বিকট শব্দে কাঁপল সিদ্দিকবাজার

এবার ভয়াবহ বিস্ফোরণে বিকট শব্দে কেঁপে উঠল রাজধানীর সিদ্দিকবাজার। স্মরণকালে এত বড় বিস্ফোরণ দেখেননি এই এলাকার মানুষ।

মঙ্গলবার বিকালে একটি সাত তলা ভবনের বেজমেন্ট থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত, যা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে নিচের দুটি ফ্লোরের ছাদের একাংশ ধসে পড়ে। সাইনবোর্ডসহ ভবনটির বিভিন্ন অংশ উড়ে গিয়ে সড়কের অপর পাশের স্থাপনায় মারাত্মকভাবে আঘাত হানে। উড়ে যায় পাশের ভবনের দেওয়াল।

সড়কের জ্যামে অপেক্ষমাণ বাস ও অন্যান্য গাড়ির কাচসহ বিভিন্ন অংশ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন যাত্রীরা। নিভে যায় শবেবরাত উপলক্ষ্যে রোজা রেখে ইফতারি কিনতে যাওয়া মানুষ, ব্যবসায়ী ও অনেক সাধারণ পথচারীর জীবন প্রদীপও। ব্যস্ত সড়কে কয়েক সেকেন্ডের জন্য নেমে আসে নিস্তব্ধতা। আহতদের তীব্র আর্তনাদ এবং উপস্থিত মানুষের গগনবিদারী চিৎকারে ভাঙে ক্ষণিকের সেই নিস্তব্ধতা। এরপর ফায়ার সার্ভিসসহ উদ্ধারকারী সংস্থাগুলো এসে একে একে উদ্ধার করে ২০ জনের লাশ। আহত হয়ে হাসপাতালে ছোটাছুটি করেন আরও দেড় শতাধিক মানুষ। যাদের অনেকের অবস্থা এখনো সংকটাপন্ন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিস্ফোরণের ধরন এবং ঘটনাস্থল থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তারা অনেকটাই নিশ্চিত যে বিস্ফোরণটি জমে থাকা গ্যাস থেকে হয়েছে। যদিও ভবনসংশ্লিষ্টরা শুরু থেকেই ভবনে গ্যাসলাইন থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছেন। যুগান্তরের অনুসন্ধানে ভবনটিতে একাধিক গ্যাসলাইনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। নিচতলায় স্যানিটারি মার্কেট তৈরির আগে সেখানে ‘ক্যাফে কুইন’ নামের একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। সেখানে এখনো পরিত্যক্ত একটি গ্যাসলাইন রয়েছে। ওপরের চারটি ফ্লোরের আবাসিক বাসিন্দাদের জন্য গ্যাসলাইন নেওয়া হয়েছে ভবনের পেছনের দিক দিয়ে।

এদিকে তদন্তকারীরা এখনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা নাশকতামূলক কোনো কিছু থেকে বিস্ফোরণের প্রমাণ পাননি। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল বলছে, ভবনটির বেজমেন্টের বদ্ধ কক্ষে জমে থাকা মিথেন গ্যাস থেকে ‘গ্যাস চেম্বারে’ পরিণত হয়েছিল।

এই গ্যাসের উৎস হিসাবে পয়ঃনিষ্কাশন লাইনের পাইপ লিকেজসহ সম্ভাব্য পাঁচটি কারণ নিয়ে কাজ করছেন তারা। র‌্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট বলছে, প্রাথমিকভাবে তারা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পাননি। এখানে বড় মাত্রায় বিস্ফোরণ হয়েছে। এদিকে তিতাস গ্যাসের দাবি-পাইপলাইনের গ্যাস এই বিস্ফোরণের কারণ নয়। তাহলে গ্যাসগুলো জমা হলো কীভাবে-এখন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই কাজ করছেন সবাই। ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিস চার সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে রাজউক। এর বাইরে সেনাবাহিনী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, ঢাকা জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও র‌্যাবের ডগ স্কোয়াড ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে কাজ করছে।

বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, বিস্ফোরণের পর ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ইমারতে পরিণত হয়েছে। ভবনের বেজমেন্ট ও নিচতলা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যথেষ্ট সতর্কতা নিয়ে পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। ফায়ার সার্ভিস উদ্ধারকাজ করছে। ফায়ার সার্ভিসকে পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থা সহযোগিতা করছে। বিস্ফোরণের কারণ জানতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। কেন বিস্ফোরণ হয়েছে, সেই প্রশ্নের জবাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে দেওয়া যাবে। বিস্ফোরণের কারণ খুঁজতে বিদেশি বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই বলেও মত দেন মন্ত্রী।

বিস্ফোরণের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার বিকাল পৌনে ৫টার দিকে হঠাৎ এক বিকট আওয়াজ হয়। মুহূর্তের মধ্যেই অন্ধকার হয়ে যায় পুরো এলাকা। এতে সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। মানুষ দিগ্বিদিক ছুটছিল। স্থানীয় ব্যবসায়ী এসএম মোসাব্বির যুগান্তরকে বলেন, ঘটনার সময় ইফতারি কিনতে বের হয়েছিলাম। সড়কে তখন জ্যাম ছিল। রাস্তায় অনেক মানুষ। আমার অবস্থান ছিল বিস্ফোরণস্থল থেকে ২০ গজ দূরে। এত শব্দ হয়েছে, দাঁড়ানো থেকে বসে পড়েছি। একটু পরে শুনি মানুষের চিৎকার। কাছে গিয়ে দেখি, মানুষ জবাই করা মুরগির মতো লাফাচ্ছে। ভবনটির সামনে থাকা সাভার পরিবহণের একটি বাসের গ্লাস চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। বাসটির অনেক মানুষ মারা গেছে। এটা এতটাই শক্তিশালী ছিল, সড়কের উলটো পাশের ভবনের গ্লাসও ভেঙে গেছে। বিপরীত পাশে থাকা একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারে ভবনটির একটি সাইনবোর্ড পড়ে সেখানেও আগুন লেগে ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে যায়।

গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজার থেকে সোজা দক্ষিণে ফুলবাড়িয়া পার হয়ে নর্থ সাউথ রোডের বিআরটিসি বাস কাউন্টারের পাশেই ১৮০/১ নম্বর হোল্ডিংয়ের ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির অবস্থান। স্থানীয়দের বেশির ভাগই ভবনটিকে ক্যাফে কুইন ভবন নামে চেনেন। অনেকে কুইন স্যানিটারি মার্কেট ভবনও বলে থাকেন। ভবনটির তৃতীয় তলার ওপরের চারটি ফ্লোর আবাসিক হিসাবে ব্যবহার হয়। বেজমেন্ট, প্রথম ও দ্বিতীয় তলা ব্যবহার হতো স্যানিটারি ব্যবসায়। এর ওপরের তলায় ছিল সুজুতি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অফিস।

সিদ্দিকবাজের স্থানীয় ও স্যানিটারি ব্যবসায়ী জাবেদ আহমেদ যুগান্তরকে জানান, ভবনটির বয়স ৪০-৪৫ বছর। রেজা নামের এক ব্যক্তি ভবনটির মালিক ছিলেন। এক দশক আগে তার মৃত্যুর পর তিন ছেলের পক্ষ থেকে ওয়াহিদ রেজাই ভবনটির দেখাশোনা করতেন। দুই দশক আগেও ভবনটি তিনতলা ছিল। তখন এর নিচতলায় ছিল হোটেল এবং বেজমেন্টে ছিল হোটেলের রান্নাঘর। এরপর হোটেলটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ভবনটি আরও চারতলা বাড়ানো হয়। তবে সাত তলা ভবনের পরের চারটি তলার অনুমোদন থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেননি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কেউই।

ঘটনাস্থলে দেখা যায়, বিস্ফোরণে সাত তলা ভবনটির বেজমেন্ট, প্রথম ও দ্বিতীয় তলা বিধ্বস্ত হয়েছে। পাশের আরেকটি ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশের ভবনটির নিচতলায় থাকা সালু এন্টারপ্রাইজ (বিএসপি ট্রেডার্স) নামের একটি স্যানিটারির দোকানের দেওয়াল ধসে গেছে। ভেঙে চুরমার হয়েছে দোকানে থাকা স্যানিটারি পণ্য। ক্ষতিগ্রস্ত হয় একই ভবনের ব্র্যাক ব্যাংকের অফিস। এ ভবনটিও অনেকটা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

ভবনটি পরিদর্শনে আসেন অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ আল ইমরান হোসেন। পরিদর্শন শেষে যুগান্তরকে তিনি বলেন, ভবনটির নিচে একটি কিচেন ছিল। এই কিচেন থেকে ন্যাচারাল গ্যাসের যে কানেকটিভিটি হয়েছে, সেগুলো এখনো রয়েছে। গ্যাস অ্যানালাইজার দিয়ে পরিমাপ করে দেখলাম, গ্যাসের নির্দিষ্ট লেভেল অতিক্রম করার কারণেই ঘটনাটি ঘটেছে।

উদ্ধার অভিযান : বিস্ফোরণের পর ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। শুরু হয় শ্বাসরুদ্ধকর উদ্ধার অভিযান। একের পর এক নিহত ব্যক্তির লাশ ও আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। মঙ্গলবার রাত পৌনে ১১টার দিকে স্থগিত করা হয় উদ্ধার অভিযান। কারণ হিসাবে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক দিনমনি শর্মা জানান, ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের নিচের অংশ নড়বড়ে হয়ে গেছে। ভবনের কলামগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ অবস্থায় ভূগর্ভে তৎপরতা চালালে সেটা বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে।

পরদিন বুধবার সকাল ৯টার পর থেকে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করতে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের সাত তলার বেজমেন্টে পানি জমে গেছে। সেগুলো সেচে ফেলার কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস। পাশাপাশি ভবনটির সামনে থাকা চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়া মালামালের স্তূপও সরান। এরপর বিভিন্ন সংস্থার মতামত নিয়ে দুপুর আড়াইটার দিকে শুরু হয় মূল উদ্ধার অভিযান। তখন আরও দুটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

এদিকে বেজমেন্ট থেকে দুজনের মরদেহ উদ্ধার করা হলেও আরও একজন নিখেঁনজ রয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (ঢাকা) দিনমনি শর্মা বুধবার সন্ধ্যায় বলেন, আমরা অভিযান শেষ করিনি। অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমাদের কাছে যতক্ষণ নিখোঁজের অভিযোগ থাকবে, ততক্ষণ অভিযান চলমান থাকবে। ভবনটি অনেক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকায় সতর্কতার সঙ্গে আমরা উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছি। যাতে আমাদের কর্মীদের কোনো বিপদে পড়তে না হয়।

এখন কীভাবে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন ভবনের ভেঙে পড়া দেওয়াল, গ্লাসসহ অন্যান্য ধ্বংসস্তূপ বের করে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির সহায়তায় সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এরপর নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে অভিযান পরিচালনা করা হবে।

ভবনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত : বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ভবনটি এ অবস্থায় থাকবে নাকি ভেঙে ফেলা হবে, এ ব্যাপারে আজ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মহাব্যবস্থাপক (পরিবহণ) হায়দার আলী। বুধবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক পর্যায়ে ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার একটি কমিটি আছে। এ কমিটির প্রতিনিধিরা আগামীকাল (আজ) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবেন। তারা সিদ্ধান্ত নেবেন ভবনটি রাখা যাবে নাকি ভেঙে ফেলতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আমার কাছে মনে হচ্ছে ২০ টনের ভারী যানবাহন যদি ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের সামনে দিয়ে যায়, এতে যদি ঝাঁকি লাগে, তাহলে ভবনটি ভেঙে পড়তে পারে। আমরা এরই মধ্যে পুলিশকে জানিয়েছি ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের পাশের সামনের সড়ক দিয়ে যেন ভারী যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ ভবনের পিলার, কলাম ধসে গিয়েছে, ছাদও নিচের দিকে দেবে গেছে। এসব দেখে মনে হচ্ছে ভবনটি ভেঙে ফেলতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের অবগত করেছি ভেতরে যাওয়া ঝুঁকি। আগামীকাল কমিটি যদি সিদ্ধান্ত নেয় ভবনটি ভেঙে ফেলার তাহলে সে অনুযায়ী কাজ করব।

এদিকে বুধবার সন্ধ্যায় রাজউকের তদন্ত দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জানিয়েছে, আগামী এক বছর ভবনটি ব্যবহার করা যাবে না। এর মধ্যে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ভবনটি ফিটনেস যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভবনটি ভেঙে ফেলতে হবে নাকি সংস্কার করে ব্যবহার করা যাবে।

বিস্ফোরণে সম্ভাব্য পাঁচ কারণ : বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শন শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশের সিটিটিসি ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল বলছে, জমে থাকা গ্যাস থেকেই বিস্ফোরণ হতে পারে। গ্যাসের উৎস হিসাবে সম্ভাব্য পাঁচটি বিষয়কে প্রাধান্য দিচ্ছেন তারা। সেগুলো হলো-মাটির নিচের পানির ট্যাংক, দুটি ভবনের মাঝখানের সেপটিক ট্যাংক, বিচ্ছিন্ন হওয়া কোনো গ্যাসের লাইন থেকে নির্গত গ্যাস, পয়ঃনিষ্কাশন লাইনের লিকেজ পাইপ এবং ভবনে থাকা বড় জেনারেটর থেকে উৎপন্ন গ্যাস। সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. রহমত উল্লাহ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, গ্যাসের উৎস নিয়ে কাজ করছি। কারণ ভবনটিতে জমা হওয়া গ্যাসে স্পার্কের মাধ্যমে বিস্ফোরণ হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে।

ভবনের অনুমোদন নিয়ে ধোঁয়াশা : বুধবার ভবনটি পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিচালক হামিদুর রহমান। তবে তিনতলা থেকে ভবনটি কীভাবে সাত তলা হলো, সেই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। ভবনটি আইনকানুন মেনে গড়ে তোলা হয়েছে কি না-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আজ অফিস বন্ধ। তাই ভবনটি বৈধ না অবৈধ বা কখন অনুমতি নিয়েছে, তা জানা সম্ভব নয়। ভবনটি বৈধ না অবৈধ-এমন প্রশ্ন শুনে তিনি বলেন, কাগজপত্র দেখে বলা যাবে।

রাজউকের চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা যুগান্তরকে বলেন, পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি অনুমোদিত কি না, তা জানতে নকশা তলব করা হয়েছে। নকশা যাচাই-বাছাই করে আমরা বলতে পারব ভবনটির অনুমোদন ছিল না। তিনি বলেন, বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি প্রশস্ত সড়কের পাশে অবস্থিত। স্ট্রাকচারও দেখে মজবুত ভবন বলে মনে হয়েছে। তারপরও অনুমোদিত নকশা না দেখে পরিষ্কারভাবে আমরা কিছু বলতে পারছি না। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ভবনের ফিটনেসসহ অনুমোদন সংক্রান্ত সব চিত্র বেরিয়ে আসবে।

ভবন-দোকান মালিকসহ কয়েকজন ডিবি হেফাজতে : ধসে পড়া একটি দোকানের মালিকসহ কয়েকজনকে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) বলেন, কাউকে আটক করা হয়নি। তবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমরা বাড়ির মালিক, দোকান মালিকসহ ডেকেছি। তাদের কাছে আমরা জানতে চাইব, বাণিজ্যিকের নিয়মমতো বেজমেন্টে দোকান দেওয়ার কথা না, সুয়ারেজ লাইন, সেপটিক ট্যাংক, ওয়াটার রিজার্ভার-এগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হতো কি না। কার অবহেলায় এই হতাহতের ঘটনা ঘটল, তা জানতে জিজ্ঞাসাবাদ করছি।

তিতাসের দাবি : ঢাকা শহরে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ করে তিতাস গ্যাস। ভবনটি পরিদর্শনে এসে তিতাসের পরিচালক (অপারেশন্স) ইঞ্জিনিয়ার সেলিম মিয়া দাবি করেন, পাইপলাইনের গ্যাস এই বিস্ফোরণের কারণ নয়। এই সিদ্ধান্তে আসার যুক্তি হিসাবে তিনি বলেন, ডিটেক্টর দিয়ে আমরা কোনো গ্যাসের উপস্থিতি পাইনি। একটি রাইজার পাওয়া গেছে, সেটি অক্ষত রয়েছে। এখন পর্যন্ত গ্যাসের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। যদি গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ হতো, তাহলে এখানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটত। এতেই বোঝা যায় বিস্ফোরণ অন্য কোনো গ্যাস থেকে হতে পারে।

র‌্যাবের অনুসন্ধান : বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানে অংশ নিয়েছে র‌্যাবের একাধিক টিম। র‌্যাবের বোম ডিসপোজাল ইউনিটের উপপরিচালক মেজর মশিউর রহমান বলেন, ঘটনাটি গ্যাস লাইন লিকেজ বা অন্য কোনো কারণে ঘটতে পারে। আমরা নিশ্চিত একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করছি। এখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলো পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিতভাবে বলতে পারব।

তদন্ত কমিটি : ফায়ার সার্ভিসের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সংস্থাটির পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী পাঁচ কর্মদিবস সময় দেওয়া হয়েছে তদন্তকাজ পরিচালনার জন্য।

এছাড়া বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ কি না- তা জানতে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে রাজউক। এই বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যরা বুধবার সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে কমিটি রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। রাজউক গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটির আহবায়ক করা হয়েছে সংস্থার সদস্য উন্নয়নকে। এছাড়া কমিটিতে রাজউকের আরও ২ জন এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ২ জন বিশেষজ্ঞ সদস্য রয়েছেন।

তদন্ত দাবি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের : ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এই বিস্ফোরণের ঘটনা প্রকৃত দুর্ঘটনা নাকি অন্তর্ঘাতমূলক কিছু, তার সঠিক তদন্ত প্রয়োজন। কী কারণে এমন বিস্ফোরণ, কেন এত মানুষকে প্রাণ হারাতে হলো, সেটার সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, ঢাকার সায়েন্স ল্যাব, এখন সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল। এ ঘটনাগুলো কোনো কিছুর ইঙ্গিত কি না, সেটাও গোয়েন্দাদের দেখতে হবে।

কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, কয়েক বছর আগেও দেখা গেছে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ধরেছেও। তাই সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এ ঘটনার প্রকৃত কারণ বের করতে হবে। কোনো বিস্ফোরক নাকি রাসায়নিক থেকে এ ঘটনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

জেলা প্রশাসনের সহায়তা : বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৫০ হাজার করে টাকা সহায়তা দেবে ঢাকা জেলা প্রশাসন। একই সঙ্গে গুরুতর আহত ব্যক্তিদের প্রত্যেককে ২৫ হাজার করে টাকা দেওয়া হবে। সামান্য আহত ব্যক্তিরা পাবেন ১৫ হাজার করে টাকা। মঙ্গলবার রাতে এ তথ্য জানান ঢাকা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান। তিনি বলেন, যারা গুরুতর আহত হয়েছেন, তাদের নগদ ২৫ হাজার টাকা এবং যারা সামান্য আহত হয়েছেন, তাদের ১৫ হাজার টাকা করে প্রদান করছি। এছাড়া দুর্ঘটনায় সার্বক্ষণিক সহায়তার জন্য ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে জেলা প্রশাসন একটি সহায়তা বুথ স্থাপন করা হয়েছে। এই বুথে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট, কর্মকর্তা ও স্বেচ্ছাসেবকেরা রয়েছেন।

LEAVE A REPLY