজ হয়ে গেল বিকাল ৫টা থেকে ক্লোজিং। যে টাকা পাবো তাতে আমার ভালোভাবে চলে যাবে, সামারে গাঁধার মতো খাটতে হবে না এবং উইকেন্ডে বাইরে যাওয়ার মতো সময় থাকবে না এবং কেউ নাম ঠিকানা জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে চলে যাবে না। নিজেকে ছ্যাক খাওয়া প্রেমিক হতে হবে না, এসব ভাবনা মনের মাঝে ক্ষণিকের তরে এসে বিদায় নিয়ে চলে গেল। নিজেকে বেশ শক্ত করে গড়তে শুরু করেছি। পাশের দেশ ওয়েলস থেকে এসেছে এক বন্ধু নাম গ্রাম, থাকে একই ডর্মিটরিতে, তার সঙ্গে সব বিষয়ে আলাপ আলোচনা করি, সেদিনের রাতের ঘটনাটি জেনে সে বলেছিল ‘ওয়ান্স এ ফরেনার, ওলওয়েজ এ ফরেনার’। গ্রামের কথাটি মনে ধরেছে বেশ। একটু জিদ চেপেছে মনে, ঠিক আছে বিদেশি তার অর্থ এই নয় যার যা খুশি করবে, নিজের চারপাশে প্রতিবাদের দেয়াল গড়বো যেন ঝড়ঝাপটা এলে ভেঙ্গে না পড়ি। তারপর বাঙালি স্টাইলে প্রেম করলে কোনো লাভ হবে না এবং এ প্রেম দিয়ে কিছু হবেও না। সারাজীবন দেবদাস হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না, প্রেমের ধরণ পাল্টাতে হবে। আর লজ্জা, সে তো নারীর ব্যক্তিত্ব? সেটা কেন আমার মধ্যে ঘেষাঘেষি করবে? প্রেমে কেন জ্বালা হবে, বিরহ হবে? ভালোমতো জিদ চেপেছে, তো পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করছি নিজের ওপর কনফিডেন্স বেড়েছে অনেক, বেশ অল্প দিনের মাঝে। চাপে এবং হৃদয়ের তাপে নিজেকে শক্ত করতে পারা, এ এক নতুন চ্যালেঞ্জ, যা সত্যিই নতুন দরজা খুলে দিয়েছে বিবেকে। শনিবার রাত, ম্যাকডোনাল্ড’স-এ কাজ করছি, রাত একটা হবে, একটি মেয়ে বারগার সঙ্গে একটি কোকাকোলার অর্ডার করল। আমি দাম নিয়ে তার খাবার রেডি করে তাকে তুলে দিতেই সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ বলে খাবার নিয়ে পাশের টেবিলে বসে পড়লো। আমি পরের কাস্টমার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। খাবার শেষে মেয়েটি ফিরে এসে বলছে রহমান সরি চিনতে পেরেছো আমি জুলিয়া নতুন বছরে তোমার সঙ্গে ড্যান্স করেছিলাম। মনে মনে ভাবছি বিদেশি হতে পারি স্মৃতিশক্তি তোদের থেকে খারাপ না, তারপর বাঙালি, ক্ষমা করি তবে ভুলি না, তোরে কেমনে ভুলি!
বললাম হ্যাঁ চিনেছি, তা কেমন আছো?
বললো কাল কি তুমি ফ্রি নাকি কালও কাজ?
আমি বললাম, আমি প্রতি উইকেন্ডেই কাজ করি।
জুলিয়া বললো ঘুম থেকে কখন উঠবে?
আমি বললাম কেন?
জুলিয়া বললো বিকেলে সময় হবে কি? এক কাপ কফি খাওয়ার সময় হবে আমার সঙ্গে? আমার বাড়ি বেশি দূরে নয়, প্লিজ, রাজি হয়ে যাও। সেদিন রাতে আমার হঠাৎ চলে যাওয়াটা ঠিক হয়নি, আমি ক্ষমা চাইছি, প্লিজ ক্ষমা করে দাও।
আমি বললাম ঠিক আছে তা ঠিকানা দিয়ে যাও কাল দেখা হবে। বেশ খুশি হয়ে চলে গেল, আবারও যাবার বেলা একটু মধুর হাসির জাল মনের মধ্যে ফেলে চলে গেল। কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম এবং তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে কাজ শেষে ডর্মিটরিতে এসে ঘুমিয়ে গেলাম। মুলত কাজ করি শুক্রবার বিকেল থেকে ক্লোজিং এবং শনিবার সন্ধ্যা থেকে ক্লোজিং। রোববারের দিনে ঘুম থেকে উঠি দেরি করে পরে সন্ধ্যায় চুপচাপ করিডোরের রুমেই সময় কাটে। আজ সময়টি কাটবে জুলিয়ার বাড়িতে।
ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে দোকান থেকে একগুচ্ছ ফুলের তোড়া কিনে ঠিকানা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যেতে যেতে পথে শরতের বিকালে সবুজের মাঝে নানা রংয়ের রঙিন পাতার মিশ্রণে নিজেই কিছুক্ষণের মাঝে কবি হয়ে গেলাম। কবি কবি ভাব নিয়েই জুলিয়ার বাড়িতে ঢুকে দরজায় নক করতেই যিনি দরজা খুললেন তিনি জুলিয়া নন, তিনি জুলিয়ার মা, মিসেস হিল্লেব্রান্ডট, বাংলাদেশে তিন মাস ছিলেন। লিনলোপিং বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাকে ঢাকাতে পাঠানো হয় স্টুডেন্ট রিক্রুটিং অ্যাডভাইজার হিসাবে (১৯৮৫ সালে)। দরজা খুলেই তিনি অবাক! রহমান তুমি কী মনে করে? আমি তো হতভম্ব নিজেই, তারপরও নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললাম জুলিয়ার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। মিসেস হিল্লেব্রান্ডট তো কিছুটা বিষণ্ণ এবং অবাকও বটে মনে হচ্ছে। তারপরও জিজ্ঞেস করলেন, তুমি জুলিয়াকে চেন? বললাম, হ্যাঁ। এর মধ্যে উপর থেকে জুলিয়া এসে হাজির। জুলিয়া এতক্ষণে আমাদের কিছু কথা শুনেছে, তো সে তার মাকে উল্টো জিজ্ঞেস করলো, মা তুমি রহমানকে চেন?
উত্তরে জুলিয়ার মা বললেন, “আমার কাজই তো বিদেশি শিক্ষার্থীদের চেনা-জানা”। জুলিয়া আমাকে নিয়ে তার রুমে চলে গেল, যাবার বেলা তার মাকে বললো, মা আমাদের জন্য কফি রেডি করে ডাক দিও।
জুলিয়া আমাকে তার ঘর দেখাচ্ছে, ছোটবেলার ছবি অ্যালবাম খুলে দেখাচ্ছে, সঙ্গে বর্ণনা করছে কোথায় কখন কী ঘটেছে জীবনে।
কী প্রসঙ্গে আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম, তা তুমি তোমার মার সঙ্গে কখনো বিদেশে যাওনি?
জুলিয়া উত্তরে বললো ছোটবেলায় গিয়েছি কিন্তু এখন আর যাই না, গেলে তো বাংলাদেশ দেখা হতো। না গেলেও সমস্যা নেই, পুরো বাংলাদেশ এখন আমার সাথে।
আমি বললাম মানে?
প্রশ্ন করতেই সেই পুরনো অভ্যাস মুখে মুখ লাগিয়ে ছোট্ট একটি চুমো দিতেই নিচ থেকে জুলিয়ার মা বলে উঠলেন, কফি রেডি। নিচে নেমেই এক সঙ্গে কফি পান শেষ করতেই জুলিয়ার বাবা এসে হাজির। জুলিয়ার বাবা লিনসোপিং-এর বোরি মাস্টার। আমাদের আড্ডা বেশ ভালোই জমতে শুরু করলো। সবাই বলছে ডিনার সেরে যেন ডর্মিটরিতে যাই। একটি কথা পরিষ্কার করা দরকার। বিদায়বেলায় মুখে মুখ রেখে চুমু দেওয়াটা এ সমাজে সব সময় প্রেমের সিম্বল নয়। এটা এখানকার ট্র্যাডিশন বিশেষ করে অতি কাছের বা পছন্দের হলে এমনটি হয়ে থাকে। গভীর প্রেম বা আরো কিছু হতে হলে জানাজানি, মেলামেশার গভীরতা আরো গাঢ় হতে হবে, তা নাহলে ভুল বোঝার কারণে সম্পর্ক শুরুতেই শেষ হবার সম্ভাবনা বেশি। আবার সঠিক সময়ে যদি সিগন্যাল না ধরা যায় তাতেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কঠিন! আমার হইছে মরণ, কিছুই বুঝতে পারছি না! সবাই যখন রাজি কী করে আর কাজি, এমনটি স্বপ্ন মনে দোলা দিতে শুরু করেছে।
অন্যদিকে মিসেস হিল্লেব্রান্ডট কাজ করে বিদেশি শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাদের পরিবার বেশ অভ্যস্ত এ ধরনের বন্ধুসুলভ মেলামেশায়। তবে আমার কথা হলো যে মেয়ের মা দাওয়াত দেয়নি আমাকে, দিয়েছে মেয়ে, অতএব ঘটনা অন্যরকম কিছু একটা হবে। আমি হলাম জাতে মাতাল তালে ঠিক, তবুও বলা তো যায় না এ মেয়ের লক্ষণ কী! যাক গে, ভাবলাম সিরিয়াস ভাবে কিছু নেবার দরকার নেই, বন্ধু হয়ে ঘুরাঘুরি করলেই হলো, একেবারে একাকি থাকার চেয়ে একটি বান্ধবী থাকলে ক্ষতি কী।
জুলিয়া পড়ে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনে, ডিপ্লোমাট হবে। তিন বছর বাকি তার প্রোগ্রাম শেষ হতে, আমার সময় লাগবে চার বছর, আমি পড়ি তখন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, ভাষা শিখতে এবং একস্ট্রা কিছু সাবজেক্ট কমপ্লিট করতে এক বছর লেগেছে। যাই হোক, রাতের ডিনার শেষে ডর্মিটরিতে ফিরতে জুলিয়া বেশ কিছুক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে প্রায় আমার রুমের কাছে এসে ফিরে গেল। যাবার বেলা আমি জুলিয়াকে বললাম- আমি তো বাংলাদেশি পোলা, মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা এমন করে হয়নি, দূর থেকে চিঠিপত্রের মাধ্যমে প্রেমপ্রীতি করার একটু-আধটু অভ্যাস আছে। বললাম, তোমাদের এখানে তো সরাসরি ঘটনা, আমার মনে হয় ঠিকমতো পাশ করা কঠিন হতে পারে বা ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে, তা তুমি একটু ম্যানেজ করে নিও। জুলিয়া একটু মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরে বলেছিল আমাকেও মাঝে মাঝে চিঠি দিও।
আমাদের দিনকাল খারাপ যাচ্ছে না। দেখতে দেখতে ছয় মাস পার হয়ে গেছে। জুলিয়া আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছরের জন্য একটি ভালো স্কালারশিপ পেয়েছে কিন্তু সে যেতে চাচ্ছে না। কারণ হচ্ছে আমাকে ফেলে সে যাবে না। আমার সুইডেন থেকে নড়ার কোনো সুযোগ নেই। কী আর করি! প্রেমে বড় জ্বালা। যেতে নাহি দিব তবু যেতে দিতে হবে। কথা ছিল চিঠি দিব, দেখতে দেখতে সময় পার হয়ে যাবে আমাদের মধুর মিলন হবে, কিন্তু সেটা হয়নি। জুলিয়ার আমেরিকা যাবার তিন মাস পরে আমি স্টকহোমে মুভ করি, নতুন জীবন শুরু, সময়ের সাথে সবকিছু কোথায় ফেলে এসেছি জানার সুযোগ আর হয়নি, সময়ও হয়নি।
আজ সুইডেনের বড় দিন, লিনসোপিং শহরে ঘুরতে পথে হঠাৎ থমকে গেলাম। কে সেই সুন্দরী কে? মারিয়া, আমার সহধর্মিণী জানতে চাইল। জুলিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই সে নিজ থেকে মারিয়াকে বলল- তোমার রহমানের সঙ্গে বহু বছর আগে আমার পত্রমিতালী ছিল। আমি এখন ডিপ্লোম্যাট, ছুটিতে সুইডেনে এসেছি। কল্পনায় ভাবিনি রহমানকে দেখবো লিনসোপিংয়ে।
সবাই একসঙ্গে কিছুক্ষণ কফির আড্ডাখানায় সময় কাটানোর পর ফিরে গেলাম মায়ের কাছে। আমরা আজ লিনসোপিংয়ে এসেছি মাকে দেখতে, ২০০৬ সাল থেকে আমার মা শুয়ে আছেন লিনসোপিংয়ের স্লাকা কবরস্থানে।