জাতীয় ইনসাফ কমিটি নিয়ে যা বললেন ফরহাদ মজহার

জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি বিষয়ে সংগঠনের একজন আহ্বায়ক কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহারের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে ডয়চে ভেলে। সেখানে উঠে এসেছে সংগঠনের নানা বিষয়। এ নিয়ে প্রকাশিত ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো।

দাবি, জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি (ন্যাশনাল কমিটি ফর সিভিল রাইটস) নামের সংগঠনটি তারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দশ বছর আগে।

তবে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন, নতুন সংবিধান প্রণয়নের মতো লক্ষ্যের কথা প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েই প্রশ্নের মুখে পড়েছেন তারা। মাহমুদুর রহমান মান্না মনে করেন, ‘এ সংগঠন দিয়ে কিছু হবে না।’ সংগঠনে বিএনপি নেতা শওকত মাহমুদের উপস্থিতি এবং আরো কিছু বিষয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।

ফরহাদ মজহার শুক্রবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘আমরা মানবাধিকারের দিক দিয়ে আমাদের কর্মসূচি ঠিক করেছি। রাজনৈতিক কোনো অভিপ্রায় নেই। দেশের মানুষের অধিকার-মানবাধিকার। তবে প্রয়োজন হলে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা ভবিষ্যতে মাঠে নামব।’

বৃহস্পতিবার রাতে বনানীর শেরাটন হেটেলে এক নৈশভোজের মাধ্যমে জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটির আত্মপ্রকাশের খবর জানানো হয়। সংগঠনের আহ্বায়ক ফরহাদ মজহার এবং সদস্যসচিব বিএনপি ও সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ।

২০১৩ সালে এই সংগঠনটি গঠন করা হয়েছিল বলে দাবি করা হলেও এটাই তাদের প্রথম প্রকাশ্য অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে এখনো সব প্রকাশিত হয়নি, বিশেষ করে কমিটির অন্য সদস্যদের নাম এখনো তারা জানাননি।

শওকত মাহমুদ সংগঠনের কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেন। প্রস্তাবে বলা হয়, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারকে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে তার অধীনে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। তা না হলে গত কয়েক দশকের সুবিধাবাদী সন্ত্রাসী লুটেরা শক্তিকে পরাস্ত করা যাবে না। প্রস্তাবে আরো বলা হয়, জনগণের বিজয় নিশ্চিত না করে তথাকথিত জাতীয় বা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রেখে ক্ষমতা লাভের চিন্তা খায়েশমাত্র। তাই ফ্যাসিস্ট শক্তিকে উৎখাত করে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল ছোট-বড় সব দলকে নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে।

রাজনৈতিক কোনো অভিপ্রায় নেই : ফরহাদ মজহার

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ হচ্ছে গঠনতন্ত্র ( সংবিধান) প্রণয়ন, সভা আহ্বান করে জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে নতুনভাবে গঠন করা। নতুন গঠনতন্ত্রে স্বাধীন, নিরপেক্ষ, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনের সময় সব নির্বাহী ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকবে।

জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটির দাবি, নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের পরপরই অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার পদত্যাগ করতে হবে এবং নতুন গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে নতুন জাতীয় নির্বাচন হবে। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে নতুনভাবে বাংলাদেশ গঠনের এটাই সঠিক পথ বলে মনে করে জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি।

বিএনপি নেতা শওকত মাহমুদের তুলে ধরা লিখিত প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপির জাতীয় সরকারের রূপরেখার যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বিএনপি বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্তাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলছে।

শেরাটনে জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটির নৈশভোজে শওকত মাহমুদ ছাড়া বিএনপির আর কোনো নেতা উপস্থিত ছিলেন না। কয়েকজনকে দাওয়াত দেওয়া হলেও তারা সেখানে যাননি বলে জানা গেছে। নৈশভোজে ছিলেন বিএনপির ‘মিত্র’ নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণ-অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া, জানিপপের অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী, সাবেক রাষ্ট্রদূত সাকিব আলী, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ ও গণ অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান। এ ছাড়া পুলিশের সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তাও জাতীয় ইনসাফ কমিটির রাতের আহারে অংশ নেন।

‘এই সংগঠন দিয়ে কিছু হবে না’

শুক্রবার নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা নৈশ ভোজের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছিলাম। ফরহাদ মজহার ও শওকত মাহমুদ ছাড়া আর কেউ সেখানে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য রাখেননি।’

তিনি বলেন, ‘এই সংগঠন দিয়ে কিছু হবে না। ফরহাদ মজহার যা বলেছেন সেগুলো শো আপ যে বোঝা যায় না। আর শওকত মাহমুদ যে লিখিত বক্তব্য পড়েছেন, তা অনেকটা পরিষ্কার ও পলিটিক্যাল।’

‘বিএনপির যে নির্বাচনকালীন সরকারের ধারণা, তার সাথে শওকত মাহমুদ যা বলেছেন তার পার্থক্য আছে। সেটা বিএনপি বুঝবে। কিন্তু বিএনপি তাকে এ রকম একটি সংগঠন করার অনুমতি দিয়েছে কি না সেটাই প্রশ্ন। আমরা হলে দিতাম না।’ বলেন মাহমুদুর রহমান মান্না।

তার কথা, ‘আমরা সেখানে ডিনার খেতে গিয়েছিলাম ৷খেয়ে চলে এসেছি। কোনো বক্তব্য দিইনি।’

গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘এটা অনেক ভালো একটি উদ্যোগ। তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে চায়। সেটা করলে আমিও আমার দলের কর্মীদের সেখানে পাঠাব।’

‘তারা গণ-অভ্যুত্থান, সংবিধান পরিবর্তন- এগুলোর জন্য একটি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করতে চায়। দেশের মানুষকে প্রস্তুত করতে চায়। আমি এতে অসুবিধার কিছু দেখি না।’ বলেন রেজা কিবরিয়া।

তার সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, ‘আমরা ডিনারের দাওয়াতে গিয়েছিলাম। সংগঠনের ব্যাপারে কিছু জানা ছিল না। তারা ওই অনুষ্ঠানে প্রথম যা বলেছেন তাতে সামাজিক সংগঠন মনে হয়েছে। পরে তারা গণ-আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, নতুন সংবিধান- এসব কথা বলেন। এই বক্তব্য আমার কাছে রাজনৈতিক দলের মতোই মনে হয়েছে।’

তার মতে, ‘বিএনপি নেতা শওকত মাহমুদ এখানে যে ধরনের জাতীয় সরকারের কথা বলেছেন, তার সঙ্গে বিএনপির রূপরেখার কিছু পার্থক্য আছে। কেন এই পার্থক্য এটা শওকত মাহমুদ সাহেবই বলতে পারবেন।’

নির্বাচন ও রাজনৈতিক দলের পর্যবেক্ষক হিসেবে দাওয়াত পেয়ে সেখানে গিয়েছিলেন জানিপপ-এর প্রধান অধ্যাপক ড. নামুল আহসান কলিমুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়নি এটা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন হবে। তাদের পুরনো সামাজিক সংগঠন, নির্বাচনের আগে সক্রিয়তার জানান দিতে চাচ্ছে।’

এখানে আরো কয়েকটি দলের নেতাদের দাওয়াত দেওয়া হলেও তারা যাননি বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে একজন এলডিপির প্রধান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ। তবে নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ জানান, তিনি হোটেল পর্যন্ত গিয়ে ফিরে যান, অনুষ্ঠানে ঢোকেননি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশররফ হোসেন বলেন, ‘ওই ধরনের কোনো সংগঠনের ব্যাপারে আমাদের কিছু জানা নেই। আমাদের পার্টিতে এটা নিয়ে কখনো কোনো কথা হয়নি। শওকত মাহমুদ সাহেব কেন গিয়েছেন, ওই সংগঠনের তিনি কী তা আমরা জানি না।’

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিএনপি নেতা শওকত মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেও সে চেষ্টায় সফল হওয়া যায়নি। তবে ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘আমাদের কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। আমরা যা করছি, তা হলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আপনি যদি জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়ন করতে না পারেন, তাহলে সেটা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আমরা সে জন্য গণতন্ত্র, সংবিধান পরিবর্তনের কথা বলছি।’

‘অরাজনৈতিক’ সংগঠনের সদস্যসচিব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তিনি বিএনপির মতো একটি দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট- এ বিষয়টির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করায় তিনি বলেন, ‘হতে পারে। তবে ২০১৩ সালে যখন আমরা সংগঠন করি, তখন তিনি বিএনপির কেউ ছিলেন না। আর আমাদের কর্মসূচির সঙ্গে একমত হলে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক যে কেউ যোগ দিতে পারেন। নানা দলের নানা চিন্তা থাকতে পারে। কেউ সংবিধান সংস্কার করতে চাইতে পারেন, জাতীয় সরকার নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতে পারেন। কিন্তু আমরা সংবিধানের পরিবর্তন চাই। আমাদের কর্মসূচি আমাদের মতো।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অধিকার আদায়ের জন্য যদি আমাদের রাস্তায় দাঁড়াতে হয়, সেটা ভবিষ্যতে আমরা দেখব। তবে এখন রাস্তায় নামার পরিকল্পনা নাই।’

ফরহাদ মজহার জানান, তাদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি এখনো হয়নি, তবে হবে।

সূত্র : ডয়চে ভেলে 

LEAVE A REPLY