ডলার। ফাইল ছবি
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছেই। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়েনের (আকু) জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের দায় বাবদ ১ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের পর গ্রস রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমেছে। রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১১৫ কোটি ডলারে। এছাড়া অন্যান্য দেনাও শোধ করা হয়েছে। আর আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী নিট রিজার্ভ নেমেছে ২২ বিলিয়নে। আকুর দেনা পরিশোধের পর রিজার্ভ এখন গত ৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে এসেছে। ৬ বছর আগে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার অতিক্রম করেছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ক্রমাগতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমার বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে রিজার্ভ সহসা ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই। ফলে, সামনের মাসগুলোতে রিজার্ভ নিয়ে সংকটে পড়তে পারে সরকার।
এদিকে জুনের মধ্যে রিজার্ভ বাড়বে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ, রোজা ও ঈদের কারণে এপ্রিলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে পারে। আগামী কুরবানির ঈদ পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলেও মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে জুন পর্যন্ত রেমিট্যান্সের প্রভাবে রিজার্ভ বাড়াবে। তবে আমদানি ব্যয়ও বাড়তে পারে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগের কারণ রয়েছে। এ মুহূর্তে এটি একটি চলন্ত সূচক এবং এটি স্থির নয়। বরং এটির ক্রমাবনতি হচ্ছে এবং এর বাড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার পরেও আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য ঠিক রাখা যাচ্ছে না। আর রেমিট্যান্সের প্রবাহও এখনো ঋণাত্মক। এর পাশাপাশি বৈদেশিক সাহায্যের প্রবাহ কম।
তবে বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন এখনো রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব। তিনি বলেন, গত দুই বছরে বিশাল সংখ্যক মানুষ বিদেশে শ্রমিক হিসেবে পাড়ি জমিয়েছেন। এর মধ্যে ২০২২ সালে প্রায় ১১ লাখ নতুন শ্রমিক বিদেশ গিয়েছে। আগের বছর গেছে প্রায় ৬ লাখ। গত দুই বছরে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। অথচ রেমিট্যান্সের ধারা এর উল্টো। গত বছরের সেপ্টেম্বরের পর থেকে রেমিট্যান্স আসায় একটা পতন হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশে প্রতি মাসে ২০০ কোটি ডলার করে রেমিট্যান্স আসার কথা, সেখানে এটি কমে ১৫০-১৬০ কোটি ডলার করে আসছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে রেমিট্যান্সের প্রবাহ ২ দশমিক ০৩ শতাংশ কমে গিয়েছিল। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতেও রেমিট্যান্স কমেছে ২০ শতাংশ। এ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৬ কোটি ডলার। এর আগের মাসে অর্থাৎ জানুয়ারিতে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯৬ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মো. সারওয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণে গত ডিসেম্বর থেকে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স পজিটিভ হচ্ছে। গত জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে রিজার্ভের স্থিতি বেড়েছে। তবে বরাবরের মতোই আকু পেমেন্টের পর রিজার্ভ কিছুটা কমে গেছে। অন্যদিকে পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে আমদানির যে চাপ ছিল তা এখন আর নেই। এ ছাড়া ঈদ সামনে রেখে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এখন থেকে রিজার্ভ বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার মার্কেট স্থিতিশীল করতে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে এরই মধ্যে তার ফল আসতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আকু দায় পরিশোধের পর গত মঙ্গলবার দিন শেষে রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। আগের দিন সোমবার ছিল ৩২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরে আকু দায় পরিশোধের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ছিল ১ দশমিক ৩২ বিলিয়ন, মে-জুন সময়ে ছিল ১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন এবং জুলাই-আগস্টে ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরে রিজার্ভের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার।
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সেটি কমে দাঁড়ায় ৩৯ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলারে। এর পর প্রতি মাসেই রিজার্ভ কমেছে। আগস্টে ছিল ৩৯ দশমিক শূন্য ৬, সেপ্টেম্বরে ৩৬ দশমিক ৪৭, অক্টোবরে ৩৫ দশমিক ৮০ নভেম্বরে ৩৩ দশমিক ৭৮, ডিসেম্বরে ৩৩ দশমিক ৭৪, জানুয়ারিতে ৩২ দশমিক ২২ এবং আকু দায় পরিশোধ শেষে গত ৭ মার্চ রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ গত ৮ মাসে রিজার্ভ কমেছে ১০ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে স্বস্তি ফেরাতে আমদানি দায় কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে নতুন এলসি কমলেও আগের দায় পরিশোধের চাপের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমেনি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে। সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ৫ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
কোনো ব্যাংক যেন আমদানি দায় পরিশোধে ব্যর্থ না হয় সে জন্য চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ১০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর প্রভাবে রিজার্ভ কমছে। রিজার্ভের পতন ঠেকাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তহবিল থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন পেয়েছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ডলার চলে এসেছে। এতে রিজার্ভ কিছুটা বাড়লেও আগের ঋণ ও আমদানির চাপে এখনো কমতির দিকেই আছে রিজার্ভ।
রপ্তানিতেও ভাটা : বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানি আয় ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ বাড়লেও তা এর আগের তিন মাসের তুলনায় কমেছে। এর আগের ৩ মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি, ডিসেম্বর ও নভেম্বরে রপ্তানি আয় ৫০০ কোটি ডলারের বেশি হলেও ফেব্রুয়ারিতে এটি কমে ৪৬৩ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, যে পরিমাণ রপ্তানি করা হয়, পরে সেখান থেকে অনেক কাট-ছাট হয়, শর্ট শিপমেন্ট হয়, ডিসকাউন্ট দিতে হয়, বায়াররা বিল পেমেন্ট করতে দেরি করেন ইত্যাদি।
রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের আয় বাড়াতে হলে ডলারের বিনিময় হার বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তবে বিনিময় হার বাড়লে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়ার আশঙ্কা থেকে সরকার ডলারের বিনিময় হার বাড়াতে আগ্রহী নয় বলেও জানান তারা।এনজে