বিচারহীনতায় বিস্ফোরণে মৃত্যুর মিছিল

বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনায় দেশে মৃত্যুর মিছিল দিন দিন লম্বা হচ্ছে। শিল্পকারখানা, বাসাবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, গাড়ি সবখানেই রয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত, মর্মন্তুদ মৃত্যুঝুঁকি। নির্মমভাবে মানুষ প্রাণ হারালেও শুধু দুর্ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত হওয়ায় দায়ীরা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিস্ফোরণ ও হতাহতের কারণ উদঘাটনে গঠিত হচ্ছে তদন্ত কমিটি। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখছে না। আবার ক্ষেত্রবিশেষ তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করা হলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না সুপারিশ।

সর্বশেষ গত ১৩ মে রাজধানীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ার তেঁতুলঝড়ায় গ্যাস সিলিন্ডার মজুত ও রিফিল কারখানায় বিস্ফোরণে তিনজনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা দেশবাসীকে নাড়া দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, বিস্ফোরণজনিত মৃত্যুর ঘটনার দায় কার? কেনই বা থামানো যাচ্ছে না হৃদয়বিদারক এই মৃত্যুর মিছিল?

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে অন্তত ছয় ধরনের উৎসস্থলে বিকট বিস্ফোরণে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে দুই সহস্রাধিক মানুষ। বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিস্ফোরণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে জমাট বাঁধা গ্যাস। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে শিল্পকারখানার বয়লার, রাসায়নিক গুদাম, এয়ারকন্ডিশন, ফ্রিজ, গাড়ি ও রেস্টুরেন্টে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার, গ্যাসের চুলার ত্রুটিপূর্ণ লাইন। বিস্ফোরণের পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটায় বেড়ে যায় হতাহতের সংখ্যা।

একাধিক সূত্রে উল্লিখিত তথ্য জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শিল্প-কারখানায় বিস্ফোরণে শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় মালিককে বিচারের আওতায় আনা হয় না। নির্মম সত্য হলো, সংশোধিত শ্রম আইনে দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু হলে ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে মালিকের দায়মুক্তির ব্যবস্থা আছে। আর বাসাবাড়িতে বিস্ফোরণে মৃত্যু হলে মামলা পর্যন্ত হয় না। ফলে যেসব উৎসস্থলে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, সেগুলো যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করতে কেউ তেমন সচেতন থাকে না। তদারকি সংস্থাগুলোরও তৎপরতারও অভাব রয়েছে। সব মিলিয়ে বিচারহীনতার কারণেই বিস্ফোরণজনিত মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মানুষের অজান্তেই শয়নকক্ষে লাগানো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটিও পরিণত হচ্ছে দানবে। চলন্ত বোমা যেন গাড়িতে বসানো সিএনজি সিলিন্ডার। কারখানার বয়লার কিংবা রাসায়নিকের গুদাম একেকটি মারণাস্ত্র। বারবার এগুলোর ভয়ংকর রূপ দেখা যাচ্ছে। বিস্ফোরণে ঝরছে তাজা প্রাণ। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের ক্ষতিও হচ্ছে ব্যাপক। কিন্তু কেন এই বিস্ফোরণ?

কেন থামানো যাচ্ছে না অনাকাঙ্ক্ষিত এই মৃত্যুর মিছিল-এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, যেসব উৎসস্থল ঘিরে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে খুব বেশি সচেতন নয় মানুষ। অবহেলা ও অসতর্কতার অনিবার্য পরিণতি এমন বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনা। আবার এসব দুর্ঘটনার বিচারও হয় না।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণ ও বিস্ফোরণজনিত অগ্নিকাণ্ডে দুই সহস্রাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। বিশেষ করে চলতি বছরের মার্চ মাসে মাত্র চার দিনের ব্যবধানে ঢাকা-চট্টগ্রামে ভয়াবহ তিনটি বিস্ফোরণের ঘটনা দেশবাসীকে শঙ্কায় ফেলে দেয়। তিনটি ঘটনায়ই তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু ঘটনার দায়ে কাউকে শাস্তির আওতায় আনা হয়নি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইয়াসির আরাফাত খান তার গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, প্রতিটি দুর্ঘটনার ব্যাপ্তি আলাদা হলেও ঢাকার সায়েন্স ল্যাবের কাছের ভবন, সিদ্দিক বাজারের ভবন ও ২০২১ সালে মগবাজারের দুর্ঘটনাগুলো একই প্রকৃতির। যেখানে জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে বলে ধারণা করা যায়। এ ধরনের ঘটনাকে বলা হয় কনফাইন্ড স্পেস এক্সপ্লোশন। বদ্ধ জায়গায় গ্যাস জমে বাতাসের সঙ্গে এক্সপ্লোসিভ মিক্সচার তৈরি করলে এ ধরনের বিস্ফোরণ হতে পারে। তবে ঢাকার সায়েন্স ল্যাবের কাছের ভবনে বিস্ফোরণ হয়েছিল ভবনের তিনতলায়। ফলে চাপে দেওয়াল ভেঙে সহজে প্রশমিত হয়েছে। সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থল ভবনের বেজমেন্টে হওয়ায় নিচে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে, যাতে ভবনের সিঁড়িঘর, বেজমেন্ট ছাদ ভেঙে ওপরে এসে পাশের দেওয়াল ও ওপরতলা কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ভবনের কলামগুলো বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে পুরো ভবন ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিয়মিত বিরতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণজনিত ঘটনা ঘটছে। গত মার্চ মাসে ঢাকা-চট্টগ্রামে ভয়াবহ তিনটি বিস্ফোরণের ঘটনার স্মৃতি মানুষ না ভুলতেই ১৩ মে আশুলিয়ায় গ্যাস সিলিন্ডার রিফিল কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে তিনজন নিহত হয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ সিলিন্ডার ও অসতর্কতার কারণে এই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

একের পর এক বিস্ফোরণের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মহানগর পুলিশের বোম্ব ডিস্পোজাল ইউনিটের প্রধান এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘নানা কারণে যখন একটি আবদ্ধ ভবনে বিপুল পরিমাণ গ্যাস জমে, তখন ভবনের কক্ষগুলো একটি গ্যাস চেম্বার হিসাবে কাজ করতে পারে। এর ধারাবাহিকতায় বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট বা লাইটার ইগনিশন থেকে যে কোনো মিনিট স্পার্কিং ভবন বিস্ফোরিত করার জন্য যথেষ্ট। আর এ ধরনের বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনা এড়াতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সচেতনতা ও সতর্কতা। বিশেষ করে ভবনের মাটির নিচে অবস্থিত পানির ট্যাঙ্ক, সেপটিক ট্যাঙ্ক, গ্যাসলাইন বা সংযোগ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে এ ধরনের দুর্ঘটনা অনেকটাই রোধ করা যাবে।’

গত মার্চ মাসে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কদমরসুল এলাকায় ‘সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেড’ নামের প্ল্যান্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায়। এতে ৬ জন মারা গেছে। আহত হয় অন্তত ৩২ জন। সিলিন্ডার থেকেই ওই বিস্ফোরণের সূত্রপাত বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। তাদের ধারণা, হয়তো কোনো সিলিন্ডারের ব্লাস্টিং ক্যাপাসিটি কম ছিল। এ কারণে বিস্ফোরণ হয়ে থাকতে পারে।

পরে অবশ্য কেউ কেউ বলেছেন, সিলিন্ডারে নয়, মেয়াদোত্তীর্ণ বয়লার বিস্ফোরণেই সেখানে প্রাণহানি ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি হয়। মুহূর্তের দানবীয় বিস্ফোরণে প্ল্যান্টের চারপাশে আধা বর্গকিলোমিটার এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। শুধু এই একটি কারখানাই নয়, আশপাশের আরও কয়েকটি কারখানা ও প্রতিষ্ঠান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও দায়ীদের কোনো শাস্তি হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদনও আলোর মুখ দেখেনি।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, অক্সিজেন, রাসায়নিক, বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থ সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় মানুষের বিপদ বাড়ছে। যারা বিভিন্ন রাসায়নিক আমদানি করেন, তারা ভোক্তা পর্যায়ে পাঠানোর আগে সতর্কতা অবলম্বন করেন না। আবার দাহ্য পদার্থ ব্যবহারেও সঠিক জ্ঞান নেই অনেকের। নেই কোনো ট্রেনিংও। এসব কেমিক্যাল ব্যবহারের মৌলিক ধারণাও অনেকের মধ্যে নেই। যে কারণে বিস্ফোরণের ঘটনা বেশি ঘটে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য মতে, বড় বিস্ফোরণ ছাড়াও মাঝে মধ্যেই বাসাবাড়িতে বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের খবর পাওয়া যায়। এতেও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের বেশিরভাগই ঘটে এসিতে জমাট বাঁধা গ্যাস কিংবা লাইন ও সিলিন্ডার লিকেজের কারণে আবদ্ধ ঘরে গ্যাসের কুপে পরিণত হওয়া থেকে।

গবেষকদের মতে, গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনে জড়িত প্রতিষ্ঠান বা এসব গ্যাসের লাইন তদারকি যাদের দায়িত্বে, তাদের অবশ্যই এখানে করণীয় আছে। গ্যাস বিক্রয় ও ডিস্ট্রিবিউশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ভবনে গ্যাস-জাতীয় দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। যেমন পুরোনো গ্যাসলাইনগুলো শনাক্ত, মেরামত বা প্রতিস্থাপন করা, গ্যাস রাইজার লিকেজ নিয়মিত পরীক্ষা করা। গ্যাসে গন্ধযুক্ত রাসায়নিক মিশ্রিত করা, যাতে লিকেজ হলে সহজে শনাক্ত করা যায়। ভবনবাসীর জন্য পুরোনো পাইপলাইন মেরামত ও নিয়মিত লিকেজ পরীক্ষা করা, বদ্ধ জায়গায় গ্যাসের উপস্থিতি শনাক্তে গ্যাস সেন্সর ও অ্যালার্মের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিপুলসংখ্যক গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার হচ্ছে যানবাহনে। প্রতিটি সিলিন্ডার চলন্ত বোমা। অনেক ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহারে যাত্রীদের ঝুঁকি বাড়ায়।

বেসরকারি একটি সিএনজি কনর্ভাসন সেন্টারের ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যানবাহনে ব্যবহৃত সিএনজি সিলিন্ডার পাঁচ বছর পরপর রিটেস্টের নিয়ম থাকলেও অনেকেই তা করেন না। বিশেষ করে ভাড়ি যানবাহনের বেশিরভাগ সিলিন্ডার লাগানোর পর তারা রিটেস্ট করাতে চান না। এক্ষেত্রে তাদের ঝুঁকি বেশি।

বিশেষজ্ঞরা কারখানার বয়লার বিস্ফোরণের পেছনে দুটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন। এর একটি হলো-প্ল্যান্টে ব্যবহৃত বয়লারটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলে তা বিস্ফোরণের শঙ্কা থাকে। আবার বয়লারে জমে থাকা ‘আইস’ বা বরফের কারণেও বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তাই নিয়মিত বয়লার রক্ষণাবেক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

LEAVE A REPLY