ইউক্রেন রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানি অব্যাহত রাখতে যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল সেটির মেয়াদে আসছে ১৮ই মার্চ শেষ হতে যাচ্ছে।
এর আগে চুক্তি নবায়ন না হলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের খাদ্য আমদানি নির্ভর দেশগুলোকে মহাসংকটের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। খবর বিবিসির।
চুক্তি নবায়নে এবার রাশিয়া নতুন শর্ত জুড়ে দেয়ায় চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। রাশিয়ার দাবি, চুক্তি নবায়ন করতে গেলে তার দেশের শস্য ও সার রপ্তানিতে বাধা দূর করতে হবে।
যুদ্ধের পর পর বাংলাদেশে প্রভাব
ইউক্রেন তার ৯০% শস্য রপ্তানি করে কৃষ্ণসাগর রুটে। এর বাইরে সমুদ্র পথে ইউক্রেনের বিকল্প আর কোন পথ নেই।
কিন্তু গত বছরের ২৪শে ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরুর পরপরই রাশিয়া কৃষ্ণসাগরে নৌ অবরোধ দিলে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। এতে বড় ধরণের সংকটে পড়ে বাংলাদেশ।
এর কারণ, মিশর ও ইন্দোনেশিয়ার পরে বাংলাদেশ ইউক্রেন থেকে গম আমদানির তৃতীয় বড় ক্রেতা।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে ৭৫ লাখ টন গমের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন করে প্রায় ১১ লাখ টন (১৫%)। বাকিটা আমদানি করতে হয়।
এরমধ্যে বছরে ২৩ লাখ টন আমদানি হয় ইউক্রেন থেকে।
কিন্তু যুদ্ধের কারণে সরবরাহ ব্যহত হওয়ায়, বাংলাদেশে গমসহ অন্যান্য খাদ্যশস্য এবং এর সংশ্লিষ্ট পণ্য যেমন আটা-ময়দা, ভোজ্য তেল, পোল্ট্রি ও বেকারি পণ্যের দামও হু হু করে বাড়তে থাকে। যুদ্ধের আগে যে প্যাকেটজাত আটার দাম কেজি প্রতি ছিল ৩২ থেকে ৩৫ টাকা সেটি এখন বেড়ে হয়েছে ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা।
আবার পোল্ট্রি ফিডের সবচেয়ে বড় উপকরণ ভুট্টার আমদানি ব্যহত হওয়ায় মুরগি ও ডিমের দামও চলে গিয়েছে নাগালের বাইরে। এতে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর আমিষের আহারে টান পড়েছে। বিশ্বের ৪২ ভাগ সূর্যমুখী তেল উৎপাদন হয় ইউক্রেনে। যার সরবরাহ ব্যহত হওয়ায় অন্যান্য ভোজ্য তেলের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে।
চুক্তির নবায়নে অনিশ্চয়তা
যুদ্ধের পর পর কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার অবরোধের কারণে ইউক্রেনের বন্দরে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত থাকা কোটি কোটি টন খাদ্যশস্য আটকা পড়ে ছিল। এতে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম দ্রুত হারে বাড়তে থাকে যার ফলে দরিদ্র দেশগুলোয় খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়।
এমন পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের বন্দরগুলো দিয়ে খাদ্যশস্য রপ্তানি স্বাভাবিক করতে গত বছরের ২২শে জুলাই রাশিয়া–ইউক্রেনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। যা কার্যকর হয় পহেলা অগাস্ট থেকে।
চুক্তির মধ্যস্থতায় ছিল জাতিসংঘ ও তুরস্ক।
ওই চুক্তির ফলে রাশিয়া কৃষ্ণসাগরে তাদের অবরোধ শিথিল করে যাতে ইউক্রেন থেকে সমুদ্রপথের নিরাপদ করিডর দিয়ে খাদ্যবাহী জাহাজ চলাচল করতে পারে। এতে অগাস্ট থেকেই ইউক্রেনের তিনটি বন্দর থেকে বাদবাকি বিশ্বে নিরাপদে খাদ্যশস্য রপ্তানির পথ খুলে যায়। গত ১৭ই নভেম্বর চুক্তিটি নবায়ন করা হয়। ওই সময় চুক্তির মেয়াদ ১২০ দিন বাড়ানো হয়েছিল। যা শেষ হবে আসছে ১৮ই মার্চে।
ইউক্রেন চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে চাইলেও, রাশিয়া চুক্তি নবায়নের ক্ষেত্রে তাদের শস্য ও সার রপ্তানিতে বাধা দূর করার শর্ত জুড়ে দিয়েছে।
রপ্তানিতে আর্থিক লেনদেন, অবকাঠামো ও বিমার ওপর নিষেধাজ্ঞায় বিশ্ববাজারে রাশিয়ার শস্য ও সার রপ্তানিতে বড় বাধার সৃষ্টি করেছে। এসব বাধা দূর করে রপ্তানির সুযোগ দিলেই তারা চুক্তিতে ফিরবে।
চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে দুই সপ্তাহের কম সময় হাতে থাকলেও এখন পর্যন্ত শর্তের বিষয়ে আলোচনা বা চুক্তি নবায়নের কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। যার কারণে ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য আমদানির ভবিষ্যৎ উদ্বেগের মুখে পড়েছে।
বাজার পরিস্থিতি নির্ভর করছে চুক্তির ওপর
বাংলাদেশের জন্য এটি বাড়তি চিন্তার বিষয়। কারণ ইউক্রেন থেকে গমের সরবরাহ ব্যহত হওয়ার পর বাংলাদেশ গম আমদানিতে ভারতের ওপর নির্ভর করছিল।
নভেম্বর মাসে ভারত গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় বাংলাদেশের জন্য এই খাদ্য শস্যের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে ইউক্রেন। ফলে এই চুক্তি নবায়ন হওয়া না হওয়ার ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশে গম ও সংশ্লিষ্ট অন্য পণ্যের বাজার পরিস্থিতি কী হবে।
কোন কারণে চুক্তি নবায়ন না হলে ইউক্রেনের বন্দর থেকে শস্যবাহী জাহাজগুলো বিভিন্ন দেশে আর যেতে পারবে না। ফলে গম, আটা, ময়দাসহ এসব পণ্যের তৈরি সব খাবারের দাম নাগালের বাইরে চলে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
আবার খাদ্য আমদানি নির্ভর দেশগুলোয় খাদ্য সংকটের ঝুঁকি সৃষ্টি হবে।
বিকল্প দেশে নজর
চলতি বসন্ত মৌসুমে ইউক্রেনে সবচেয়ে বেশি গম উৎপাদন হবে। ফলে তারাও চাইবে গমগুলো দ্রুত রপ্তানি করতে। তাই এই চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো ছাড়া আর কোন পথ নেই।
কিন্তু রাশিয়া এক্ষেত্রে যেসব রপ্তানি সুবিধা চাইছে সেক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে জাতিসংঘ ও তুরস্ক এতোটা ছাড় নাও দিতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে চুক্তির জন্য অপেক্ষা না করে বাংলাদেশ সরকারকে এখন থেকেই বিকল্প দেশ থেকে গম ও অন্যান্য খাদ্যশস্য আমদানির তৎপরতা শুরু করার পরামর্শ দিয়েছেন তুরস্কের বিশ্লেষক মুরাদ আসলান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের উচিত হবে গম বা ভুট্টা আমদানির ক্ষেত্রে বিকল্প দেশ খোঁজা। এক্ষেত্রে দক্ষিণ আমেরিকা দেশগুলো সেইসাথে উজবেকিস্তান, ইথিওপিয়া একটি ভালো উৎপাদক দেশ হতে পারে। বাংলাদেশ সরকাররে উচিত হবে সেই দেশের সরকারের সাথে আলোচনা শুরু করা। যেন তারাও বাংলাদেশের চাহিদা অনুসারে তাদের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে পারে।
তিনি বলেন, সেইসাথে গমের প্রতি নির্ভরশীলতা কমিয়ে নাহলে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ গম উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষি নীতিতে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন রয়েছে।
এর বাইরে সরাসরি রাশিয়া সরকারের থেকে গম আমদানির ওপরেও জোর দিয়েছেন এই তুর্কি বিশ্লেষক।
কিন্তু রাশিয়া থেকে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের সব ব্যাংক এলসি না খুলছে না। আবার কোন ব্যাংক এলসি খুললেও লেনদেনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেমে তা আটকে যাচ্ছে।
চুক্তির কারণে পণ্য পৌঁছাতে দেরি
ইউক্রেন-রাশিয়া চুক্তির পর থেকে বাংলাদেশে বসুন্ধরা গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, আবুল খায়ের, এস আলম, সিটি, গ্রুপসহ ১১টি শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের ১১টি জাহাজে করে ইউক্রেন থেকে গম আমদানি করছে।
কিন্তু চুক্তির একটি শর্ত মানতে গিয়ে আমদানি করা খাদ্যশস্য পৌঁছাতে জাহাজগুলোর দ্বিগুণের বেশি সময় লাগছে। যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে দামের ওপর।
খাদ্য রপ্তানির সূত্রে ইউক্রেন যেন কোনোভাবেই সাগর পথে অস্ত্র নিয়ে না আসতে পারে সেজন্য যে জাহাজে ইউক্রেন খাদ্যশস্য রপ্তানি করবে সেটি তুরস্কের ইস্তান্বুল বন্দরে এক দফা পর্যবেক্ষণ ও তল্লাশি করা হয়।
জাহাজটি ইউক্রেন বন্দরে গিয়ে মালামাল বোঝাই করার পর আরেক দফা তল্লাশি চালানো হয়। জাতিসংঘ, রাশিয়া, ইউক্রেন ও তুরস্কের প্রতিনিধিরা যৌথভাবে জয়েন্ট কো–অর্ডিনেশন সেন্টারের অধীনে এই পর্যবেক্ষণ ও তল্লাশির কাজ করে থাকে।
আমদানিকারকদের অভিযোগ, এই দুই দফায় তল্লাশির কারণে “ওয়েটিং টাইম” অনেক বেড়ে গিয়েছে, পর্যবেক্ষণের জন্য বন্দরে জাহাজের লাইন পড়ে গিয়েছে।
এই লাইনগুলো ৫/৭ দিনে শেষ হতো। কিন্তু এখন এই পর্যবেক্ষণের কারণে এক মাসের বেশি সময় লাগছে। ফলে জাহাজ আসতে সময় নিচ্ছে।
এতে জাহাজের ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দামও সমান তালে বাড়ছে।
চট্টগ্রামভিত্তিক পণ্য আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বাশার চৌধুরী বলেন, সাধারণ সময়ে আমাদের একটা জাহাজ ইউক্রেনের বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে সময় নিতো ২০-২৩ দিন। সেই জাহাজ এখন পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুই মাস লেগে যাচ্ছে। এতে আমরা সময়মত পণ্য জাহাজীকরণ করতে পারছি না। জাহাজের অতিরিক্ত ভাড়া যুক্ত হচ্ছে।
গত অগাস্টে চুক্তি কার্যকর হলে কৃষ্ণ সাগরের ওপর দিয়ে গম আমদানি শুরু হয়। কিন্তু তল্লাশি চালাতে বিলম্বের কারণে ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশে প্রথম জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায় অক্টোবর মাসে।
এদিকে রাশিয়ার পেমেন্ট সিস্টেমে প্রভাব পড়ায় পাশাপাশি ইনস্যুরেন্স ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে রাশিয়ার রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবার যুদ্ধের পর থেকেই কৃষ্ণসাগর দিয়ে চলাচলকারী জাহাজের ইনস্যুরেন্স খরচ অনেক বেড়ে গেছে।
এ কারণে রাশিয়া থেকে খাদ্যশস্য আমদানি অনিশ্চিত মনে করছেন আমদানিকারকরা। আবুল বাশার চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের সরকারের উচিত হবে রাশিয়া থেকে পণ্য আমদানি সহজ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া। অথবা তুরস্কের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে এই খাদ্যশস্য বাংলাদেশ কিনতে পারে। যদি একটি দেশের মৌলিক খাদ্য আমদানির প্রয়োজন হয় তখন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ দেয়া কথা না।
তবে অন্য বিকল্প দেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করা হলে বেশি খরচ পড়ার আশঙ্কার কথা বলছেন আমদানিকারকরা।এমকে