দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য রুখতে হবে

সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, অবৈধ দখলসহ দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের উদ্যোগ যৌক্তিক। দেশি-বিদেশি সব নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানে সরকার তৎপর। তবুও সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে হাতেগোনা কিছু দুর্বৃত্তের হীন কৌশলে অপরাধের মাত্রিকতা, কৌশলগত পরিবর্তন সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ আবশ্যক।

অতি সম্প্রতি হত্যা-আত্মহত্যা, চুরি-ডাকাতি, দস্যুতা-কিশোর গ্যাংয়র অপরাধ, মাদক ব্যবসা, অস্ত্রের অপব্যবহার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারে বিভিন্ন সামাজিক অপরাধ পুরো সমাজকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। গত কয়েক বছরে ক্যাসিনো দুর্নীতি, অসামাজিক কার্যক্রমে অবৈধ আধিপত্য, ক্ষমতার যথেচ্ছাচার, বন ও জলদস্যু, টেন্ডার বাণিজ্যসহ সব অপকর্মে জড়িত ব্যক্তি-গোষ্ঠীর হাজার হাজার কোটি টাকার অনৈতিক উপার্জন এবং বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনা সম্পর্কে দেশবাসীসহ সমগ্র বিশ্ব সম্যক অবহিত রয়েছে।

উল্লেখ্য, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের অনেকেই আইনের আওতায় এলেও প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ফলে দেশে অপরাধপ্রবণতা হ্রাসের বিপরীতে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২৪ জানুয়ারি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঢাকা মহানগর পুলিশের মামলার উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাজধানীতে ২০২২ সালে বিভিন্ন অপরাধে মামলা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৪৯টি, যা আগের বছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি। ২০২১ সালের ৫০ হাজার অপরাধী গ্রেফতারের বিপরীতে ২০২২ সালে গ্রেফতার হয়েছে ৬১ হাজার ৪৯৪ জন। ২০২২ সালে খুন হয়েছে ১৭৩ জন।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অপরাধপ্রবণতায় পুরুষের পাশাপাশি নারীর আধিক্যও পরিলক্ষিত হচ্ছে। অপরাধ চক্রে নারী অপরাধীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। সাধারণ নারীর পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সেলিব্রেটি নারী অপরাধীর সংখ্যাও। গত দুই-তিন বছর যাবৎ দেশের শোবিজ এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিত প্রভাবশালী নারীদের অপরাধপ্রবণতার সংবাদ গণমাধ্যমে পরিবেশিত হচ্ছে। অধিকাংশ নারী অপরাধী এখনো দৃশ্যপটের আড়ালে রয়ে গেছে বলেই বিভিন্ন সূত্রের দাবি।

আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মতে, শোবিজে পরিচিতদের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই কিছু মানুষ আকৃষ্ট হন এবং তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চান। আর এটিকেই পুঁজি করে কেউ কেউ অপরাধ চক্রে জড়িয়ে পড়েন। তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণা, জালিয়াতি, ছলচাতুরী, অভিনয়শৈলী, দুর্নীতি ও অনৈতিক আর্থিক সংশ্লিষ্টতায় সাইবার ক্রাইমসহ গুরুতর অপরাধের নানামুখী অভিযোগ রয়েছে। লবিং-তদবির বাণিজ্যে সিদ্ধহস্ত স্বল্পসংখ্যক কদর্য চরিত্রের নারীর নানা অপকৌশলে সর্বত্রই ম্যানেজ অপসংস্কৃতিতে সমাজ আক্রান্ত।

এসব অপকর্মের দায়ভার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পড়ছে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের ওপর। যদিও এদের বড় অংশ নানাভাবে সরকারের সুবিধাভোগী হয়ে অদৃশ্য যোগসাজশে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত বলে গুঞ্জন রয়েছে।

গত ৬ জানুয়ারি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাস করছে প্রায় ১৫ হাজার বিদেশি নাগরিক। এদের মধ্যে প্রায় ৫ হাজার বিদেশির বিরুদ্ধে নানামুখী অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সংবাদ বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে পরিবেশিত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। পরবর্তীকালে জামিন নিয়ে অনেকেই পুনরায় অপরাধকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এসব বিদেশি বাংলাদেশে এসেই পাসপোর্ট নষ্ট করে ফেলে।

ঢাকায় ওইসব দেশের দূতাবাস না থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে তাদের সহায়তা করা সম্ভব হয় না। এ সুযোগের অপব্যবহার করে ওইসব দেশের অপরাধী বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ফেসবুকে উপহার পাঠানোর নামে প্রতারণা, হেরোইন-কোকেনসহ অপ্রচলিত মাদকের কারবার, ব্যাংকের এটিএম বুথ-ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, জাল ডলার-অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, সোনা চোরাচালান, অনলাইন ক্যাসিনো এবং মানব পাচারে জড়িত থাকার অপরাধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত তিন বছরে দুই শতাধিক বিদেশি অপরাধীকে গ্রেফতার করেছে।

নাইজেরিয়া, ঘানা, সেনেগাল, ক্যামেরুন, লাইবেরিয়া, কেনিয়া, চাঁদসহ আফ্রিকার ১০টি দেশের ৫ হাজার নাগরিক এদেশে অবৈধভাবে বসবাস করে ভয়ংকর প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। এ ছাড়া ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, চীন ও তাইওয়ানের কয়েক হাজার অবৈধ নাগরিকের বিরুদ্ধেও আছে একই ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অপরাধ তদন্ত বিভাগের কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, গ্রেফতারকৃত আফ্রিকানদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না বলে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে বা চার্জশিট দিতে গিয়েও নানা ঝামেলা পোহাতে হয়।

দেশে সাইবার অপরাধীরা অত্যন্ত শক্তিশালী। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য চুরি-বিকৃতি, মানি লন্ডারিং, জালিয়াতি, ব্ল্যাকমেইল ইত্যাদি কর্মকাণ্ডকে সাধারণত সাইবার অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়। মূলত ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংঘটিত সব ধরনের অপরাধই সাইবার অপরাধের অন্তর্ভুক্ত। সাইবার অপরাধের একবারে প্রথম পর্যায়ে রয়েছে হ্যাকিং।

কম্পিউটার, মোবাইল বা অন্য যে কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস, সোশ্যাল অ্যাকাউন্ট, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট বা ই-কমার্স ওয়েবসাইটের তথ্য বা ক্রেডিট কার্ডের নম্বর হ্যাকিংয়ের কারণে প্রতিনিয়ত ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে মানুষ। বিভিন্ন পর্নোসাইটে ভিজিটকারী ব্যক্তির ডিভাইস ক্ষতিকর কম্পিউটার ভাইরাস দিয়ে যে কোনো সময় হ্যাকাররা হ্যাক করে ফেলে। মাদক থেকে শুরু করে নারী-শিশু পাচার সবই এখন ইন্টারনেট প্রক্রিয়ায় সংঘটিত হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী মাদক ব্যবসায়ীরা অতি গোপনে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মাদকদ্রব্যের ক্রয়-বিক্রয় করে যাচ্ছে। গত ২০ মে গণমাধ্যমে প্রকাশিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের ‘বাংলাদেশ সাইবার অপরাধপ্রবণতা-২০২৩’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে দেশে অভিনব কৌশলে সংঘটিত নিত্যনতুন সাইবার অপরাধের মাত্রা ব্যাপক হারে বৃদ্ধির চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে, যা প্রচলিত বিভিন্ন অপরাধের ধরন থেকে ব্যতিক্রম। ওই প্রতিবেদনে এগুলোকে ‘অন্যান্য’ হিসাবে উল্লেখ্য করা হয়েছে। ২০২২ সালের প্রতিবেদনে অন্যান্য ক্যাটাগরিতে ১ দশমিক ৮১ শতাংশ অপরাধের বিপরীতে ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে এটি ২৮১ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেড়ে ৬ দশমিক ৯১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

দেশবাসী অবগত আছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ের উপসর্গ হিসাবে দেখা দিয়েছে কিশোর অপরাধ বা কিশোর গ্যাং অপসংস্কৃতি। দেশের নগর-শহর, জেলা-উপজেলাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ অপসংস্কৃতির বিস্তার ইতোমধ্যে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন, গবেষণার ফলাফল ও জনশ্রুতি অনুসারে পারিবারিক-সামাজিক-ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব, অপরাজনীতির কদর্য প্রভাব বা আধিপত্য বিস্তারের অপচেষ্টা, অনৈতিক-অবৈধ পন্থায় বিভিন্ন দল-প্রতিষ্ঠানে অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তিদের পদ-পদায়ন এবং জঙ্গি-সন্ত্রাসী-মাদকসেবী-দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের প্রভাবে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। নিম্ন, মধ্য ও উচ্চবিত্তের সন্তানদের অনেকেই অবলীলায় এ অপসংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়ছে।

একদিকে রাতারাতি বা স্বল্প সময়ের মধ্যে অনৈতিক প্রাচুর্যের ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তির ব্যাপক দূরত্বের সাংঘর্ষিক মিথস্ক্রিয়া এ অপসংস্কৃতিকে প্রগাঢ় করছে।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে নিম্নতম পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মেধা-সততা-নৈতিকতা-দেশপ্রেমশূন্য অযোগ্য-অপদার্থ ব্যক্তিদের কথিত সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে পদ-পদবি-পদক দখলের ঘৃণ্য দৃশ্যপট সচেতন মহলকে হতবাক করছে। কিন্তু অজানা কারণে মহলবিশেষ এসব আমলে নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করছে না। এদের বিত্ত-বৈভবের উন্মত্ততায় কোমলমতি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা যারপরনাই শঙ্কিত।

এর ফলে সমাজে আদর্শ ও মূল্যবোধের অনুশীলন নিম্নতম পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা অবুঝ কিশোর-কিশোরীদের প্রভাবিত করছে। গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, ঢাকা শহরে ৮০টি কিশোর গ্যাং রয়েছে, যাদের সদস্য সংখ্যা তিন শতাধিক। ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে কিশোর অপরাধসংশ্লিষ্ট মামলা হয়েছে ৪৬টি। চট্টগ্রামে ১৬টি থানা এলাকায় বিভিন্ন নামে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশতাধিক কিশোর গ্যাং। বর্তমান সময়ে দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-নেতার ছত্রছায়ায় অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থের বদৌলতে এসব গ্রুপের সদস্যরা চরম বেপরোয়া আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। গত ৮ মে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে সংঘটিত জোড়া খুনের ঘটনায়ও এর দৃষ্টান্ত মেলে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন শাখা নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত করলেও গুটিকয়েক অর্থলিপ্সু কর্মকর্তার হীন স্বার্থে শতভাগ সফলতা অর্জিত হচ্ছে না। গত ৩ মে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেছেন, ‘অপরাধ যে বা যারাই করুক না কেন, তাদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। অপরাধী যেই হোক তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলার স্বাভাবিক গতি কেউ ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

চলতি বছরের ৯ মার্চ র‌্যাবের ১৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত দরবারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিশোর গ্যাং দমনে র‌্যাবের ভূয়সী প্রশংসা করে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের পাশাপাশি বাবা-মাকে সবচেয়ে বড় দায়িত্ববান হওয়ার আহ্বান জানান। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এসব নির্দেশনা আশাব্যঞ্জক। এর বাস্তবায়ন জরুরি। সন্ত্রাসী ও অরাজক সৃষ্টিকারীদের প্ররোচনা-অর্থ-মদদদাতাদের চিহ্নিত করে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে দেশ কঠিন সংকটে নিপতিত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে বলে বিজ্ঞজনের ধারণা।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY