মূল্যস্ফীতির উলটো যাত্রা

সব ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ফলে দেশে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। শহরের চেয়ে গ্রামে এ হার বৃদ্ধি পাচ্ছে বেশি মাত্রায়। এমনকি খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিও শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি। অথচ খাদ্যপণ্যের দাম শহেরই বেশি হওয়ার কথা। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের চাহিদা গ্রামে কম। ফলে এ খাতে মূল্যস্ফীতির হার গ্রাম কম হওয়ার কথা। বাস্তবে এ হার গ্রামে বেশি, শহরে কম। সব মিলে উলটো পথে যাত্রা শুরু করেছে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি। গত ফেব্রুয়ারি মাসের মূল্যস্ফীতি ও মজুরিবিষয়ক বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

মূল্যস্ফীতির হারের এই উলটো যাত্রা নিয়ে দেশের শীর্ষ স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, টাকার প্রবাহ, ঘনবসতি ও চাহিদা শহরে বেশি। একই সঙ্গে ভোগবিলাসও গ্রামের চেয়ে শহরে বেশি। এ কারণে শহরেই মূল্যস্ফীতির হার বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে গ্রামে বেশি হচ্ছে। এ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গবেষণা দরকার।

বিবিএসের গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্যে দেখা যায়, গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং শহরে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। শহরের চেয়ে গ্রামে দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।

সূত্র জানায়, সাধারণত গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম হওয়ার কথা। কারণ গ্রামের মানুষের চাহিদা কম। কর্মসংস্থান কম হওয়ার কারণে আয়ও কম। ফলে খরচও কম হয়। সবজির ভর মৌসুমে দাম কম থাকে। সেখানে পণ্যের উৎপাদন হয়, ফলে সরবরাহ বেশি থাকে। এসব কারণে গ্রামে এ হার কম হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলেছেন, গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হওয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে কি গ্রামের মানুষের আয় বেড়েছে? বাস্তবে আয় বাড়েনি। গ্রামে এখনো দারিদ্র্যের হার বেশি। এর মধ্যে অতি দারিদ্র্যের সংখ্যাও গ্রামেই বেশি।

গ্রামে এখন কিছু অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে। এতে গ্রামের অর্থের প্রবাহ কিছুটা বাড়ছে। তবে এ অর্থের বড় অংশই চলে যাচ্ছে সুবিধাভোগীদের পকেটে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গ্রামের অর্থের প্রবাহ বাড়েনি। আগের মতোই আছে। তবে সঞ্চয়ের প্রবণতা কমেছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মোট সঞ্চয়ের মধ্যে গ্রামে ছিল ২১ দশমিক ৫১ শতাংশ। গত ডিসেম্বরের তা ২১ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ওই সময়ে শহরে আমানত প্রবাহ বেড়েছে। একই সময়ের ব্যবধানে মোট আমানতে শহরের অংশ ৭৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে। মোট ঋণের মধ্যে গ্রামে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ছিল ১১ দশমিক ২০ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে তা বেড়ে ১১ দশকি ৭৩ শতাংশ হয়েছে। একই সময়ে শহরে ৮৮ দশমকি ৮০ শতাংশ থেকে কমে ৮৮ দশমিক ২৭ শতাংশ হয়েছে। করোনার ও বৈশ্বিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করতে গত তিন বছর ধরে বিশেষ প্রণোদনার আওতায় গ্রামে ঋণের প্রবাহ বাড়ানো হয়েছে। এতে গ্রামে টাকার প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে। তবে সেগুলো গেছে উৎপাদন খাতে। এর প্রভাবে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার সুযোগ নেই। বরং আরও কমার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতির হারের হিসাব মিলছে না। বিবিএস যেভাবে দেখাচ্ছে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। এতে বড় কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। হয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের কাঠামো পরিবর্তন হয়ে গেছে। ফলে গ্রামের মানুষের অবস্থা ভালো হয়েছে। তাদের চাহিদা বেড়েছে। আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তেমনটি হয়নি। একটি হতে পারে, গ্রামে এখন পণ্য ও সেবার দাম শহরের চেয়ে বেশি। তাহলে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হতে পারে। এটি হলে সরকারের পণ্য উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের গলদ রয়েছে। তা শনাক্ত করে নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে।

বিবিএসের সূত্র জানায়, সংস্থাটি উপজেলা পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। এর মধ্যে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অতীব জরুরি এমন পণ্য ও সেবাগুলোর মূল্য ও সেগুলোতে দেওয়া ভর (কত অংশ প্রয়োজন) এর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। এর মধ্যে শহরের ৪২২টি পণ্য ও সেবা এবং গ্রামের ৩১৮টি পণ্য ও সেবার মূল্য নেওয়া হয়। তাদের সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, গ্রামে এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়ছে। যে কারণে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হচ্ছে।

সূত্র জানায়, রেমিট্যান্সের বড় একটি অংশ যাচ্ছে গ্রামে। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী এর ৫৩ শতাংশই ব্যবহৃত হচ্ছে ভোগবিলাসে। এ থেকে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা বাড়তে পারে। তবে যেভাবে বেড়েছে সেভাবে বাড়ার কথা নয়।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, সাধারণ মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারও বেশি। গ্রামে এ হার ৮ দশমকি ১৯ শতাংশ এবং শহরে ৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ। শহরের চেয়ে গ্রামে এ হার দশমিক ২১ শতাংশ বেশি।

প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, খাদ্যপণ্যের প্রায় সবই উৎপাদন হয় গ্রামে। এ কারণে সেখানে খাদ্যের সরবরাহ থাকে প্রচুর। এতে গ্রামে দামও কম হওয়ার কথা। অনেক ক্ষেত্রে সবজির দাম গ্রামে কম। তার পরও গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেশি হচ্ছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষ বেশি ব্যবহার করে। যে কারণে এ খাতে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম হওয়ার কথা। শহরে হওয়ার কথা বেশি। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি। গ্রামে এ হার ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ, শহরে ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ। শহরের চেয়ে গ্রামে দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি।

মূল্যস্ফীতির বিভিন্ন উপ-খাতের মধ্যে কেবলমাত্র বাসা ভাড়া ও জ্বালানি, চিকিৎসা এবং গৃহসামগ্রী তিনটিতে শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম। বাকি সব উপ-খাতে শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি।

গত ফেব্রুয়ারিতে গ্রামে খাদ্য, পানীয় ও টোব্যাকো উপ-খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে দশমিক ৮৬ শতাংশ, শহরে দশমিক ৫৭ শতাংশ। এতেও শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। অনেকেই মনে করেন, গ্রামের মানুষ কোমল পানীয় কম পান করে। বিলাসবহুল তামাক জাতীয় পণ্যের চাহিদাও কম। এসব কারণে এ খাতে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম হওয়ার কথা।

গ্রামে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে দশমিক ২৪ শতাংশ, শহরে দশমিক ৩৭ শতাংশ। এর মধ্যে কাপড় ও জুতা উপ-খাতে গ্রামে দশমকি ১৯ শতাংশ, শহরে দশমিক ১৪ শতাংশ। এসব পণ্য গ্রামে পাওয়া যায় কম দামি ও নিুমানের। ভালো ও উঁচু দামের এসব পণ্য মিলে শহরে। গ্রামের মানুষ উঁচু দরের এসব পণ্য ব্যবহারও করেন কম। তার পরও এতে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার শহরের চেয়ে বেশি বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।

গ্রামে বাসা ভাড়া ও জ্বালানি উপ-খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে দশমিক ৩১ শতাংশ, শহরে দশমিক ৭৮ হয়েছে শতাংশ। এ বিষয়ে অনেকেই একমত। কারণ গ্রামের চেয়ে শহরে বাসা ভাড়া বেশি।

গ্রামে ফার্নিচার, গৃহসামগ্রী উপ-খাতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে দশমিক ১১ শতাংশ, শহরে দশমিক ৪৪ শতাংশ । চিকিৎসা খরচ গ্রামে বেড়েছে দশমিক ০৮ শতাংশ, শহরে দশমিক ১৭ শতাংশ। এসব খাতে গ্রামের চেয়ে শহরে এ হার বেশি হওয়াটার যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

গণপরিবহণ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি উপ-খাতে মূল্যস্ফীতির হার গ্রামে দশমিক ২৭ শতাংশ, শহরে দশমিক ০৫ শতাংশ বেড়েছে। বিনোদন উপ-খাতে গ্রামে বেড়েছে দশমকি ২৬ শতাংশ, শহরে বেড়েছে দশমিক ১৯ শতাংশ।

বিবিধ খাতে গ্রামে বেড়েছে দশমিক ৪১ শতাংশ, শহরে বেড়েছে দশমিক ২২ শতাংশ। এসব খাতের অনেক সুবিধা গ্রামে নেই। গ্রামে এগুলো ভোগ করতে অর্থও খরচ করতে হয় কম। তার পরও গ্রামে এসবের দাম বেশি বেড়েছে।

LEAVE A REPLY