টেকনাফ হয়ে মোখার গন্তব্য মিয়ানমার!

দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর ও তত্সংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড়টি গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। আজ শুক্রবার সন্ধ্যা নাগাদ এটি অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। আগামী রবিবার সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে এটির বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করার আশঙ্কা রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র বাংলাদেশের টেকনাফের দক্ষিণ দিক দিয়ে অতিক্রম করতে পারে। ঝড়টির অন্তত অর্ধেক শরীর থাকবে বাংলাদেশের উপকূলে এবং অর্ধেক মিয়ানমারে। তবে ‘মোখা’র প্রবল অংশটি মিয়ানমারের ওপর দিয়ে যেতে পারে। ফলে বাংলাদেশের অঞ্চলে তুলনামূলক কম ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

গতকাল আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান ‘মোখা’ সম্পর্কে গণমাধ্যমের কাছে এই তথ্য তুলে ধরেন। তিনি জানান, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী জেলার ওপর মোখার প্রভাব পড়তে পারে। তবে এর শক্তিশালী অংশ ও ডান পাশ মিয়ানমারের ওপর দিয়ে যেতে পারে। ফলে বাংলাদেশের অঞ্চলগুলোতে তুলনামূলক কম ক্ষতি হতে পারে। তবে ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগের প্রভাবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলে আগামীকাল বিকেল থেকেই দমকা বাতাস ও ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে। 

আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় তাদের সর্বশেষ পূর্বাভাসে জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় মোখা আরো উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রূপে অবস্থান করছে। এটি আরো ঘনীভূত হয়ে আগামীকাল সকাল পর্যন্ত উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে এবং পরবর্তী সময়ে দিক পরিবর্তন করে ক্রমান্বয়ে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে পারে। 

আজও চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরগুলোকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ২০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ১৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ১৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ১৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ১১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর বিক্ষুব্ধ রয়েছে। 

ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ ও বাংলাদেশে প্রভাব : আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক গণমাধ্যমকে বলেন, আজ শুক্রবার সকাল নাগাদ ঘূর্ণিঝড়টি দিক পরিবর্তন করে উত্তর দিক থেকে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে যাবে। তখন এটি কক্সবাজার ও মিয়ানমারের উত্তর উপকূলের দিকে ধাবিত হবে। এটি টেকনাফ থেকে সামান্য দক্ষিণ দিক দিয়ে অতিক্রম করার আশঙ্কা আছে। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার ওপর ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়তে পারে। 

ঘূর্ণিঝড়ের গতি ও বাতাসের গতি : গতকাল বিকেল পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টি আট কিলোমিটার গতিতে এগোচ্ছিল। এর চারদিকের বাতাসের গতিবেগ ছিল ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত।

ঘূর্ণিঝড়ের গতি আগের দিন বুধবার ছিল ১৫ কিলোমিটার। গতকাল কিছুটা মন্থর হয়ে অর্ধেকে নেমে আসে। আবহাওয়াবিদরা জানান, ঘূর্ণিঝড়টি ঠিক কোন সময় আঘাত করবে, সেটি এই গতিবেগের ওপর নির্ভর করে। গতি বেড়ে যদি ১৫-১৬ কিলোমিটারে উঠে গেলে আঘাত করার সময় কিছুটা এগিয়ে আসবে। বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে অন্তত ২৪ ঘণ্টা আগে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত করার সঠিক সময় সম্পর্কে জানা যাবে, বলেন আবহাওয়াবিদরা।

পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, গতি ধীর হয়ে গেলে ঘূর্ণিঝড় শক্তি সঞ্চয় করে, ফলে তীব্রতা বাড়ে। এ কারণে মোখার প্রবল থেকে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা বেশি। ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করার সময় গতিবেগ ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার হতে পারে। সেটা দমকা বা ঝোড়ো হাওয়া আকারে ১৪৫ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

বৈশিষ্ট্য সিডরের, তবে ক্ষতি কম হওয়ার সম্ভাবনা : ঘূর্ণিঝড় সিডরের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল, মোখাও প্রায় সেই দিকেই যাচ্ছে বলে জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক। সিডরের ব্যান্ড প্যাটার্ন ও আই ফরমেশন ছিল। এই ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রেও পরিষ্কার আই ফরমেশন হতে পারে। আবহাওয়াবিদরা জানান, আই ফরমেশন ও ব্যান্ড প্যাটার্ন থাকলে ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক হয়। তবে মোখা যখন ‘তীব্র’ ও ‘অতি তীব্র’ ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেবে, তখন এটা আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে।

তবে মোখার ধরন সিডরের মতো হলেও ক্ষতি সিডরের মতো হবে না বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। সিডর অতিক্রম করেছিল বরগুনা, পাথরঘাটা দিয়ে। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রায় মাঝ বরাবর দিয়ে। ফলে ওই ঘূর্ণিঝড়ের ডান ও বাঁ উভয় পাশ বাংলাদেশের ওপর দিয়েই পার হয়েছে। আর মোখার শুধু বাঁ পাশটা টেকনাফ থেকে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী—এসব অঞ্চল পাবে। আর ডান পাশ বা তার নিচের অংশ মিয়ানমারের ওপর চলে যাবে। ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে ক্ষতিকর বা ভয়ংকর অংশ সবচেয়ে বেশি থাকে কেন্দ্রে, তারপর থাকে ডানে। সবচেয়ে কম ক্ষতিকর অংশটা থাকে বাঁয়ে। যেহেতু ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমের বাঁ পাশ দিয়ে বাংলাদেশের অঞ্চল থাকবে, সেহেতু এখানে কম ক্ষতি হবে।

জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা : জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা নির্ভর করবে ঘূর্ণিঝড়টা কোন ধরনের হয়, তার ওপর। সেই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় যখন আঘাত হানবে, তখন কি জোয়ার না ভাটা থাকবে তার ওপরও নির্ভর করে। আজিজুর রহমান বলেন, ‘এটা নিখুঁতভাবে বলতে আমাদের আরেকটু সময় লাগবে।’

‘সুপার সাইক্লোন’ কি হবে : গত বুধবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, মোখা সুপার সাইক্লোন হতে পারে। তবে আজিজুর রহমান গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা বলছি, এটা অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হবে। এর পরের ধাপ হলো সুপার সাইক্লোন, যেটার তীব্রতা থাকে হারিকেনের মতো।’ 

তাপপ্রবাহ অব্যাহত, কিছু এলাকায় বৃষ্টি হতে পারে : এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কার মধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলছে তাপপ্রবাহ। তবে গতকাল তাপপ্রবাহের তীব্রতা কিছুটা কমে এসেছে। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় রাঙামাটিতে, ৩৮.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, সন্দ্বীপ, রাঙামাটি, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী ও হাতিয়া অঞ্চলসহ ঢাকা, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আজও এই তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। এ সময় দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

তবে আগামীকাল থেকে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমে আসতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।

আজ রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি বা বজ বৃষ্টি হতে পারে।

এসএসসি পরীক্ষার মালপত্র নিরাপদে রাখার নির্দেশ : ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবের আশঙ্কা থাকায় সারা দেশের বিভিন্ন বোর্ডের অধীনে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার সব মাল নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ আন্ত শিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি।

মোকাবেলায় প্রস্তুতি : মোখার আঘাত নিয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপসহ উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর বাসিন্দাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ বিরাজ করছে। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে জলোচ্ছ্বাস ও বাতাসে ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে সেন্ট মার্টিনে। অন্যদিকে মাঝারি আকারের ঝড় বয়ে গেলেও রোহিঙ্গা শিবিরগুলো লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাব্য থাবার শঙ্কায় রয়েছে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া-মহেশখালীর দ্বীপাঞ্চলের বাসিন্দারা।

এমন পরিস্থিতিতে গতকাল কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় এক জরুরি সভায় জরুরি চিকিৎসা, উদ্ধার, ত্রাণ সহায়তা থেকে শুরু করে নানা কাজের জন্য দল গঠন করা হয়েছে। রোহিঙ্গা কমিউনিটির স্বেচ্ছাসেবক, রেড ক্রিসেন্ট স্বেচ্ছাসেবক এবং ক্যাম্প ব্যবস্থাপনায় থাকা কমিটির সব সদস্যকে আজ সকাল থেকে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি দায়িত্ব পালনের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু ক্যাম্প থেকে অন্যত্র সরে যাওয়ার তেমন বিকল্প ব্যবস্থা নেই, সে ক্ষেত্রে ক্যাম্প এলাকার সরকারি মজবুত স্থাপনাগুলোতে আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বাসিন্দাদের।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানিয়েছেন, জেলার সব উপজেলার কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। উপকূলীয় এলাকার সব সাইক্লোন শেল্টার, বিদ্যালয়সহ ৫৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

নোয়াখালীতে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবেলায় জেলা প্রশাসনের প্রস্তুতিসভায় ৪৬৩টি আশ্রয়কেন্দ্র এবং তিনটি মুজিব কিল্লা প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে।

উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরে ৬৪টি মেডিক্যাল টিম এবং ১৮৫টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হবে। দুর্যোগকালীন ত্রাণ তহবিলে আট লাখ ১২ হাজার টাকা এবং ৪২০ মেট্রিক টন চাল রয়েছে। গতকাল দুপুরে ডিসি আনোয়ার হোছাইন আকন্দ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এসব তথ্য জানিয়েছেন।

ভোলা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটের প্রশাসন ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ৬২টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে উপকূলীয় মানুষের আশ্রয় নেওয়ার জন্য।

বজ্রপাতে মৃত্যু : 

বগুড়ার ধুনট উপজেলায় বাড়ির আঙিনায় আম কুড়ানোর সময় জোহা মণ্ডল (১০) নামের একটি শিশু বজ্রপাতে মারা গেছে। শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে বজ্রপাতে অন্তর নামের নবম শ্রেণির এক ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে।

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন, কক্সবাজারের বিশেষ প্রতিনিধি; নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, সাতক্ষীরা, ফকিরহাট (বাগেরহাট), সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম) ও হিলি প্রতিনিধি)

LEAVE A REPLY