ইমরানকে মুক্তির নির্দেশ

পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খানের গ্রেফতারকে বেআইনি উল্লেখ করে অবিলম্বে তাকে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্ট। বৃহস্পতিবার আল কাদির ট্রাস্ট মামলায় ইমরান খানের বক্তব্য শোনার সময়ই পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল তাকে মুক্তির নির্দেশ দেন। সুপ্রিমকোর্ট বলেছেন, শুক্রবার পর্যন্ত পিটিআই প্রধানকে পুলিশ লাইনের গেস্ট হাউজে রাখা হবে। তবে তাকে সেখানে কয়েদি বলে গণ্য করা হবে না। ইসলামাবাদ পুলিশ প্রধানকে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। এ সময় তিনি সর্বোচ্চ ১০ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন। এর আগে ইমরানকে হাজির করার জন্য এক ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ। এরপরই ইমরানকে নিয়ে পাকিস্তানে নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ইমরান শিবিরে নেমে আসে স্বস্তি।

এদিকে ইমরানকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবারও সারা দেশে চলমান প্রতিবাদ বিক্ষোভ এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ১১ জন নিহত এবং ২,৫০০ জন গ্রেফতার হয়েছেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বড় বড় শহরের রাস্তায় সরকারকে সেনাবাহিনী নামাতে হয়েছে। দেশের এ অবস্থায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পিটিআইয়ের সিনিয়র নেতা আরিফ আলভী শঙ্কা জানিয়ে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব পাকিস্তানের সব পক্ষকে সহিংসতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ওপর নজর রাখলেও এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। আর ব্রিটেন ইমরান খানের গ্রেফতারের বিষয়কে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে মন্তব্য করেছে। জিও নিউজ, দি নিউজ, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন, ডন, আলজাজিরা। প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল বলেন, বেআইনিভাবে গ্রেফতার করা ইমরান খানতে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হোক। আদালত আজই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ জারি করবেন। তিনি বলেন, এ ইস্যুতে আদালত ‘খুবই সিরিয়াস’।

ইমরানের আদালতে আসার পর এজলাসে শুনানি শুরু হয়। তখন প্রধান বিচারপতি পিটিআই চেয়ারম্যানকে রোস্ট্রামে ডেকে বলেন, আপনাকে দেখে ভালো লাগছে।

বিচারপতি বান্দিয়াল বলেন, আপনার গ্রেফতারের পর দেশে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, আমরা দেশে শান্তি চাই। প্রধান বিচারপতি বলেন, বলা হচ্ছে আপনার (পিটিআই) কর্মীরা ক্ষিপ্ত হয়ে সহিংসতা চালাচ্ছে। এরপর তিনি ইমরানকে উদ্দেশ করে বলেন, আদালত আপনার বক্তব্য শুনতে চায়। শীর্ষ বিচারক পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, পিটিআই প্রধান ৯ মে ইসলামাবাদ হাইকোর্টের (এইচআইসি) বায়োমেট্রিক কোর্টরুমে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, যখন কোনো ব্যক্তি আদালতে আসেন, এর অর্থ হলো তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করছেন।

বিচারপতি বান্দিয়াল এরপর মন্তব্য করেন যে, ইমরানের গ্রেফতার ‘বেআইনি’ এবং পিটিআই প্রধানকে তিনি ইসলামাবাদ হাইকোর্টে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, আপনাকে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। প্রধান বিচারপতি এরপর বলেন, ইমরানকে আগামীকাল (শুক্রবার) আইএইচসিতে হাজির হতে হবে।

প্রধান বিচারপতি রায় ঘোষণার পর আদালতেই ইমরান বলেন, দেশের কোনো ক্ষতি করা উচিত নয়। তিনি তার সমর্থকদের শান্তিপূর্ণ থাকার নির্দেশ দেন। পিটিআই প্রধান বলেন, আইনজীবীরা একদিন আগে তাকে জানিয়েছেন যে, দেশে নৈরাজ্য শুরু হয়েছে। তিনি আরও বলেন, মানুষ ন্যায়বিচারের জন্য আদালতের শরণাপন্ন হয়। কিন্তু তাকে সেখানে অপমান আর হেনস্তা করা হয়েছে। ইমরান বলেন, একজন হত্যাকারীর সঙ্গেও মানুষ এমন আচরণ করে না।

ইমরান বলেন, দেশে কী ঘটছে সেটা তার জানা নেই। তিনি বলেন, আমাকে এমনভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে, যেন আমি একজন সন্ত্রাসী। এসব প্রতিবাদ বিক্ষোভের জন্য আমি কীভাবে দায়ী? কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে স্থানীয় সময় বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটের কিছু সময় পর ইমরান খানকে আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে উপস্থিত ডনডটকমের সংবাদদাতা জানিয়েছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বিচারকদের গেট দিয়ে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়।

আদালতে ইমরানকে হাজির করা নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট এলাকায় রেঞ্জার এবং পুলিশ, সেই সঙ্গে বোম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াড তলব করে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। শুনানি চলাকালে আদালত ভবনের এক নম্বর এজলাসে কেবল আইনজীবী এবং সাংবাদিকদেরই উপস্থিত থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। পিটিআইয়ের পক্ষ থেকে এর কর্মী-সমর্থকদের ওই এলাকা থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

এর আগে প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি মুহাম্মদ আলি মাজহার এবং বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ গঠিত তিন সদস্যের বেঞ্চ ইমরান খানকে এক ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরোকে (এনএবি) নির্দেশ দেন। ইমরান খানের আইনজীবীরা তাকে গ্রেফতারে ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরোর (এনএবি) পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ করার পর বৃহস্পতিবার শীর্ষ আদালত এ নির্দেশ দেন।

ইমরান সুপ্রিমকোর্টের জিম্মায় : পিটিআই নেতা বাবর আওয়ান বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এখন সুপ্রিমকোর্টের জিম্মায় রয়েছেন। সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশের পর ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পিটিআই চেয়ারম্যান শুক্রবার ইসলামাবাদ হাইকোর্টে হাজির হবেন। বাবর আওয়ান আরও বলেন, সুপ্রিমকোর্ট ইমরান খানের সঙ্গে ১০ জনকে থাকার অনুমতি দিয়েছেন। এ ছাড়া ইমরানের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যদেরও দেখা করার অনুমতি দিয়েছেন।

এদিকে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে পিটিআই সমর্থকদের মাঝে। পিটিআইয়ের অফিসিয়াল টুইটারেও একে স্বাগত জানানো হয়েছে। টুইটারে এক বার্তায় পিটিআই বলেছে, পাকিস্তানের জনগণ সুপ্রিমকোর্টের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে হামলা : ইমরানের মুক্তির দাবিতে বুধবার প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের লাহোরের বাসভবনে হামলা চালিয়েছিলেন পিটিআই সমর্থকরা। ভোরে এ হামলার সময় অবশ্য শাহবাজ এবং তার পরিবারের সদস্যরা বাড়িতে ছিলেন না। লাহোর পুলিশ জানিয়েছে, বুধবার ভোররাতে পিটিআইর ৫০০-র বেশি কর্মী-সমর্থক প্রধানমন্ত্রীর মডেল টাউনের বাসভবনের সামনে পৌঁছে ইমরানের মুক্তির দাবিতে স্লোগান দেওয়া শুরু করেন। তারা বাড়ির সামনে থাকা একটি গাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেন। ইমরানপন্থিরা প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির ভেতরে একাধিক পেট্রোলবোমা ছোড়েন বলেও লাহোরের এক পুলিশ কর্মকর্তা সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পৌঁছানোর আগে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন পিএমএল-এন সচিবালয়েও হামলা চালান বিক্ষুব্ধরা। সেখানেও তারা আগুন লাগিয়ে দেন। তবে পুলিশের বিশাল বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছলে বিক্ষোভকারীরা পালিয়ে যান। পুলিশ জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীরা গত দুদিনে ১৪টি সরকারি ভবন এবং ২১টি পুলিশের গাড়িতে আগুন দিয়েছেন।

সহিংসতায় জড়িত নয় পিটিআই : পাকিস্তানের চলমান সহিংসতায় পিটিআই জড়িত বলে দেশের আইএসপিআর যে বিবৃতি দিয়েছে, সেই অভিযোগ অস্বীকার করে পালটা বিবৃতি দিয়েছে ইমরান খানের দল। এতে বলা হয়েছে, আইএসপিআরের বিবৃতি প্রকৃত অবস্থার ভিত্তিতে দেওয়া হয়নি। বুধবারের বিবৃতিতে আইএসপিআর বলেছিল, পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খানকে গ্রেফতারের পর যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে সেটা ইতিহাসে ‘কালো অধ্যায়’ হিসাবে বিবেচিত হবে। পিটিআই থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমরা বিশ্বাস করি শান্তিপূর্ণ থেকেই, অহিংস এবং সংবিধান ও আইনকে সমুন্নত রেখেই আমরা লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হব। পিটিআই সব সময়ই সংবিধান এবং আইন থেকে দূরে সরার বিষয়কে নিরুৎসাহিত করেছে। এতে আরও বলা হয়, পিটিআই মনে করে ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান সবাই আইন মেনে চলতে বাধ্য।

পেশোয়ারে পিটিআই নেতারা আত্মগোপনে : খাইবার পাখতুনখোয়ার পিটিআই নেতারা সবাই গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে গেছেন। ইমরানের গ্রেফতারের প্রতিবাদে সহিংস প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় সরকার সেখানে অভিযান চালাতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেখানকার সব পিটিআই নেতারই ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমেও তাদের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বুধবার অবশ্য খাইবার পাখতুনখোয়ায় পিটিআইয়ের দায়িত্বে থাকা পারভেজ খাত্তাক প্রতিদিনই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীকে প্রেসিডেন্টের চিঠি : দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে দুঃখ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে চিঠি পাঠিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ও পিটিআইয়ের সিনিয়র নেতা আরিফ আলভী। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ইমরান খানকে যেভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে সে বিষয়ে আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। তিনি লিখেছেন, পাকিস্তানের জনগণ এবং আমি ওই ঘটনার ভিডিও দেখে ব্যথিত হয়েছি। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে হেনস্তা করা হচ্ছে। ইমরান খান একজন জনপ্রিয় নেতা, এছাড়া তিনি একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। এর আগে প্রেসিডেন্ট আরিফ দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এসব ঘটনার নিন্দা করেছিলেন।

বিষ প্রয়োগে ইমরানকে হত্যার আশঙ্কা : পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খান নিজের জীবন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, কারাগারে তাকে বিষ প্রয়োগ করে ধীরে ধীরে হত্যা করা হতে পারে। বুধবার এ শঙ্কার কথা তিনি নিজেই জানিয়েছেন বলে জিও টিভির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়।

ইমরান খান আদালতকে বলেন, কর্তৃপক্ষ এমন একটি ইনজেকশন দেয়, যা একজন ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলে। তিনি আশঙ্কায় আছেন যে, তার সঙ্গেও হয়তো এমনটা হতে পারে। আদালতে শুনানি চলাকালে ইমরান খান ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. ফয়সাল সুলতানের কাছেই চিকিৎসা নেবেন বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, মাকসুদ চাপরাসিকে যে ধরনের শাস্তিমূলক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল তার সঙ্গেও এমন কিছু হোক তিনি তা চান না।

LEAVE A REPLY