রক্তে জমে যাওয়া আবর্জনা পরিষ্কার করাই কিডনির কাজ। আর এই কাজ কিডনি ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গের মাধ্যমে সম্ভব নয়। মানবদেহের অতি গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গ নিয়ে লিখেছেন অধ্যাপক ডা. হারুন-আর-রশিদ, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, কিডনি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ
কিডনি কী?
মানুষের অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে কিডনি একটি। হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও মস্তিষ্কের পরই এর স্থান। যেমন ধরুন, হৃৎপিণ্ড বন্ধ হলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে মানুষের মৃত্যু হতে পারে; ঠিক তেমনি কিডনি বাদ দিলে সাত থেকে ১৪ দিনের মধ্যে মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে যেতে পারে।
মানবদেহে মোট দুটি কিডনি থাকে, আকৃতিতে অনেকটা শিমের বিচির মতো। নাভি বরাবর পেছনের দিকে মেরুদণ্ডের দুই পাশে কিডনি অবস্থান করে।
সাধারণত কিডনির কাজকে চার ভাগে ভাগ করা যায়—
♦ রক্তের মধ্যে জমে থাকা আবর্জনা পরিশোধিত করা এবং তা প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেওয়া।
♦ রক্তের পিএইচ, এসিডিটি, লবণ, ক্ষার ও পটাসিয়ামের মাঝে সমন্বয় সাধন করা।
♦ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা।
♦ হরমোন তৈরিতে সাহায্য করা।
প্রতিটি কিডনিতে আট থেকে ১২ লাখ ছাঁকনি রয়েছে। এই ছাঁকনিগুলো এতই সূক্ষ্ম যে অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না। কিডনির রক্তবাহী নল যেখানে শেষ হয়েছে, ঠিক সেখানেই শুরু হয়েছে ছাঁকনিগুলো। প্রতি মিনিটে এক লিটারের কিছু বেশি রক্ত কিডনিতে প্রবাহিত এবং ২৪ ঘণ্টায় ১৭০ লিটারের মতো রক্ত এভাবে ছাঁকনি দ্বারা পরিশোধিত হয়। এই পরিশোধিত রক্তের এক থেকে তিন লিটার ছাড়া বাকি সবটুকুই আবার শরীরে ফিরে আসে, আর এক থেকে তিন লিটার প্রস্রাব তৈরি হয়ে বের হয়ে যায়। ছাঁকনি দ্বারা রক্তের লোহিত কণিকা, শ্বেতকণিকা, অণুচক্রিকা কিছুই বের হতে পারে না।
কিডনি রোগ ও খাবার
কিডনি রোগে দৈনন্দিন পথ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এসব রোগের মধ্যে রয়েছে নেফ্রাইটিস, পাথরজনিত কিডনি রোগ, আকস্মিক কিডনি বিকল ও ধীরগতি কিডনি বিকল। যেসব পথ্য সম্পর্কে কিডনি রোগীর সচেতনতা থাকতে হবে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে পানি বা জলীয় অংশ, প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় খাদ্য, চর্বিজাতীয় খাদ্য, লবণ, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফেট, ভিটামিন ও আয়রন।
খাবারে পানি বা জলীয় অংশ
জনসাধারণের মধ্যে একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে পানি বেশি খেলে কিডনি রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আসলে এ কথার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এমন অনেক রোগী রয়েছে, যাদের বেশি পানি খেলে শারীরিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।
আমিষ অথবা প্রোটিন জাতীয় খাবার
প্রতি কেজি ওজন হিসেবে একজন সুস্থ মানুষের খাবারে কমপক্ষে ০.৫ গ্রাম আমিষ থাকা প্রয়োজন। এর চেয়ে কম হলে শরীর নানা রকম অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারে। এর ফলে শারীরিক দুর্বলতা, শরীর শুকিয়ে যাওয়া, শরীরে পানি আসা এবং সর্বোপরি শরীরে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থার ক্ষতি হয়ে বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন হতে পারে।
শর্করাজাতীয় খাবার
একমাত্র ডায়াবেটিসজনিত কারণে কিডনি অকেজো না হলে শর্করাজাতীয় খাবার নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন পড়ে না, বরং বেশি খেতে পারে রোগী।
চর্বিজাতীয় খাবার
কিডনি অকেজো রোগীর জন্য চর্বিজাতীয় খাবারে তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। অনেক সময় নেফ্রাইটিস বা নেফ্রোটিক সিনড্রোম হলে রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। এসব রোগীর খাবারেও কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।
খাবারে লবণ
প্রয়োজনের কম লবণ গ্রহণ করলে যেমন নানা রকম সমস্যা ও জটিলতা হতে পারে, বেশি লবণ খেলেও বিপর্যয় ঘটতে পারে।
পটাসিয়াম
কিডনি অকেজো হলে পটাসিয়ামের পরিমাণ বাড়তে থাকে। রক্তে পটাসিয়াম বেড়ে গেলে শরীরে মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই পটাসিয়ামযুক্ত খাবার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
ক্ষার বা বাইকার্বনেট
কিডনির কার্যকারিতা বেশি পরিমাণে লোপ পেলে শরীরে বাইকার্বনেট কমে যায়, যাকে এসিডোসিস বলা হয়। বেশি পরিমাণ কমে গেলে শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হতে পারে।
ভিটামিন ‘ডি’
স্বাভাবিক কিডনি দ্বারা যে উপাদান তৈরি হয়, তা ভিটামিন ‘ডি’কে শরীরে অস্থি গঠনে সহায়তা করে থাকে। এর অভাবে ভিটামিন ‘ডি’ কাজ করতে পারে না। ফলে অস্থিতে ক্যালসিয়ামের অভাব পরিলক্ষিত হয়, যাকে রেনাল অস্টিওম্যালেসিয়া বলা হয়।
ক্যালসিয়াম ও ফসফেট
কিডনি অকেজো হয়ে গেলে শরীরে ক্যালসিয়াম কমে যায়। ফসফেট বেড়ে যায়। বেশি হলে ফসফেট শরীরে নানারূপ উপসর্গের সৃষ্টি করে এবং প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির ক্ষতি করে থাকে।
রক্তস্বল্পতা
কিডনি অকেজো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তও ক্রমান্বয়ে কমে যায়। কিডনি যত বেশি অকেজো হবে, রক্ত তত বেশি কমতে থাকবে। ফলে কিডনি অকেজো হওয়া রোগীর চেহারা সব সময় ফ্যাকাসে থাকে। স্বাভাবিক কিডনি এরিথ্রোপয়েটিন হরমোন তৈরি করে এবং তা রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে থাকে।
ক্রিয়েটিনিনের মাত্রার গুরুত্ব
কিডনি কার্যকারিতা যাচাই করার জন্য রক্তের ক্রিয়েটিনিন নামের জৈব পদার্থ পরিমাপ করা হয়। একজন সুস্থ পুরুষের শরীরে ক্রিয়েটিনিন ১.৩ মিলিগ্রাম এবং মহিলার ১.২ মিলিগ্রাম হিসেবে স্বাভাবিক ধরা হয়। যদি এই ক্রিয়েটিনিন পুরুষের ক্ষেত্রে ১.৪ মিলিগ্রামের ওপরে তিন মাস বা ততোধিক স্থায়ী থাকে, তখন তাকে কিডনি রোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়।
দুই ধরনের কিডনি রোগ হয়ে থাকে
আকস্মিক কিডনি বিকল
যদি হঠাৎ করে কয়েক ঘণ্টা থেকে শুরু করে কয়েক দিনের মধ্যে কিডনির কার্যকারিতা দ্রুত লোপ পেতে থাকে, তখন আমরা একে আকস্মিক বা একিউট কিডনি বিকল বলে থাকি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীর প্রস্রাব কমে যায় এবং ক্রমান্বয়ে কিডনি দ্বারা প্রস্রাব তৈরি না-ও হতে পারে। আকস্মিক কিডনি বিকলের প্রধান কারণ অতিরিক্ত ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা, অতিরিক্ত বমি, শরীরে রক্তক্ষরণ, প্রসাবকালীন জটিলতা, ব্যথার ওষুধ ও অ্যান্টিবায়েটিক ব্যবহার করা। আকস্মিক কিডনি বিকল হলে রক্তের ক্রিয়েটিনিন দ্রুত বেড়ে যায়, প্রস্রাবের মাত্রা কমে যায়, প্রস্রাব দ্রুত বন্ধ হয়ে যায় এবং রক্তচাপও কমে যায়। সুতরাং দ্রুত চিকিৎসা না করলে কিডনি অকেজো হয়ে রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে। সঠিকভাবে চিকিৎসা দিলে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।
ধীরগতিতে কিডনি বিকল
যদি কিডনির কার্যকারিতা ধীরে ধীরে লোপ পায় এবং তা তিন মাসের অধিক স্থায়ী থাকে, তখন তাকে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বলে। এর প্রধান কারণ নেফ্রাইটিসজাতীয় কিডনি রোগ (৪০ শতাংশ), ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগ (৩৫ শতাংশ), উচ্চ রক্তচাপজনিত কিডনি রোগ (২০ শতাংশ), পাথরজনিত কিডনি রোগ (৩-৪ শতাংশ) এবং অন্যান্য কিডনি রোগ। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের সাধারণত কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না, শুধু রোগের ইতিহাস পর্যালোচনা করে অতীতে তার নেফ্রাইটিস, বর্তমানে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে কি না, তা যাচাই করে এবং প্রস্রাব পরীক্ষা করে দেখা হয়। প্রস্রাবে ২-৩ গ্রামের বেশি অ্যালবুমিন নির্গত হলে সেটাকে নেফ্রাইটিস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর প্রস্রাবের সঙ্গে যদি সুগার নির্গত হয়, তখন সেটাকে ডায়াবেটিস কিডনি রোগ ধরা হয়। আর যদি প্রস্রাবে ১-২ গ্রাম অ্যালবুমিন এবং তার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস না থাকে, তখন তাকে উচ্চ রক্তচাপজনিত কিডনি রোগ ধরা হয়। সুতরাং শুধু মাল্টিস্টিকিস দ্বারা দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ ধরা যেতে পারে এবং তা চিকিৎসা শুরু করা যেতে পারে।
কোথায় পাবেন চিকিৎসা?
দেশে ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এই কমিউনিটি ক্লিনিকে যদি মাল্টিস্টিকিস সরবরাহ করা যায়, তাহলে তারা প্রাথমিক পর্যায়ে সব ধরনের কিডনি রোগ, বিশেষত ডায়াবেটিস, নেফ্রাইটিস ও উচ্চ রক্তচাপজনিত কিডনি রোগ শনাক্ত করতে পারবে। রোগীদের উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে প্রেরণ করবে এবং তারা রোগীর সিরাম ক্রিয়েটিনিন নির্ণয় করে দেখবে, কিডনির অবস্থা যাচাই করবে এবং সে অনুযায়ী পরবর্তী চিকিৎসা প্রদান করবে। বর্তমানে সরকারি প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে নেফ্রোলজি বিভাগ রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে নেফ্রোলজিস্টরা কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে প্রায় ২৭০ জন নেফ্রোলজিস্ট বাংলাদেশে রয়েছেন। তবে আরো বেশি নেফ্রোলজিস্ট এবং প্রশিক্ষিত নার্সের প্রয়োজন রয়েছে।