বারবার রক্তাক্ত পাহাড়, নেপথ্যে সশস্ত্র সংগঠন

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পরও পাহাড়ে শান্তি ফেরেনি। চলছে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। এতে অশান্তই রয়ে গেছে পাহাড়। পড়ছে একের পর এক লাশ। ঝরছে রক্ত। বৃহস্পতিবার বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে দুটি সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে গোলাগুলিতে ৮ জন নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে গত দেড় বছরে তিন পার্বত্য জেলায় সশস্ত্র সংঘাত ও প্রতিপক্ষের হামলায় অন্তত ৪০ জন নিহত হলেন। অপহরণের শিকার হয়েছেন শতাধিক।

পাহাড়ে বারবার রক্ত ঝরার নেপথ্যে রয়েছে ৭ সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তার। চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যাসহ নানা অপরাধে লিপ্ত তারা। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

রাঙামাটি : ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এ চুক্তির শর্ত মোতাবেক জেএসএস সভাপতি সন্তু লারমাসহ ১৭০০ জন সদস্য সরকারের কাছে অস্ত্র সংবরণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। এতে পাহাড়ে শুরু হয় শান্তির বাতাবরণ। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার সংঘাত শুরু হতে থাকে। বর্তমানে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএসসহ পাহাড়ে অন্তত ৭টি সশস্ত্র সংগঠন রয়েছে।

অপর সংগঠনগুলো হলো-জেএসএস (সন্তু লারমা) বিরোধী সংস্কারপন্থি জেএসএস (এমএন লারমা), ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), তাদের বিরোধীয় গ্রুপ ইউপিপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ), মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি) ও ম্রো ন্যাসনাল পার্টি (এমএনপি)।

এছাড়াও সম্প্রতি এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’। কেএনএফের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা অবস্থান নিয়েছে বান্দরবানের গহিন অরণ্যে। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে এ পর্যন্ত কেএনএফ ও শারক্বীয়ার অর্ধশতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

পাহাড়ের এসব সন্ত্রাসী সংগঠন ব্যাপক চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহণ থেকে দেদার চাঁদাবাজি করে তারা। চাঁদাবাজির টাকায় সংগ্রহ করে আগ্নেয়াস্ত্র। চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই মূলত এসব সশস্ত্র সংগঠনের সন্ত্রাসীরা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ওপরও হামলা করে তারা।

২ এপ্রিল খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়ে হ্লাচিং মং মারমা (উষা) নামে ইউপিডিএফের এক সদস্য নিহত হয়েছেন। তার আগে ১২ মার্চ বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে সেনাবাহিনীর একটি টহল দলের ওপর কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) সন্ত্রাসীরা গুলিবর্ষণ করলে সেনা কর্মকর্তা মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন গুলিতে নিহন হন। ১১ মার্চ রুমায় সীমান্ত সড়ক নির্মাণ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের গুলিবর্ষণ করে ১২ শ্রমিক এবং পরে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য সার্জেন্ট মো. আনোয়ার হোসেনকে অপহরণ করে কেএনএ সন্ত্রাসীরা। পরে মুক্তিপণের বিনিময়ে শ্রমিকদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

১৬ দিন পর বান্দরবানের রুমা উপজেলার কেওক্রাডং এলাকায় সার্জেন্ট আনোয়ার হোসনকে ছেড়ে দিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান, বাঙালিভিত্তিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান মো. মজিবর রহমান।

২১ জুন রাঙামাটির বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের দুর্গম সাইজাম ত্রিপুরাপাড়ায় সশস্ত্র হামলা চালিয়ে বিশ্বচন্দ্র ত্রিপুরা, তার ছেলে সুভাষ ত্রিপুরা ও ধনরা ত্রিপুরা নামে স্থানীয় তিন গ্রামবাসীকে হত্যা করে কেএনএফ’র সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।

২০ অক্টোবর পরিচালিত যৌথবাহিনীর অভিযানে রাঙামাটি ও বান্দরবানের বিভিন্ন দুর্গম এলাকা হতে বিপুল অস্ত্রগোলাসহ জঙ্গি সংগঠন শারক্বিয়ার ৭ জন ও কেএনএফ’র ৩ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে আরও বেশকিছু সংখ্যক জঙ্গি ও সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

রাঙামাটির পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ বলেন, সরকার সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আগেও কঠোর অবস্থানে ছিল, এখনও কঠোর অবস্থানে রয়েছে। পার্বত্য এলাকাটি দুর্গম, তাই সন্ত্রাসীরা সব সময় তার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাহাড়ে সন্ত্রাস দমনে কাজ করে যাচ্ছে। প্রয়োজনে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মুছা মাতব্বর বলেছেন, অবৈধ অস্ত্রধারীরা পাহাড়ে শান্তি বিনষ্ট করছে। তাদের অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি ও চাঁদাবাজিতে পাহাড়ের মানুষ জিম্মি। তারা এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের স্থানীয় বহু নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হলেই পাহাড়ে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা হবে। তখন পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন সহজ হয়ে উঠবে।

বান্দরবান : জেলায় সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে সবচেয়ে বেপরোয়া কুকিচিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)। এছাড়া রয়েছে-মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি), পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জেএসএস সংস্কার, ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক, ম্রো ন্যাশনাল পার্টি (এমএনপি)।

কয়েকজন জনপ্রতিনিধি জানান, পাহাড়ে কেএনএ, মগ বাহিনী, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক এবং জেএসএস’র তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। সশস্ত্র বাহিনীগুলো পাহাড়ে চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন এবং চোরাচালান ও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। যৌথ বাহিনীর অভিযানে সাম্প্রতিক সময়ে কেএনএ’র ১৪ জন সদস্যকে অস্ত্র-গোলাবারুদসহ গ্রেফতার করা হয়।

সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, গোষ্ঠী ভিত্তিক দ্বন্দ্ব, অরক্ষিত সীমান্ত, অপ্রতুল সেনা ক্যাম্প ও অস্ত্রের অবাধ সরবরাহের কারণে পাহাড়ে বারবার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।

বান্দরবান পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম বলেন, পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় পুলিশের পক্ষ থেকে তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।

খাগড়াছড়ি : সম্প্রতি আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন এলাকায় ৩ জন নিহত হয়েছেন। দিঘীনালা লংগদু সীমান্তে জেএসএসের (সন্তু লারমা) গুলিতে বিনয় চাকমা (২৪) ও ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের এক সশস্ত্র কর্মী নিহত হন। এ ঘটনার পর মাটিরাঙ্গা উপজেলার ভাঙ্গামুড়ায় ইউপিডিএফ (প্রসীত) ও ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) গোলাগুলিতে প্রসীত গ্রুপের সশস্ত্র কর্মী উত্তম ত্রিপুরা ওরফে ওদুদ নিহত হন।

এ সময় তার লাশের পাশ থেকে একটি একে-২২ রাইফেল, দুটি ম্যাগাজিন, দুই রাউন্ড তাজা গুলি, ৩১ রাউন্ড গুলির খোসা ও ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের বিপুল পরিমাণ চাঁদার রসিদ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া দীঘনালার নাড়াইছড়ির উগোদছড়িতে জেএসএসের (সন্তু লারমা) সশস্ত্র কর্মীদের গুলিতে নিহত হয় ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের কর্মী শরৎজ্যোতি চাকমা (১৯)।

রোববার চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে আহত হ্লাচিংমং মারমা (উষা) নামের এক যুবক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। নিহত যুবককে নিজেদের কর্মী দাবি করেছে প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ।

LEAVE A REPLY