সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ ব্যবস্থা বাংলাদেশে

অর্থনীতির বিবেচনায় বিশাল সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ। সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। একদিকে জনশক্তির প্রচুর মানবসম্পদ অপরদিকে রয়েছে নিজস্ব বিশাল বাজার। এ ছাড়াও বিনিয়োগবান্ধব রাজস্বনীতি, পাশাপাশি এখান থেকে ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ অত্যন্ত লাভজনক। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ ব্যবস্থা বাংলাদেশে। এখানে বিনিয়োগ করলে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হবে। জাপানের রাজধানী টোকিও’র স্থানীয় একটি হোটেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে রোডশোতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার এসব কথা বলেছেন। দুই দেশের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে এই আয়োজন। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) যৌথভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সহ-আয়োজক জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অরগানাইজেশন (জেটরো)। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএসইসি চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতা, বিনিয়োগ, বাণিজ্য, বাংলাদেশি পণ্য ও সেবা, শেয়ারবাজার এবং বন্ড মার্কেটকে তুলে ধরা হয়। মূল অনুষ্ঠানের আগে জাপানের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। এ সময়ে বাংলাদেশ ও জাপানের বেসরকারি কোম্পানির মধ্যে ১১টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর (এমওইউ) করা হয়।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, বিডা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন, গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান, জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী নিশিমুরা ইয়াসুতোশি, জেটরো চেয়ারম্যান ইশিগুরো নোরিহিকো এবং জাপান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির কেন কোবায়াশি প্রমুখ।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি নিশ্চিত জাপানের সঙ্গে আমাদের গত ৫০ বছরের ঈর্ষণীয় সহযোগিতা আগামী ৫০ বছর এবং তারপরেও অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। আসুন আমাদের ব্যবসা ও বিনিয়োগ সম্পর্ককে পরবর্তীতে উচ্চস্তরে নিয়ে যাই।’ তিনি বলেন, গত পাঁচ দশকে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দৃষ্টান্তমূলক ফলাফল দেখে আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশে জাপানের বৃহত্তর পদযাত্রার প্রত্যাশা আমাদের। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাস আপনাদের উদ্যোগকে সহযোগিতা ও সহজতর করতে প্রস্তুত। তাই অপেক্ষারত ব্যবসা এবং বিনিয়োগের সম্ভাবনাগুলো অনুসন্ধান করতে বাংলাদেশে আসুন।’ তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে জাপানি কোম্পানির বেশ কয়েকটি নিয়ন্ত্রক ও নীতিগত সমস্যা সমাধান করেছি। আমি নিজেই বাংলাদেশ-জাপান জয়েন্ট পাবলিক-প্রাইভেট ইকোনমিক ডায়ালগ (পিপিইডি) গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি। আগামীতেও ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি অব্যাহত রাখব। বাংলাদেশে ব্যবসায় সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করব।’ তারমতে, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে উদার বিদেশি বিনিয়োগ ব্যবস্থা বাংলাদেশে। ‘প্রতিযোগিতামূলক খরচ, প্রচুর মানবসম্পদ, উচ্চ ক্রয়ক্ষমতাসহ বিশাল দেশীয় ভোক্তা বাজার এবং ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্তের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য একটি অত্যন্ত লাভজনক অবস্থান হিসাবে দ্রুত আবির্ভূত হচ্ছে।’ শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশাধিকার উন্নত করার মাধ্যমে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্র হতে সচেষ্ট। সারা দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাই-টেক টেকনোলজি পার্ক স্থাপন করছেন।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগের কেন্দ্র হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পরিকল্পিত অবকাঠামোগত ভিত্তি তৈরি করছে। তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের খোলামেলা এবং উৎপাদনশীল ধারণাগুলো শুনে খুশি। এটি আমাদের বন্ধুপ্রতিম উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও প্রসারিত ও শক্তিশালী করবে।’ শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের ব্যবসাবান্ধব রাজস্ব ব্যবস্থায় রয়েছে। আর্থিক নীতি ও প্রণোদনা, স্থিতিশীল গণতন্ত্র, বিচক্ষণ শাসন ও নেতৃত্ব বিদেশি বিনিয়োগে ভালো রিটার্নের নিশ্চয়তা দিচ্ছে। জাপানি ব্যবসায়ীদের তিনি বলেন, আÍবিশ্বাসের সঙ্গে আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি, বাংলাদেশ বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জন্য অটুট ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দেয়। তাই আমরা, বিশেষ করে জাপানি বিনিয়োগকারীসহ বিশ্বের সব বিনিয়োগকারীকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগগুলো দেখার জন্য স্বাগত জানাই।’ তিনি বলেন, ‘তবে, প্রকৃত বিনিয়োগ এখনও কম। আমরা জাপানের কাছ থেকে আরও বিনিয়োগ চাই। আমি আপনাদের সবাইকে বাংলাদেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগের সম্ভাবনাগুলো অনুসন্ধান করতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ১৭ কোটি মানুষের দেশ যেটি নিজেই একটি ক্রমবর্ধমান বাজার এবং প্রায় তিন বিলিয়ন ভোক্তার একটি বৃহৎ বাজারের কেন্দ্রস্থলে এর অবস্থান ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য একটি বিশাল আকর্ষণ প্রদান করে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদেশি বিনিয়োগের জন্য তার সরকার ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করছে।

তিনি বলেন, ‘আমি জাপানি বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, বাংলাদেশ আপনাদের জন্য প্রস্তুত, এবং সেখানে গেলে আপনাদের দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা হবে। আপনারা ব্যবসার সুবিধার জন্য প্রয়োজনীয় সব সংস্থা এবং কাঠামো সুবিধার জন্য তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশি ও জাপানি কোম্পানিগুলোর মধ্যে সহযোগিতা দেখে প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য যেসব কোম্পানি আজ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আমি তাদের সফল অংশীদারত্ব কামনা করছি। আমরা জাপানি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বিশেষ করে আড়াইহাজারে জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলে আরও বিনিয়োগ আশা করি।’ জাপানে বসবাসরত অনাবাসী বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা তাদের রেমিট্যান্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

মূল প্রবন্ধে প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, ‘গত ১০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে। ইতোমধ্যে সব সূচকে আমরা এগিয়েছি। সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করলে আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাবনা বিশাল। মূল বক্তব্যে বলা হয়, সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কারণে বাংলাদেশে বিনিয়োগ লাভজনক। এর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ উদীয়মান ও সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশ, গত দশ বছরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে অগ্রগতি, অভ্যন্তরীণ বাজার বড়, এখানে পণ্য উৎপাদন করে বিশ্বের অন্যান্য দেশও রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও অবকাঠামো খাতে বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে, প্রতিযোগীদের তুলনায় বাংলাদেশে শ্রমের মূল্য কম, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো এবং এখানে বিনিয়োগ করলে মুনাফা সহজে দেশে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

উপস্থাপনায় শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম আরও বলেন, বর্তমানে ৩২৪টি জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশে কাজ করছে। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশটি থেকে বাংলাদেশে ৪১ কোটি ১৫ লাখ ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে। প্রতি ডলার ১১০ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় যা ৪ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে জাপানে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ ১১৮ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। একই সময়ে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৭ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। অন্যদিকে ৪ বছরে জাপান থেকে বাংলাদেশে ৬ বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন সহায়তা এসেছে। এই অর্থ দুটি পদ্মা সেতুর ব্যয়ের সমান। এর মধ্যে ২০২০ সালে জাপানের সঙ্গে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়। এর আওতায় বর্তমানে ৫টি প্রকল্প চলমান। এই সম্মেলনে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে ১১টি সমঝোতা চুক্তি সই হয়। এর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্পর্কিত তথ্য আদান-প্রদানে জেসিসিআই ও এফবিসিসিআই, বাংলাদেশে লায়ন কল্লোলের ব্যবসা আরও সম্প্রসারণে জমি বরাদ্দ, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় একটি উচ্চ-দক্ষতা সম্পন্ন ৭০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল গ্যাস-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উন্নয়ন, নতুন সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পে যৌথ বিনিয়োগে জাপানের মারুবেনি এবং বাংলাদেশের ডোরিন গ্রুপের চুক্তি, মূলধন জোট গঠনে জাপানের মারুবেনি এবং বাংলাদেশের বিজেআইটি চুক্তি, বাংলাদেশে একটি জাপানি স্ট্যান্ডার্ড ডেন্টাল ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠায় যৌথ উদ্যোগ নিতে জাপানের মেদিনা ডেন্টাল কোম্পানি এবং বাংলাদেশের হেলথ কেয়ার গ্রুপের চুক্তি, ২০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাসমান ও গ্রাউন্ডের যৌথ উন্নয়নে জাপানের সুমিতোমো করপোরেশন ও পার্কার বাংলাদেশের চুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ার লক্ষ্যে জাপানের পাইপলাইন এবং বাংলাদেশের ইরো ভিজিলের মধ্যে একটি চুক্তি, বাংলাদেশে জ্বালানি অবকাঠামো নির্মাণে জাপানের জেরা এবং বাংলাদেশের সামিট গ্রুপের চুক্তি, ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস এজেন্সি জাপান এবং বিএসইসির মধ্যে এক্সচেঞ্জ অব লেটার স্বাক্ষরিত এবং আইসিটি শিল্পে উভয় দেশের সদস্যদের মধ্যে জ্ঞান আদান-প্রদানে চুক্তি সই হয়।

LEAVE A REPLY