সরকারবিরোধী আন্দোলনে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি বিএনপি। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে টানা আন্দোলনে কোনো সাফল্য নেই। এবার সফল পরিসমাপ্তি হবে কিনা সেটাও বড় চ্যালেঞ্জ। আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে না পারলে ভয়াবহ চাপে পড়বে দল।
এ অবস্থায় ব্যর্থতার বৃত্ত ভাঙতে মরিয়া দলের শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিটি নেতাকর্মী। তারা জয়ের বিকল্প ভাবছেন না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তারা বিজয় নিশ্চিত করতে চান। তবে এ আন্দোলন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকার হটানোর এবারের আন্দোলনই শেষ লড়াই। এবার আমাদের জীবন-মরণ লড়াই করতে হবে, হয় জীবন না হয় মরণ।
তিনি নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আসুন আমরা সেই লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলি। যা উত্তাল সমুদ্রের সুনামির মতো এই সরকারকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।’
জানা গেছে, দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে দলটি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আন্দোলন করে শেষ মুহূর্তে ভোটে যান নেতারা। কিন্তু ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে তা প্রত্যাহার করে ফের মাঠের আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু হয়।
বিগত কয়েক বছর ধরে দল গোছানোসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে নেতারা। লক্ষ্য এবার একটাই এ সরকারের পতন। কিন্তু সরকার এমনিতেই ক্ষমতা ছেড়ে দেবে না। এ অবস্থায় দাবি আদায়ে রাজপথই দলটির একমাত্র জায়গা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি এবার ব্যর্থ হলে তাদের কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। কিন্তু দল হিসাবে বিএনপি বিলীন হবে না। কারণ, অভ্যন্তরীণ ঐক্য এবং সারা দেশে অসংখ্য নেতাকর্মীর সমর্থনই দলটিকে টিকিয়ে রাখবে।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, এবারের আন্দোলনে সফল না হলে অবশ্যই বিএনপির জন্য সামনের দিনগুলো কঠিন হবে। কিন্তু দলটি খুব বেশি দুর্বল হয়ে যাবে না। কারণ, এক যুগের বেশি ক্ষমতার বাইরে থেকে যে দলটা টিকে আছে তারা আরও কয়েক বছরে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আমি মনে করি না।
তিনি বলেন, আগামী দিনে পাঁচ সিটি নির্বাচন দলটির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব নির্বাচনে যদি হেভিওয়েট প্রার্থীদের ভোট থেকে বিরত রাখা যায় তবে অভ্যন্তরীণ শক্তির বহিঃপ্রকাশ হবে। আর যদি অনেকে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করেন তাহলে দলের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে। অভ্যন্তরীণ ঐক্য এবং সারা দেশে বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থকই দলটির টিকে থাকার বড় শক্তি বলে মনে করেন এ আইনজীবী।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব সব রাজনৈতিক দলের। বিএনপি বড় দল হিসাবে তারাও এই দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে পারে না। কাজেই নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে তারা যে আন্দোলন করছে তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই শেষ করতে হবে। এর অন্যথা করা যাবে না।
তারা বলেন, দেশ পরিচালনার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের। দলের শীর্ষ নেতৃত্বকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কিভাবে ক্ষমতায় আসবেন, দেশ পরিচালনা করবেন। নেতাকর্মীরা তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। নেতৃত্ব সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে ভুল করলে দলকে, জনগণকে এর মূল্য দিতে হবে। সরকারি এবং বিরোধী সব দল এসব দিক মাথায় রেখে নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দেবেন বলে তারা আশা করেন।
দলের নেতাকর্মীরা মনে করছেন, বিএনপির সামনে একটাই পথ, চলমান আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি। অতীতের মতো এবারও ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে দলটির অস্তিত্ব থাকবে কিনা তা নিয়েই নানা প্রশ্ন রয়েছে। আওয়ামী লীগ বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করে ক্ষমতায় এলে নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার আরও বাড়বে। পুরোনো মামলা সচলের পাশাপাশি নতুন করে আরও মামলা দেওয়া হবে। অনেক মামলায় নেতাকর্মীদের সাজাও হতে পারে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে অনেকে দেশ ছেড়ে পালাবেন। আবার অনেকে রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেবেন। এমন বাস্তবতা মাথায় নিয়েই এবার অলআউট মাঠে নামতে চায় দলটি। তৃণমূলসহ সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের এমন বার্তা দেওয়া হচ্ছে।
নেতাকর্মীদের মধ্যেও এ উদ্দীপনা কাজ করছে। নিজেদের প্রয়োজনেই সর্বোচ্চ ত্যাগ শিকারে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু এ কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দলটির সামনে সময় খুব কম। এ অল্পসময়ে সবকিছু গুছিয়ে এনে একটা সফল আন্দোলনের কৌশল নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন দলটির হাইকমান্ড।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যুগান্তরকে বলেন, এ আন্দোলন শুধু বিএনপির টিকে থাকা নয়। আন্দোলন ব্যর্থ হলে স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি হিসাবে আমরা টিকে থাকতে পারব কিনা, সেই প্রশ্নই বড় করে দেখা দেবে। তাই বিএনপির জন্য নয়, দেশের জন্য এ আন্দোলনে জয়ের বিকল্প নেই। সেই চিন্তা থেকে সাধারণ মানুষও এবারের আন্দোলনে রাজপথে নামবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। বিএনপি আন্দোলন করছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে। কিন্তু বিষয়টি সংবিধানবহির্ভূত। তাদের দাবি অনুযায়ী নির্বাচন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আওয়ামী লীগ সেটা কেন করবে। এ বিষয়েও বিএনপিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
কেন সংবিধান সংশোধন করে বিএনপির দাবি অনুযায়ী নির্বাচন দেওয়া উচিত তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা তুলে ধরতে হবে। সংবিধান সংশোধনে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। এটা কি বিএনপির পক্ষে সম্ভব, দলের মধ্যেই এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ ক্ষেত্রে সময়স্বল্পতা একটি বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু নেতাকর্মীদের আশ্বস্ত করতে হলে এ সময়ের মধ্যেই বিএনপিকে সঠিক দিকনির্দেশনা নিতে হবে। তাদের কর্মীরা এসব বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য হাইকমান্ডের দিকে তাকিয়ে আছেন।
দলটির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, তাদের সামনে ‘ডু অর ডাই’ সিচুয়েশন। তাই আন্দোলনে জয়ের বিকল্প ভাবছেন না তারা। এমন পরিকল্পগুনা নিয়েই আন্দোলনের ছক কষছেন। এবার কিছু একটা হবে সবার মধ্যেই এমন আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। বিগত সময়ে রাজপথে নেতাকর্মীদের উপস্থিতিও সেই বার্তাই দিচ্ছে। কয়েক মাস আগে বিভাগীয় গণসমাবেশে শত বাধা উপেক্ষা করে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তাদের সরব উপস্থিতি সবার মধ্যে উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা তৈরি করে।
এরপর প্রতিটি কর্মসূচিতেই দলের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। সাধারণ মানুষের উপস্থিতিও লক্ষ করা যাচ্ছে। এতে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে আন্দোলনের সফলতা নিয়ে একটি ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। তবে দলের ভেতরের একটি অংশ মনে করেন তাদের নেতারা গত ১৪ বছর ধরে বলে আসছেন রোজার পর না হয় ঈদের পর সরকারবিরোধী জোরদার আন্দোলন হবে। দল ঘুরে দাঁড়বে। সংবাদ মাধ্যমেও ঘুরেফিরে এসব বিষয় এসেছে। যা নিয়ে সরকারি দলের মন্ত্রীরা বিদ্রূপ করছেন।
বিএনপির আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে তারা হাস্যরসের অবতারণা করছেন। এটা দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে জেদের জন্ম দিয়েছে। হাইকমান্ড যদি বিষয়টি আমলে নিয়ে সে অনুযায়ী আন্দোলন এগিয়ে নেয় তাহলে এর সফল পরিসমাপ্তি হবে বলে নেতাকর্মীরা আশা করছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বিশ্বের যেসব দেশ পর্দার অন্তরালে কাজ করছে তাদের মধ্যেও বিএনপির আন্দোলন নাড়া দিয়েছে। রাজপথের আন্দোলনে এবার বিএনপি শক্ত অবস্থান নিতে পারে বলে তারা মনে করছেন। এমন ধারণা নিয়ে ওইসব দেশও বিএনপির প্রতি আগের চেয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। অতীতে যারা বিএনপিকে এড়িয়ে চলত তাদের অনেকে এখন বিএনপির সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ রাখছেন। দলের শীর্ষ নেতারাও তাদের সঙ্গে দেখা করছেন। নানা বিষয়ে পরামর্শ করছেন বিদেশিদের সঙ্গে।
এ বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, শুধু বিএনপি নয় বিদেশিদের কাছে রাজনৈতিক ইস্যুতে ধরনা দেওয়া অনেক দলেরই প্রায় অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। সরকারি দল বা বিরোধী দল তাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে রাজনৈতিকসহ নানা বিষয়ে কথা বলছেন, পরামর্শ করছেন। দুদলই এ বিষয়ে অভিযোগ-পালটা অভিযোগ করছে। বিশ্লেষকরা বলেন, দেশের মানুষ এটাকে ভালোভাবে নিচ্ছে না। মানুষ মনে করে যে কোনো সমস্যা নিজেদেরই সামাধান করা উচিত। এর মধ্যে বিদেশিদের টেনে আনা দেউলিয়াত্বই প্রমাণ করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, সংবিধান অনুযায়ী এ বছরের শেষ দিকে জাতীয় সংদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে ক্ষেত্রে সময় আছে ৫-৬ মাস। এরপর তফশিল ঘোষণা হবে। এর আগে এসএসসি পরীক্ষা, ঈদুল আজহা, এইচএসসি পরীক্ষা এবং বর্ষাকাল। এর প্রতিটিই ভোটের রাজনীতির জন্য নেতিবাচক। এ অবস্থায় বিএনপিকে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা পর্যন্ত একভাবে ভাবতে হবে। একই সঙ্গে তফশিলের পর তাদের ভূমিকা কী হবে তাও এখনই চূড়ান্ত করতে হবে।
তারা মনে করেন সব কিছুর জন্যই সময় একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে দলটির জন্য। অল্প সময়ের মধ্যে দলের হাইকমান্ড সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে ভুল করলে নেতাকর্মীসহ দেশবাসীর কাছেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। এছাড়া দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাও কঠিন হবে।
এদিকে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের মনোভাব হচ্ছে আন্দোলনে জয় নতুবা জেলখানা এ দুটোকে মাথায় নিয়েই তারা রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দলের হাইকমান্ড যখন যে নির্দেশনা দেবে জীবন বাজি রেখে তা বাস্তবায়ন করতে তারা প্রস্তুত। এখন তাদের প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা। তারা বলেন, ঢাকায় আন্দোলন জোরদার হলে সরকার পতন অনেকটাই সহজ হবে। এবার ঢাকাকেই তারা আন্দোলনের সূতিকাগার বানাতে প্রস্তুত।
হাতিরঝিল থানা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে সভাপতি প্রার্থী মুনতাকিম সারোয়ার রিকি যুগান্তরকে বলেন, বিগত সময়ে মামলা-হামলায় আমরা জর্জরিত। আমাদের পেছনে ফিরে তাকানোর কোনো সুযোগ নেই। যেকোনো মূল্যে এবার আন্দোলনে জয় ছিনিয়ে আনতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে আমাদের টিকে থাকাই কঠিন হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী ও সমর্থক রয়েছে। তবে নেতৃত্বের সংকট রয়েছে। আন্দোলনে সফল না হলে দলটি কঠিন সংকটে পড়বে সন্দেহ নেই। কিন্তু এর চেয়ে দেশ আরও গভীর সংকটে নিমজ্জিত হবে।