ধ্বংসস্তূপ ঘিরে স্বজনদের আহাজারি

তুরস্কের দশটি প্রদেশে ভূমিকম্পের ছোবলে নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়ত লাশ উদ্ধার হচ্ছে। গণকবরেও ঠাঁই নেই। মৃতদেহের স্তূপ জমেছ বিভিন্ন স্থানে। অপরদিকে ধ্বংসস্তূপ ঘিরে বাড়ছে স্বজনের বিলাপ। অনেকেই টানা ৮ দিন ধরে অপেক্ষা করছেন প্রিয় মানুষের সঙ্গে সাক্ষাতের। সেটা হোক মৃত কিংবা জীবিত।

আদিয়ামান শহরের কোনো ভবনই অক্ষত নেই। জুমহুরিয়াত মহল্লার পরপর পাঁচটি ভবন দেবে গেছে। এই ভবনগুলোতে প্রায় তিনশ লোকের বাস ছিল। এ পর্যন্ত এখান থেকে চল্লিশটির মতো মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। অপেক্ষায় আরও অনেকে। অনেকের ভিড়ে বুক চাপড়ে বিলাপ করছিলেন একটি পরিবারের চারজন সদস্য। ওই পরিবারের বিলাপের সঙ্গে শত পরিবারের কান্না একাকার হয়ে গেছে। পরিবারটির কর্তা হাসান হুসেইন বারবার মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ছিলেন। বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন বড় মেয়ে জয়নব। জয়নব জানালেন, তার মা, এক বোন, তিন ভাইসহ মোট পাঁচজন ওই ভবনের তৃতীয় তলায় ছিলেন। প্রায় ৯ দিন ধরে আমরা বিলাপ করছি, আমাদের পরিবারের সদস্যদের যেন উদ্ধার করা হয়। জানি তারা বেঁচে নেই। কিন্তু মৃতদেহ আমরা পেতে চাই। উদ্ধারকর্মীদের ভাষ্য, বহুতল ভবন হওয়ায় উপর থেকে নিচতলা পর্যন্ত যেতে তাদের বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে। কিন্তু স্বজনহারা মানুষগুলো দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক ছুটছিলেন। উদ্ধারকারী দল দেখলেই কাতর আর্তিতে বলছিলেন, আপনারা দ্রুত করুন, প্রিয় মানুষটি পচেগলে যাচ্ছে। লাশ তো বোধহয় আর খুঁজে পাব না, আপনারা দ্রুত করুন।’ উদ্ধারকারী দল জানিয়ে দিচ্ছিল আমরা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছি, অপেক্ষা করুন। কিন্তু দিশেহারা স্বজনরা একের পর এক আকুতি জানিয়ে যাচ্ছেন।

২২ বছর বয়সি দিলান, তার ভাই আব্দুল্লাহকে জড়িয়ে অনবরত কাঁদছে। বিলাপ করে বলছিলেন-তার মা, দুই ভাই, ভাবি এবং তাদের দুই সন্তান আটকে আছে। আমরা উদ্ধার কর্মীকে ভবনটি দেখিয়ে বলছি তাদের যেন উদ্ধার করা হয়। কিন্তু কেউ শুনছে না। ৯ দিন ধরে অপেক্ষা করছি। আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে জানি না। ভাই আব্দুল্লাহ বলছিল তাদের পাশের ভবনটিতে থাকা এবরো নামের এক মেয়ের সঙ্গে পরের মাসে বিয়ের কথা ছিল। হবুবধূ এবার প্রাণে বেঁচে গেলেও অঙ্গহানি অবস্থায় একটি হাসপাতালের আইসিউতে ভর্তি আছে। এবরোর মা বাবাসহ পরিবারের সাত সদস্য এখনো নিখোঁজ।

এই শহরে খানিকক্ষণ পরপরই লাশ উদ্ধার হচ্ছে। কামালপাশা সড়কের বাসিন্দা আলি এরসুত বলছিলেন, ভবন থেকে বহু মানুষের মৃতদেহ বের করা হচ্ছে, কিন্তু আমার বাবা-মাসহ পরিবারের চারজনকে এখনো পাচ্ছি না। আতঙ্কে দুচোখের পাতা এক করতে পারছে না দিদেম কায়া। আদিয়ামানের এই কিশোরী থাকেন ইস্তাম্বুলে। সেখানেই পড়াশোনা করেন। তার কথায়, ‘এখনো তো অনেক জায়গায় অনেককে জীবিত উদ্ধার করা হচ্ছে, আমার বাবা-মা, ভাই নিশ্চয়ই এখনো মরেনি, তাদের দ্রুত উদ্ধার করুন।’ এমন আর্তি শুধু দিদেম কায়ারই নয়, শত শত মানুষের। মঙ্গলবার রাতে কামালপাশা সড়ক এলাকায় একসঙ্গে পাঁচ-সাতটি লাশ উদ্ধার হয়েছে। বিশেষ কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা ওই লাশের ওপর আছড়ে পড়ছিলেন স্বজনরা। কিন্তু উদ্ধারকারী দল সেই লাশ কাউকে দেখাচ্ছিলেন না। কারণ এখন উদ্ধার হওয়া কোনো লাশই দেখানোর উপযোগী নয়।

বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্তত সত্তরটি দেশ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয়ভাবেও খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু শোকাহত মানুষরা খাবারের কথা যেন ভুলেই বসেছে। সময় যত এগোচ্ছে, লাশের গন্ধ ততই ভারী হচ্ছে। জীবিত অবস্থায় উদ্ধারের সম্ভাবনা ক্ষীণ হচ্ছে। তবে উদ্ধারকারীরা হাল ছাড়েনি। বাংলাদেশ থেকে আসা সেনাবাহিনী এবং ফায়ার বিগ্রেডের সদস্যরাও উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। পশ্চিমা দেশ থেকে আসা উদ্ধারকারী দল কুকুর এবং থার্মাল ক্যামেরা নিয়ে ধ্বংসস্তূপ এলাকার অলিগলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রাণের সন্ধানে। ইতোমধ্যে প্রশিক্ষিত একটি কুকুর মারা গেছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, ধ্বংসস্তূপ ঘিরে খেলনা পুতুল, আসবাবপত্র, ওষুধ, ইনহেলার এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে। গাড়িসহ মূল্যবান জিনিসপত্রগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ে আছে। একটি বেসরকারি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান বলছে, তুরস্কে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে আট লাখ কোটি টাকা। দেশের অন্তত ১০টি শহরে ৬৫ হাজার ভবন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। অর্ধভাঙা ও ফাটল অবস্থায় রয়েছে হাজার হাজার স্থাপনা, যা অবিলম্বে ভাঙা প্রয়োজন। উদ্ধার কাজের সঙ্গে যারা বেঁচে গেছেন, তাদের আশ্রয় ব্যবস্থায় জোর দিচ্ছে এরদোয়ান প্রশাসন। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা উদ্ধারকারী দলের বেশ কয়েকটি টিম উদ্ধার অভিযান বন্ধ করে দেশে ফিরে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস এখনো উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

ধ্বংসস্তূপ সরালেই একের পর এক মৃতদেহ বেরিয়ে আসছে। অন্যদিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। এদিকে ১০টি প্রদেশে নতুন কবরস্থান খুলেছে প্রশাসন। নতুন এই কবরস্থানে গণকবর দেওয়া হচ্ছে। ফুরিয়ে আসছে সে স্থানও। এবারে যারা বেঁচে আছেন তাদের, চিকিৎসা, আশ্রয়, মানসিক সুস্থতা, খাদ্য, শিক্ষা এসবে নজর দিতে তুরস্ক সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আদিয়ামান শহরে মঙ্গলবার সকালে জীবিত উদ্ধার হলো মুহাম্মদ জাফর চেতিন নামের ১৭ বছর বয়সি এক কিশোর। এমন অলৌকিক ঘটনায় অপেক্ষমান স্বজনদের আরও ব্যাকুল করে তোলে। সবকটি ধ্বংসস্তূপে স্বজনেরা উদ্ধারকারী দলকে বারবার তাদের আকুতি জানাচ্ছেন। তারা অধীর আশায় বুক বেঁধে আছেন।

হুলইয়া আলতিনতাশ নামের এক মহিলা বলছেন, আজ ১৭ বছর বয়সি একটি ছেলে জীবিত উদ্ধার হয়েছে। আমার দুই সন্তানের বয়স ১৫ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। নিশ্চয়ই তারা বেঁচে আছে। তাদের বের করে আনুন। এ ধরনের প্রশ্ন চাপ সৃষ্টি করছে উদ্ধার কর্মীদের।

চারটি প্রদেশ ঘুরে উদ্ধার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রদেশগুলোতে নির্মাণ করা ভবন, ভবনের ছাদ, সাধারণ ভবন ছাদের চেয়ে বেশ পুরু। একেকটি ছাদ এক ফুটের চেয়েও পুরু। ফলে ধ্বংস হওয়া ভবনগুলোর অধিকাংশই নিচের দিকে দেবে গেছে। স্থানীয় লোকজন ও স্বজনদের নির্দেশনা অনুযায়ী লাশ উদ্ধার করতে হচ্ছে। এমন গতিতে লাশ উদ্ধারসহ ধ্বংসস্তূপসহ জঞ্জাল সরাতে মাসের পর মাস লেগে যেতে পারে।

উদ্বার কাজে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর ও ফায়ার সার্ভিস টিমের লিডার লে. কর্নেল রুহুল আমিন জানান, একেকটি উপশহরে যে পরিমাণ ধ্বংসস্তূপ রয়েছে, সেগুলো উদ্ধারে অনেক সময় লাগবে। কারণ স্তূপ থেকে লাশ বের করাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া খাদ্যসামগ্রী ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করছি। আমরা ভোর থেকে রাত পর্যন্ত উদ্ধার কাজ পরিচালনা করছি। নির্দেশ অনুযায়ী অন্য প্রদেশেও যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। টিমে থাকা মেজর মুহতাসিম তাজ জানান, ‘উদ্ধারকারী দল প্রযুক্তিসম্পন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে এলেও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে দ্রুত উদ্ধার কাজ সম্পন্ন করতে পারছে না। আমরা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।’

৬ ফেব্রুয়ারি ভোর ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিলো তুরস্ক ও সিরিয়া। রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্র ছিল ৭.৮। এরপরে আফটার শকে আরও অন্তত ১২০ বার কেঁপেছে দুদেশের মাটি, যা শোকাহত, আহতদের আতঙ্কে ফেলছে। ২০২০ সালে কোভিড মহামারির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল তুরস্কও। টানা দেড় থেকে দুই বছর ধরে ভাইরাসের বলি হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। কবরস্থানগুলোতে মৃতদেহের ভিড় লেগেছিল তখনও। তুরস্কের সেই ভয়াবহ স্মৃতি যেন ফিরিয়ে দিল ভূমিকম্পের নীল ছোবল।

LEAVE A REPLY