ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার

তুরস্কে ভূমিকম্পের ১২ দিন পার হয়েছে। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়া হাজার হাজার ঘর-বাড়ি আর স্থাপনার নিচে এখনও আটকে আছে বহু মানুষ। এই ভূমিকম্প শুধু মানুষের প্রাণ নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তুরস্কের হাজার হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাসকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে ঠাঁই নিয়েছে তাঁবুতে।

খাদ্য নেই, বাসস্থান নেই। কী করে বাঁচবে সেই চিন্তায় তাদের ঘুম হারাম। খাদ্যবাহী কোনো গাড়ি দেখলেই নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ছুটে যাচ্ছেন। ইস্তাম্বুল থেকে কয়েকশ মাইল দূরের হাতায় প্রদেশটি সিরিয়ার সীমান্তঘেঁষা। এই প্রদেশের ধ্বংস হয়ে যাওয়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে ক্ষতিগ্রস্তদের হাহাকার।

প্রদেশটির আনতাকিয়া শহরের হাতায় স্টেডিয়ামের চারপাশে কয়েক হাজার মানুষকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। এখানকার অনেকেই তাদের আপনজনকে হারিয়েছেন। জীবনের সবটুকু সঞ্চয় দিয়ে কেনা ফ্ল্যাট, নির্মাণ করা ভবন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। গত এক দশকে এই প্রদেশে অসংখ্য অত্যাধুনিক বহুতল ভবন নির্মাণ হয়েছিল। কিন্তু বিধ্বংসী ভূমিকম্প সব শেষ করে দিয়েছে।

প্রদেশটি এখন অনেকটাই জনশূন্য। বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো অন্যত্র পাড়ি জমাচ্ছেন। যে ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে তার সবকটিতে ফাটল। একের পর এক ছোট্ট মাত্রার ভূ-কম্পন অনুভূত হচ্ছে। তাই ভবনগুলোর বাসিন্দা অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। যাদের অন্য কোনো প্রদেশে যাওয়ার সুযোগ নেই তারা আশ্রয় নিয়েছেন তাঁবুতে।

কয়েকটি তাঁবু ঘুরে দেখা যায়, বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদাগুলো অনুপস্থিত। তুরস্ক সরকার সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে তাদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আপনজনহারা শিশুদের তাঁবুর চারপাশে খেলতে দেখা গেছে। খাদ্য নিয়ে গাড়ি, কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ের খাবার তাঁবু এলাকায় আসতেই দৌড়ে যাচ্ছে শিশুরা। বড়রা তো আছেই। প্রয়োজনীয় জিনিসসহ ওষুধপত্রের সংকট আছে এখানে।

সীমান্তবর্তী এই প্রদেশটিতে শুক্রবার তাপমাত্রা ছিল মাইনাস এগারো ডিগ্রি, যা শিশু ও বৃদ্ধদের হুমকির মুখে ফেলছে। আনতাকিয়া শহরের বাসিন্দা কিশোরী সারাহ জানান, চার বোন ও মাকে নিয়ে এই তাঁবুতে খেয়ে না-খেয়ে আছেন। আপনজন ও প্রতিবেশী অনেককে হারিয়েছেন। চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, কিন্তু এলাকাটি ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না। তাই তাঁবু তো আছেন।

এদিকে শত শত তাঁবুর কিনারা ঘেঁষে শিশুদের অস্থায়ী খেলার জায়গা তৈরি হয়েছে। তারা খেলছে, কিন্তু চোখেমুখে শোক ও আতঙ্কের ছাপ। মধ্যবয়সি এসমা বেতুল বলেন, যে কটি প্রদেশে ভূমিকম্প তাণ্ডব চালিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হাতায়। আমার বাড়িটা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। মারা গেছে আপনজনও। এখনো অনেকে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। উদ্ধার করা যাচ্ছে না।

আনতাকিয়া ঘুরে দেখা যায়, কিছু ধ্বংসস্তূপে এখনো উদ্ধার কাজ চলমান। শুক্রবার সকাল থেকেই উদ্ধার কাজে লেগে যায় বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্ধারকারী টিম। সঙ্গে বিভিন্ন দেশের উদ্ধারকারীরাও তৎপরতা চালায়। কিন্তু প্রচণ্ড শীতের কারণে উদ্ধার কাজ ব্যাহত হচ্ছিল। ঠান্ডা, স্যানিটেশন সংক্রান্ত জটিলতার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। এই এলাকায় বহু মানুষ আশ্রয়হীন। তাদের জন্য নিরাপন পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই। ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে জানান, এখানে দুই মাসবয়সি এক শিশুকে জীবন্ত উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের বিশ্বাস ধ্বংসস্তূপে আরও বহু মানুষ জীবিত আছে।

আয়তনের দিক থেকে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত তুরস্কের ১০টি প্রদেশ বাংলাদেশের সমান। এসব প্রদেশের ৭০ শতাংশ স্থাপনা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সমানতালে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করতে হলে আরও দুই লাখ উদ্ধারকর্মী দরকার। উদ্ধার কাজের জন্য যে সব যন্ত্রপাতি দরকার, তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।

এই পরিস্থিতিতে হাতায় প্রদেশ ছেড়ে যাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। বিমান ও সড়ক পথে যাচ্ছেন তারা। সড়কগুলোর অধিকাংশ ফেটে যাওয়া যোগাযোগ প্রায় বন্ধ। তাই এগিয়ে এসেছে তুরস্কের এয়ারলাইন্সগুলো। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে টার্কিশ ও পেগাসাস এয়ারলাইন্স। ভূমিকম্প বিধ্বস্ত এলাকাগুলো থেকে নিরাপদ স্থানে সরানোর জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের বিনামূল্যে টিকিট দিচ্ছে এই দুই বিমান সংস্থা।

১৯৯৯ সালের পর তুরস্কে সবচেয়ে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয় গত ৬ ফেব্রুয়ারি। এতে হাতায় প্রদেশের ৮টি শহরের মধ্যে শুধু আনতাকিয়া ও দেফনে শহরেই মারা গেছে সাড়ে ৯ হাজার মানুষ। এখনও বহু লোক নিখোঁজ। যারা স্বজন হারিয়েছেন তাদের আর্তনাদ ও আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছে বাতাস। উদ্ধারকারীদের তারা বলছেন, আমাদের স্বজনদের অন্তত মৃতদেহটি হলেও বের করে আনুন।

LEAVE A REPLY