রূপপুর প্রকল্পের কিস্তির জমা অন্য অ্যাকাউন্টে

নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও এখনো কাটেনি জটিলতা। ফলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বকেয়া কিস্তির টাকা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে কিস্তি ও সুদের টাকা আলাদা একটি ‘অ্যাসকারো’ অ্যাকাউন্ট খুলে রাখার পরামর্শ দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি বলেছিল, এ অর্থ আলাদা করে রেখেই রিজার্ভ হিসাব করতে হবে। পরে যখন জটিলতা কেটে যাবে তখন কিস্তি পরিশোধ করা হবে ওই টাকায়ই। সেই মোতাবেক প্রায় ৩০ কোটি ডলার বা প্রায় ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা আলাদা করে অ্যাসকারো অ্যাকাউন্ট (গচ্ছিত অর্থ প্রয়োজন অনুযায়ী পরে খরচ করা যায়) খুলে রেখেছে সরকার। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেসবাউল হক বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, অ্যাসকারো অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। এটি হচ্ছে ইআরডি এবং সরকারের অ্যাকাউন্ট। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটি মেইনটেন্যান্স করছে। ইআরডি থেকে যেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হবে আমরা সেভাবেই কাজ করব। রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের বকেয়া কিস্তির টাকা জমা রাখা হয়েছে কিনা-জানতে চাইলে তিনি বলেন, না এখনো তেমন কোনো নির্দেশনা আসেনি।

এ প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) একাধিক কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে টাকা জমা রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তাদের কারও কারও মতে, চলতি অর্থবছরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাজেটে অর্থ বরাদ্দ ধরা আছে। এই অর্থ খরচ করতে না পারলে আগামী বাজেট থেকে নিতে হবে। ফলে বাজেটের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হতে পারে। এ চিন্তা করে আলাদা একটি অ্যাকাউন্ট খুলে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের মতো রাখা হয়েছে। এটি এক ধরনের সঞ্চয়ের মতো। অর্থাৎ আমাদের টাকা আমরা রেখেছি, যখন প্রয়োজন হবে তখন খরচ করা হবে। আইএমএফ’র শর্ত মেনে এটি করা হয়েছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন আইএমএফ’র শর্ত এখানে বড় কথা নয়। তবে এর আগে আইএমএফ এমনটাই পরামর্শ দিয়েছে।

এদিকে রূপপুর প্রকল্পের অর্থ পরিশোধের জটিলতা আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ইআরডির সচিব শরিফা খান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, আমার জানামতে আপাতত কোনো জটিলতা নেই। এছাড়া আইএমএফ’র প্রতিনিধি দলের সঙ্গে (বৃহস্পতিবার) অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কিনা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, না এ বিষয়ে তারা জানতে চায়নি। আমরা নিজে থেকেও তাদের কিছু জানাইনি।

সূত্র জানায়, আগে মার্কিন ডলারের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের অর্থ পরিশোধ করা হতো। এক্ষেত্রে রাশান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘জেএসসি এটমস্টয় এক্সপোর্ট’ এর নির্ধারিত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ‘ভিইবি.আরএফ’ (রাশিয়ার একটি বৈদেশিক অর্থ লেনদেন বিষয়ক ব্যাংক) মাধ্যমে লেনদেন করা হতো। কিন্তু ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার কিছু ব্যাংককে সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) বাদ দেওয়ায় জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ পরিশোধে সমস্যা দেখা দেয় এবং বন্ধ হয়ে যায় লেনদেন। পরে রাশান ঠিকাদারের প্রস্তাব এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আপাতত সোনালী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে লেনদেন করা শুরু করা হয়। পরে আবারও জটিলতার সৃষ্টি হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ান ফেডারেশনের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয় বাংলাদেশকে। সেখানে বলা হয়, ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত ইন্টার গভর্নমেন্টাল ক্রেডিট অ্যাগ্রিমেন্টের (আইজিসিএ) আর্টিকেল ২ এর প্যারাগ্রাফ ৫ সংশোধন করা প্রয়োজন। এছাড়া রাশিয়ার ওপর ডলার ও ইউরোয় লেনদেনে সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে বিকল্প পেমেন্ট মডালিটি (পরিশোধ পদ্ধতি) নির্ধারণের বিষয়েও একটি পৃথক প্রস্তাব গত বছরের ১০ আগস্ট ফলোচার্ট আকারে পাঠায় রাশিয়া। এরপর ৩০ আগস্ট রাশিয়ান অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটি সভা করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ। ওই সভায় রাশিয়ার দেওয়া চুক্তির অংশ সংশোধন এবং পেমেন্ট মডালিটির বিষয়ে আপত্তি জানায় বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে বলা হয়, রাশিয়ার সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী ঋণের অব্যবহৃত অর্থের ওপর কমিটমেন্ট ফি (প্রতিশ্রুতি ফি) ধার্য করা হবে। সেটি এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে প্রস্তাবিত মডালিটির পরিবর্তে বাংলাদেশ একটি পেমেন্ট মডালিটির প্রস্তাব দেওয়া কথা জানায়। যেটি উভয় দেশের জন্য লাভজনক ও নিরাপদ একটি উপায়ে ফলোচার্ট তৈরি করা হবে বলে বলা হয়। এতে সম্মতি দেয় রাশিয়ান অর্থ মন্ত্রণালয়। সেটি আর বেশিদূর এগোয়নি। সম্প্রতি চীনের ইউয়ানে অর্থ লেনদেনে সম্মতি হয়েছিল বাংলাদেশ-রাশিয়া। এ বিষয়ে ইআরডির সঙ্গে একটি সমঝোতাও হয়েছিল। এতে জটিলতা কেটে যাবে বলে মনে করছিলেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু সেখানে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে জটিলতা আরও দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সরকারের প্রথম ঋণচুক্তি হয় ২০১৩ সালে। সেটি ছিল ৫০ কোটি ডলারের। ওই টাকা দিয়ে প্রকল্পটির বিস্তারিত সমীক্ষাসহ প্রাথমিক কাজ করা হয়। সেই ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ শুরু হয় ২০১৮ সাল থেকে। এখন পর্যন্ত আট কিস্তিতে ৪০ কোটি ডলার পরিশোধ হয়েছে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান চালানোর পর থেকে কিস্তি পরিশোধ বন্ধ রয়েছে। বাকি ১০ কোটি ডলার এখনো বাকি রয়েছে। এটি ২০২২ সালের মার্চে পরিশোধ হওয়ার কথা ছিল। সেই সঙ্গে মূল প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ করছে সরকার। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের রূপপুর প্রকল্পটি ২০২৫ সালে শেষ হওয়ার কথা। এই মূল প্রকল্পটি বাস্তবায়নে রাশিয়ার কাছ থেকে ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। এ ঋণের কিস্তি শুরু হবে ২০২৭ সাল থেকে। এখন সুদ পরিশোধ করা হচ্ছিল। আগে নেওয়া ঋণের দুই কিস্তি আসল ও সুদ এবং মূল প্রকল্পে নেওয়া ঋণের সুদ মিলে বকেয়া পরিশোধে প্রায় ৩০ কোটি ডলার রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।

LEAVE A REPLY