ঘোষণা দিয়ে চলছে জাল টাকা কেনা-বেচা!

‘জাল টাকা বিক্রি করি, আমাদের কাছে পাবেন অরিজিনাল (এজেএস কাগজের) গ্লেজিং প্রিন্টের, সুতা জাল ছাপসহ নিখুঁত মাল। আমাদের কাছে পাবেন ‘৫০, ১০০, ৫০০, ১০০’ টাকার জাল নোট, যা ব্যাংকের মেশিন ছাড়া খালি চোখে বোঝা অসম্ভব। মালের স্যাম্পল নিজ হাতে চেক করে তারপর অর্ডার করবেন। বাংলাদেশের যেকোনো জাগায় আমাদের লোক দিয়ে সরাসরি মাল ডেলিভারি দেওয়া হয়।’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘জাল টাকা’ নামে একটি গ্রুপে এভাবেই ঘোষণা দিয়ে জাল টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। ক্রেতাদের যোগাযোগের জন্য সেখানে দেওয়া হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরও। শুধু এই একটি গ্রুপই নয়, এমন শত শত ফেসবুক গ্রুপ ও পেজ খুলে ঘোষণা দিয়ে চলছে জাল টাকার কেনা-বেচা।

‘জাল টাকা’ নামের ওই গ্রুপে দেওয়া মুঠোফোন নম্বরে ক্রেতা পরিচয়ে ফোন দিলে রিসিভ করেন এক যুবক। নিজের নাম রহিম মোল্লা দাবি করে তিনি বলেন, আমাদের কাছে এসএস কাগজের নোট আছে, এমএম কাগজও আছে। সর্বোচ্চ কোয়ালিটি যেটা আছে গ্লেজিং প্রিন্ট। ইন্ডিয়ান কাগজ ও সুতা।  ৫০,১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট আছে। আপনের লাগবে কোনটা?’

এ সময় দাম জানতে চাইলে ওই যুবক বলেন, ‘১০০ টাকার জাল নোটের প্রতি লাখ ৬ হাজার টাকা, ৫০০ টাকার নোট নিলে ১৪ হাজার টাকা। আর ১০০০ টাকার টাকার নোট নিলে ১২ হাজার টাকা লাগবে। আর এক লাখ ৫০ টাকার নোট নিলে লাগবে ১৮ হাজার টাকা। নিলে আপনার নাম, মোবাইল নম্বর আর সম্পূর্ণ ঠিকানা এসএমএস করে দিবেন। ইনশাল্লাহ কালকের ভিতরে আমি মাল পাঠিয়ে দিব।’

ফোনে কথোপথন শেষে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে নকল টাকার কিছু নমুনা ভিডিও পাঠিয়ে রহিম বলেন, ‘নকল হলেও দেখতে অবিকল আসলের মতোই টাকাগুলো। ব্যাংকের মেশিন ছাড়া আমাদের মাল ধরছে এমন রিপোর্ট এখন পর্যন্ত আসেনি। ভাই কোয়ালিটি দেখছেন, সব ওকে আছে। জাস্ট একটু ব্যাংকের মেশিন থেকে দূরে থাকতে হবে।’

জাল টাকার ওই কারবারি ফোনে নিজেকে রহিম মোল্লা পরিচয় দিলেও কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে তার আসল নাম সিফাত। তিনি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার যসলদিয়া গ্রামের ইছহাক শেখের ছেলে। তিনি ঢাকার কেরানীগঞ্জে একটি জুতার দোকানে কাজ করার পাশাপাশি বাড়তি আয়ের নেশায় জাল টাকার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। পরে খবর পেয়ে তাকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায়, বিভিন্ন উৎসব কিংবা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে যখন নতুন টাকার চাহিদা বাড়ে তখনই সক্রিয় হয়ে ওঠে বিশেষ একশ্রেণির চক্র। নতুন টাকার চাহিদাকে পুঁজি করে এই চক্রগুলো দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে দেয় নকল বা জাল টাকার নোট। কয়েকদিন আগেই শেষ হলো মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর, আবার সামনে ঈদুল আজহা। এমন সময় মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক লেনদেন অনেক বেড়ে যায়। এসব সুযোগকেই কাজে লাগায় অসাধু চক্রগুলো। সেসব জাল টাকার কারণে প্রায়শই আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন সাধারণ মানুষ।

জাল টাকার কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বনশ্রী এলাকার মুদি দোকানি ব্যবসার করেন কাউসার মিয়া। দোকান শুরু করার কয়েকদিনের মধ্যেই তার কাছে আসে ১ হাজার টাকার জাল নোট। কাউসার বলেন, একজন লোক দোকানে দেড় শ টাকার সদাই নিয়ে ১ হাজার টাকার নোট দেয়। আমি সে সময় বুঝতে পারিনি নোটটা জাল। পরে টাকাটা আরেকজনকে দিতে গেলে তিনি জানান, এটা আসল টাকা নয়, জাল নোট। আমি নতুন দোকান দিছি, অল্প জিনিসপত্র নিয়ে বসছি। শুরুতেই আমার ১ হাজার টাকা লস।

শুধু কাওসার মিয়াই নন, জাল টাকা নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন এরকম ভুক্তভোগীর সংখ্যা আরো অনেক। তাদেরই একজন মতিঝিল এলাকার পেট্রল পাম্পের মালিক আব্দুল সামাদ হাওলাদার। তিনি বলেন, পাম্পে প্রতিনিয়ত জাল টাকা পাচ্ছি। এর সমাধান কোথায়? কত টাকা লাভ করি? ৩০০০ টাকার তেল নিয়া একটা জাল নোট দিয়ে গেছে এটা তো বোঝা যায় না। এখানে একটা দুইটা গাড়ি আসে? দেখেন এখানে লাইন ধরে গাড়ি আসতেছে। কখন কে কোন ফাঁকে জাল টাকা দিয়া চলে চায় বোঝা যায় না। কালকেও আমি পাঁচটা নোট ছিঁড়ে ফেলছি।

জাল টাকার লেন-দেন বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশে জাল টাকার অস্তিত্ব আছে। আমরা ২০১১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে অনেক কারখানা পেয়েছি যেখানে বিভিন্ন মানের জাল টাকা ছাপানো হয়। একটা সময় ছিল অরিজিনাল টাকাকে ওয়াশ করে সেখানে ছাপানো হত। এরপর ফ্রেশ কাগজে বিভিন্ন আঠা পেস্ট করে নিরাপত্তা সুতা, জলছাপ দিয়ে কাজগুলো করেছে।  পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব সবাই মিলেই মাঝে মাঝে এদের ধরি। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে চক্রকে একবার ধরেছি সেই চক্রকে এরপরে আরো ৬-৭ বার ধরা হয়েছে।  আমরা তাদের ধরার পর বিশেস ক্ষমতায় একটি মামলা দেই। সেই মামলায় তারা একপর্যায়ে জামিন নেয়। পরবর্তীতে অন্য কোনো ভালো কাজে নিয়োজিত না থেকে আবারো একই কাজগুলো করে।

তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে প্রযুক্তির যে প্রসার ঘটেছে সেটাকে নেগেটিভলি ব্যবহার করছে বিভিন্ন চক্র। ফেসবুকের মাধ্যমে মাদকের ব্যবসা, প্রতারণা থেকে শুরু করে অনেক কিছু হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে জাল টাকার ব্যবসা নতুন সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমরা দেখেছি এটা একটা প্রতারণার ক্ষেত্র। অনেকগুলো চক্রকে আমরা ধরেছি। তারা এরকম ছবি এডিট করে অন্য জায়গা থেকে নিয়ে ছবি নিয়ে সুপার এডিট করে মানুষকে প্রলোভন দেখাচ্ছে। কেউ কিনতে চান এবং কিনতে গিয়ে তারা ধরা খেয়েছেন এবং ধরা খেয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন। আমার বিবেচনায় জাল টাকা একটি সম্পূর্ণ আইনবিরোধী, দেশবিরোধী, অর্থনীতি বিরোধী ইস্যু। এটা যারা কিনতে যাবেন তারা নিজেরাই এক ধরনের অপরাধী। যারা জাল টাকা তৈরি, পরিবহন কিংবা বিপণনে সহযোগিতা করবেন সবাই সমানভাবে অপরাধী। যারা এই জাল টাকা কেনার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করবেন তারাও সমান অপরাধী। তারা পুলিশের হাতে ধরা পড়লে তাদের কোনো রক্ষা হবে না।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে মতিঝিল বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার হায়াতুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি ইন্টারনেট ব্যবহার করে ফেসবুককেন্দ্রিক এবং কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ডেলিভারি করে বেশ কিছু জাল টাকার কারবারি কাজ করছে। এগুলো আমাদের স্পেশাল মনিটরিংয়ের মাধ্যমে একটি গ্রুপকে চিহ্নিত করি। পরবর্তীতে আমরা অভিযান চালিয়ে এই যে মাস্টার মাইন্ড তাকেসহ আমরা দুইজনকে গ্রেপ্তার করি। পরবর্তীতে আমরা তাদের মাধ্যমে আরো কিছু গ্রুপকে সনাক্ত করেছি। আমরা জানতে পারি এই চক্র ছোট নোট নিয়ে কাজ করে। ১০০ টাকা বা ৫০ টাকার নোটগুলো সাধারণত মানুষের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করে না। সেই নোটগুলো দিয়ে তারা কাজ করে। নিম্ন আয়ের মানুষকে টার্গেট করে সন্ধ্যার পরে নোটগুলো বেচাকেনা করে।

তিনি বলেন, আমরা তদন্তে পেয়েছি অনলাইনে পেজ খোলা সবাই জাল টাকার ব্যবসায়ী না। এখানে বড় একটা অংশ প্রতারণার আশ্রয় নেয়। আবার যারা ব্যবসায়ী তারাও সবাইকে টাকা সাপ্লাই দেবে এরকম নিশ্চয়তা নেই। ক্লায়েন্ট যদি নতুন হয় তখন চক্রটি টাকা না দিয়ে প্রতারণ করে, যাদের সাথে সম্পর্ক ভালো হয় তাদের জাল নোট দেওয়া হয়। থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবি, সিটি বা অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা তাদের মনিটর করছে। কোনো চক্রই পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে পারবে না। আমাদের অভিযান চলমান আছে, আশা করছি আমরা এই অপরাধ প্রবণতাটাকে কমিয়ে আনতে পারব।

LEAVE A REPLY