বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে ডলার বিনিময়ের নতুন একটি রেট রবিবার অর্থাৎ ২রা এপ্রিল থেকে কার্যকর হচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকেই ডলার বিনিময়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিমাসেই একবার ডলারের মূল্য সমন্বয় করে আসছে।
তবে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাংলাদেশের ডলার কেনা-বেচায় নানারকম বিনিময় হার চালু থাকায় তারা আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। খবর বিবিসির।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তারা যে রেটে রপ্তানি আয় করে থাকেন, তার তুলনায় আমদানি করতে গিয়ে অনেক বেশি দামে ডলার কিনতে হয়। এই রেট কাছাকাছি করার দাবি বিভিন্ন সময় তারা বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের কাছে তুলে ধরেছেন। অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, একটি দেশে ডলার লেনদেনে একটি সিঙ্গেল রেট বা নির্দিষ্ট দর থাকা উচিত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও ডলারের এক দাম নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, এই সমস্যা সমাধানে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তারই অংশ হিসাবে নতুন রেট চালু হচ্ছে।
ডলারের লেনদেনে নানারকম রেট
একসময় বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব পায় এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস এসোসিয়েশন (বাফেদা)।
এরপর থেকেই এই দুটি সংগঠন মিলে প্রতিমাসে ডলারের বিনিময় মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। সেই সময় প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে প্রতি মার্কিন ডলারের সর্বোচ্চ দর নির্ধারণ করা হয় ১০৮ টাকা আর রপ্তানি বিল নগদায়ন হবে প্রতি ডলারে ৯৯ টাকা। এখন নতুন যে রেট কার্যকর হচ্ছে, সেখানে রপ্তানি বিল নগদায়নে ব্যাংকগুলো ডলার কিনবে ১০৫ টাকা আর প্রবাসী আয়ে ১০৭ টাকা হারে।
এর সঙ্গে অবশ্য রপ্তানি খাতের আয়ে চার শতাংশ প্রণোদনা ভাতা আর প্রবাসী আয়ে দুই শতাংশ প্রণোদনা যোগ হবে। বাংলাদেশে ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস এসোসিয়েশন- বাফেদার নির্বাহী সচিব মোঃ আবদুল হাশেম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, প্রণোদনা ভাতা যোগ করলে প্রবাসী আয় ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা আর রপ্তানি আয় প্রায় ১০৭ থেকে ১০৯ টাকা হবে।
কারণ বিভিন্ন রপ্তানি পণ্যের জন্য প্রণোদনার হারও আলাদা হয়ে থাকে। তিনি বলেছেন, “আগে একসময় রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় ইত্যাদি খাতে ডলারের বিনিময় মূল্যে বেশ পার্থক্য ছিল। সেটা মেটাতেই কিন্তু নতুন এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।”
গত মাসেও প্রবাসী আয়ে ডলার প্রতি ১০৭ টাকা করে বিনিময় মূল্য থাকলেও রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে দেয়া হতো ডলার প্রতি ১০৪ টাকা। কয়েকমাস আগেও এই রেট ছিল ৯৯ টাকা। ফলে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করতেন, যে রেটে তারা রপ্তানি থেকে আয় করছেন, সেই পণ্যের কাঁচামাল কিনতে গিয়ে তাদের বেশি দরে ডলার কিনতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্রাকচারার অ্যান্ড একপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “অফিশিয়াল রেটের মধ্যেই ডলারের দুইরকম তিনরকম রেট আছে, যেটা অত্যন্ত দুঃখজনক।”
“এখন তো কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়েছে, কিন্তু বিগত দিনগুলোতে আমাদের কম রেট দিয়ে রপ্তানিকারকদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে, অবিচার করা হয়েছে.” অভিযোগ করেন তিনি। “আগে আমি রপ্তানি করে পেয়েছি ৯৯ টাকা, কিন্তু আমি যখন এলসি খুলেছি, সেই দায় মেটাতে গিয়ে তখন আমাকে ডলার কিনতে হয়েছে ১০৬ টাকা করে। এতে লাভবান হয়েছে ব্যাংক,” বলছেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
যদিও গত কয়েকমাসে ধাপে ধাপে এই ফারাক কমিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু এখনো ব্যাংকে ডলারের নানারকম রেট রয়েছে। “কোন অবস্থাতেই ব্যাংকে নানা ধরনের ডলার বিনিময় মূল্য থাকা উচিত না। সেই সঙ্গে ক্রয়ের সঙ্গে বিক্রয়ের পার্থক্য কোন অবস্থাতেই এক টাকার বেশি হতে পারে না। “
কেন ব্যাংকে ডলার বিনিময়ে নানা ধরনের রেট রয়েছে?
বাংলাদেশে যারা বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় করে থাকেন, তারা বলছেন, সরকারের নীতি অনুযায়ী, বিভিন্ন খাতের ডলার কেনার ওপর নির্ভর করে ডলার বিক্রির রেট নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। বাফেদার নির্বাহী সচিব মোঃ আবদুল হাশেম বলছেন, “এক্সপোর্ট এবং ইনওয়ার্ড রেমিট্যান্সের সময় ব্যাংক ডলার কেনে। আবার এলসির সময় ব্যাংক গ্রাহকদের কাছে ডলার বিক্রি করে থাকে।
সেখানে পার্থক্য তো থাকবেই, যেহেতু কমার্শিয়াল ব্যাংক তো ব্যবসা করবেই। এর সাথে বিভিন্ন খাতে সরকারের প্রণোদনা যোগ হয়।” তিনি আরো বলেন, “পুরোপুরি এক হবে কিনা জানি না, সেটা সরকারের পলিসিগত বিষয়। কিন্তু কাছাকাছি আনার জন্য অনেক চেষ্টা করে আমরা এই গ্যাপটা কমিয়ে এনেছি।”
বাফেদার নীতি অনুযায়ী, ব্যাংক যে রেটে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ের ডলার কিনে থাকে, সপ্তাহের পাঁচদিনের মোট ক্রয়ের গড়ের সাথে সর্বোচ্চ একটা টাকা মার্জিন যোগ করে এলসি সেটেলমেন্ট করতে ব্যাংক ডলার বিক্রি করতে পারবে।
কিন্তু এক্ষেত্রেও ব্যাংক ভেদে রেট আলাদা হয়ে থাকে। যে ব্যাংকের প্রবাসী আয় বেশি, কিন্তু রপ্তানি আয় কম, তাদের এলসির জন্য ডলার বিক্রির রেট একটু বেশি হবে, কারণ এখনো তুলনামুলকভাবে প্রবাসী আয়ের ডলারের রেট বেশি। আবার যে ব্যাংকের রেমিট্যান্সের তুলনায় রপ্তানি আয় বেশি, তারা কিছুটা কম রেটে এলসির জন্য ডলার দিতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’রেমিট্যান্সে সবসময়েই একটা প্রেফারেনশিয়াল রেট দেয়া হয়। আর ব্যাংকের ওডি, এলসি, ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন ধরনের রেট থাকে। একটা রেটে সব খাতে ডলার সেল হয় না। কিন্তু যখন এসব বিনিময় রেট দুই শতাংশ সীমার মধ্যে থাকে, সেটাকেই আমরা সিঙ্গেল রেট বলি।‘’
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলছেন, ‘’যখন আপনি ক্যাশ পেমেন্ট করবেন, সেটা কস্ট আর যখন ওয়্যার ট্রান্সফার করবেন, সেটার খরচ এবং সেটেলমেন্ট সাইকেল হয়ে থাকে। ওয়্যার ট্রান্সফার সেটেল হতে তিনদিন লাগে। ব্যাংক কিন্তু এই তিনদিনের ইন্টারেস্ট রেটের মধ্যে অ্যাড করে নেবে। এসব কারণে বিভিন্ন খাতে ডলারের দর আলাদা হয়ে থাকে।‘’
তবে নগদ লেনদেনের বিষয়টি আবার আলাদা। যারা বিভিন্ন সময় নগদ ডলার নিয়ে আসেন বা বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়ে থাকে, সেটার সরবরাহ এবং যোগানের ওপর নির্ভর করে এটার ডলারের বিনিময় মূল্য নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে বাফেদার কোন আলাদা নীতি নেই। ব্যাংক ভেদে এটারও দর কমবেশি হয়ে থাকে।
তবে মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ডলার ক্রয়-বিক্রয়ের বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি ফর্মুলা দেয়া আছে। বিভিন্ন ব্যাংক প্রতিদিন যে হারে নগদ ডলার বিনিময় করে, সেটার ওপর নির্ভর করে নগদ ক্রয়-বিক্রয়ের একটা রেট প্রকাশ করে থাকে বাফেদা। সেটার সঙ্গে মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মার্জিন যোগ করে খোলাবাজারে ডলার লেনদেন করবে।
কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান এই নিয়ম-নীতির বাইরে গিয়ে বেশি দামে ডলার কেনাবেচা করছে। শনিবার কয়েকটি মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো ডলার কিনছে ১১৩ টাকা ৩০ টাকা দরে আর বিক্রি করছে ১১৪ টাকা দরে।
ডলারের ‘একক রেট’ কবে হবে?
বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা বহুদিন ধরেই বলে আসছেন যে, বাংলাদেশে যেভাবে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে ডলারের লেনদেন হয়ে থাকে, তা আন্তর্জাতিক মানের নয়। বিশেষ করে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার লেনদেনে একাধিক রেট থাকা কখনোই উচিত নয়।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, একটি দেশে মাল্টিপল রেট কখনোই থাকা উচিত না। সেটা যে শুধু সমস্যাই তৈরি করে তা নয়, অনেক ব্যাড প্রাকটিসেরও জন্ম দেয়। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “অনেকদিন ধরেই আমরা বলে আসছি, অফিসিয়াল চ্যানেলে ডলারের একাধিক রেট থাকা কখনোই উচিত নয়। আইএমএফের প্রিন্সিপলও কিন্তু সেটাই।”
“এটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এটা এক রেটে নিয়ে আসা উচিত। আমার ধারণা, সরকার এখন সেটা উপলব্ধি করে সেই চেষ্টা করছে। আমি ধারণা করছি, জুন মাসের মধ্যেই হয়তো এটা একক রেটে চলে আসতে পারে,” বলেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলছেন, “আলটিমেটলি কিন্তু আমরা সিঙ্গেল রেটের দিকেই যাচ্ছি।
এখন রপ্তানি, রেমিট্যান্স রেট অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে, আমদানিকারকরাও কাছাকাছি রেটে ডলার কিনতে পারছেন।”