আগামী নির্বাচন ঘিরে রাজপথ দখলে রাখতে ব্যস্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দখল কেন্দ্র করেই রাজনীতিতে বাড়ছে উত্তাপ। সরকারবিরোধী আন্দোলনে নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সক্রিয় বিএনপি। তাদের মোকাবিলায় আটঘাট বেঁধে নেমেছে ক্ষমতাসীনরা। বিএনপির কর্মসূচির দিন শান্তি সমাবেশের নামে মাঠ দখলে রাখছেন তারা। একইদিন দুদলের রাজপথের কর্মসূচি নিয়ে শুরুতে উত্তেজনা থাকলেও তা ছিল শান্তিপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বিএনপির কর্মসূচিতে বাধা দেয়নি। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পালটাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে রূপ নিচ্ছে সংঘর্ষে। খুলনা, পটুয়াখালীর পর এবার রাজধানীতেই ঘটেছে সংঘর্ষের ঘটনা।
মঙ্গলবার ধানমন্ডিতে বিএনপি ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বিকালে মহানগর দক্ষিণ বিএনপির পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পালটাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে নেতাকর্মীরা। এ সময় তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল নিক্ষেপ ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। উত্তেজিত নেতাকর্মীরা একটি বিআরটিসি বাস ভাঙচুর করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। সংঘর্ষে পুরো এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। সেখান থেকে ধানমন্ডি থানা বিএনপির সভাপতি শেখ রবিউল আলম রবিসহ অন্তত ২৫ জনকে আটক করে পুলিশ। সংঘর্ষে পুলিশসহ আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। এ সময় ধানমন্ডি, সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও নিউমার্কেট এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় পুলিশ ও বিএনপি একে অপরকে দায়ী করেছে। সংঘর্ষের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। লাঠিসোঁটা হাতে তারা সেখানে বিক্ষোভ করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানান, আগামী নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজপথের উত্তেজনা আরও বাড়বে। সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে শিগগিরই রাজপথে অলআউট নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। সরকার পতন করেই তারা ঘরে ফেরার ঘোষণা দিয়েছে। দলটির নেতারা বলছেন, তারা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দাবি আদায় করতে চান। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কর্মসূচিতে হামলার পর সুর পরিবর্তন করছেন দলটির নেতারা। তারা বলছেন, কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হলে এবার থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।
এদিকে বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলায় ক্ষমতাসীনরাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত নেতাকর্মীদের রাজপথে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও বা জানমালের ক্ষতি করা হলে কঠোর জবাব দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন ক্ষসতাসীন দলের নেতারা। মঙ্গলবার এক প্রতিবাদ সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগ কাউকে আক্রমণ করবে না। তবে আক্রান্ত হলে পালটা জবাব দেবে। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপিকে মোকাবিলায় কঠোর হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। এতদিন বিএনপির কর্মসূচি পালনে সহায়তা করা হলেও সম্প্রতি তারা সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে। অনেক জায়গায় কর্মসূচি পালন করতেই দেওয়া হচ্ছে না। করতে চাইলে হামলা চালানোর অভিযোগ করছে বিএনপি। শুধু কর্মসূচি পালনে বাধা নয়, বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতারেও চলছে অভিযান। দলের সক্রিয় নেতাদের টার্গেট করে প্রতিরাতেই এ অভিযান চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোতে রাজপথে ভয়াবহ সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন সাধারণ মানুষ। তারাও আছেন আতঙ্কে।
গতকাল ধানমন্ডির সংঘর্ষে একে অপরকে দায়ী করছে পুলিশ ও বিএনপি। এ প্রসঙ্গে ডিএমপির রমনা জোনের ডিসি মো. আশরাফ হোসেন বলেন, কর্মসূচির শুরুতে সবাই শান্তিপূর্ণ অবস্থানে ছিলেন। কিন্তু কর্মসূচির শেষের দিকে বিএনপির সিনিয়র নেতারা চলে গেলে উচ্ছৃঙ্খল কিছু নেতাকর্মী পরিকল্পিতভাবে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে লাঠি নিয়ে অতর্কিত হামলা চালায়। ভাঙচুর করে বিআরটিসির একটি দ্বিতল বাসও। সায়েন্স ল্যাবে অবস্থিত পুলিশ বক্সেও হামলা চালায়। পরে জানমাল রক্ষায় পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ডিসি আরও বলেন, এই সংঘর্ষে আমাদের বেশ কিছু পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি তারা না ঘটালেও পারত। ঘটনাস্থল থেকে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম বলেন, আমাদের পদযাত্রা ছিল শান্তিপূর্ণ। ল্যাবএইডের কাছে কর্মসূচি শেষ করে নেতাকর্মীদের নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যেতে বলি। আমরাও চলে আসি। এরপরই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আমাদের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে, পুলিশের হামলায় আহত হয়েছেন অনেকে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের সামনে থেকে আমরা যখন বেলা আড়াইটায় পদযাত্রা শুরু করব তখনই সেখান থেকে আমাদের দুই নেতাকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। আমরা কোনো সমাবেশ না করে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়ে পদযাত্রা শুরু করি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, গায়েবি মামলায় নির্বিচারে গ্রেফতার, মিথ্যা মামলা, পুলিশি হয়রানি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, লোডশেডিং, সরকারের সর্বগ্রাসী দুর্নীতির প্রতিবাদসহ ১০ দফা দাবিতে ধানমন্ডিতে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে পদযাত্রা শুরু করে বিএনপি নেতাকর্মীরা। পদযাত্রা সাতমসজিদ রোড, সীমান্ত স্কয়ার, ঢাকা সিটি কলেজ, সায়েন্স ল্যাব, বাটা সিগন্যাল হয়ে কাঁটাবন মসজিদের সামনে গিয়ে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পদযাত্রাটি সিটি কলেজের সামনে আসার পর পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে তা আটকে দেয়। এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কর্মসূচি সমাপ্ত ঘোষণা করেন। পরে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আব্দুস সালাম ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম রবি নেতাকর্মীদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তবে মিছিলের মধ্যভাগ থেকে উপস্থিত নেতাকর্মীরা পুলিশ ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যেতে চাইলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। নেতাকর্মীরা ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এতে প্রথমে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। পরে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও ফাঁকা গুলি শুরু করে। নেতাকর্মীরা আশপাশের গলিতে অবস্থান নিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। এ সময় ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন ছোটাছুটি শুরু করেন। ঘটনাস্থল থেকে শেখ রবিউল আলম রবিকে আটক করা হয়। কিছুক্ষণ পর তারা আবারও জড়ো হয়ে ‘ফখরুদ্দিন কনভেনশন সেন্টার’-এর সামনে দাঁড়ানো একটি যাত্রীবাহী বিআরটিসি গাড়িতে প্রথমে ভাঙচুর এবং পরে অগ্নিসংযোগ করেন। গাড়িতে একটি সিটে আগুন লেগে যাওয়ার পরপরই উপস্থিত পুলিশ সদস্য এবং গাড়ির লোকজন তা নিভিয়ে ফেলে। এর বাইরে ল্যাবএইড হাসপাতাল মোড়ে পুলিশ বক্স ভাঙচুর করে উত্তেজিত নেতাকর্মীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা মিছিল বের করে। মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের কারও কারও হাতে লাঠিসোঁটা দেখা যায়। কয়েকজনের মাথায় হেলমেটও ছিল। এর আগে বিএনপির এ কর্মসূচি ঘিরে দুপুরের পর থেকেই মহানগর দক্ষিণের বিভিন্ন স্থান থেকে থানা-ওয়ার্ড ও ইউনিট পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ধানমন্ডি এলাকায় জড়ো হতে থাকেন। দুপুর পৌনে তিনটার দিকে প্রধান অতিথির সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, শিগগিরই সরকার পতনের আন্দোলনের ঘোষণা করা হবে। তাদের লড়াই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, এ লড়াই দেশের মানুষকে দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। পাশাপাশি লড়াই হবে তাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করার। রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি দাবি আদায় করে নেবে।
পদযাত্রায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ফজলুল হক মিলন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, রকিবুল ইসলাম বকুল, ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীম, মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজ, শামীমুর রহমান শামীম, যুবদলের সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, নুরুল ইসলাম নয়ন, মহানগর নেতা তানভীর আহমেদ রবিন, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদির ভুঁইয়া জুয়েলসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী অংশ নেন। এদিকে একই দাবিতে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির উদ্যোগে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করা হয়। গাবতলী থেকে শুরু করে আগারগাঁও গিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয় এ পদযাত্রা। গাবতলীর খালেক এন্টারপ্রাইজের সামনে পদযাত্রাপূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
এ সময় নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছি। এটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। সেই কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার অধিকার কারও নেই। কিন্তু এ ফ্যাসিস্ট সরকার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও বাধা দিচ্ছে। কথা বলার কারণে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে। এভাবে দেশ চলতে পারে না। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানে এ সরকারকে বিদায় করা হবে। মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান বলেন, আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বারবার হামলা চালালেও আমরা প্রতিরোধ করিনি। কিন্তু এখন থেকে হামলা এলে পালটা প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।
পদযাত্রায় অংশ নেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব, তাবিথ আউয়াল, কামরুজ্জামান রতন, মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, সদস্য সচিব আমিনুল হক, যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা মামুন হাসান, মাহবুবুল হাসান ভুঁইয়া পিংকু, মহানগর উত্তরের নেতা জিয়াউর রহমানসহ উত্তরের বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা।