শক্তি-সমর্থনের জানান দিয়ে নিজের শহরে ফিরলেন মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ। মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হয়ে ঢাকায় যাওয়ার ৭০ দিন পর বৃহস্পতিবার অনেকটা রাজকীয়ভাবে ফেরেন তিনি।
সঙ্গে ছিলেন মামাতো ভাই যুবলীগ চেয়ারম্যান ফজলে শামস্ পরশসহ সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতারা। এ সময় রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে রঙিন ধোঁয়া উড়িয়ে-ফুল ছিটিয়ে তাকে স্বাগত জানান অনুসারীরা।
হাজারের বেশি মোটরসাইকেল আর অর্ধশতাধিক গাড়ির বহর নিয়ে সাদিকের ফেরায় ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড় চলছে নগরে। এদিকে সাদিকের এই প্রত্যাবর্তনে খুব একটা খুশি নন, নতুন মেয়র খোকন সেরনিয়াবাতের অনুসারীরা। আওয়ামী লীগ নেতা মীর আমিন উদ্দিন মোহন বলেন, ‘কেবল এটুকু জানি যে, বরিশালকে আর অন্ধকারে ফিরতে দেব না আমরা।’
দলীয় মনোনয়নের আশায় ১২ এপ্রিল ঢাকায় যান মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ। নানাভাবে লবিং তদবির করার পরও মনোনয়ন পাননি। নৌকা দেওয়া হয় তার চাচা খোকন সেরনিয়াবাতকে। খোকনের এই প্রাপ্তির পর বরিশালে প্রথমবারের মতো স্পষ্ট হয় চাচা-ভাতিজা তথা এই দুই পরিবারের দ্বন্দ্বের বিষয়টি।
সাদিকবিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনি কার্যক্রম চালান খোকন। প্রচারের পুরো সময় সাদিকবিরোধিতাকেই প্রাধান্য দেন খোকন সেরনিয়াবাত। তার কর্মী-সমর্থকরাও চালায় সাদিকবিরোধী প্রচারণা। এমনকি মেয়র সাদিককে আর বরিশালে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলেও ঘোষণা দেন তারা। সাদিক বরিশালে এলে নৌকার ভোট কমবে-এ জাতীয় কথা সরাসরি মিডিয়ায় বলেন নৌকার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যরা।
এসবের কারণে নগরে কোণঠাসা হয়ে পড়েন সাদিক অনুসারীরা। ভোল পালটে প্রশাসনও অবস্থান নেয় সাদিক সমর্থকদের বিরুদ্ধে। নানাভাবে হয়রানির পাশাপাশি গ্রেফতার হয়ে জেলে যান মহানগর ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক আহ্বায়ক রইস মান্নাসহ সাদিক অনুসারী ১৩ নেতা-কর্মী। অবস্থার প্রেক্ষিতে বরিশালে না এলেও ঢাকায় থেকে দেওয়া ভার্চুয়াল বক্তব্যে নৌকার পক্ষে কাজ করতে নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক সাদিক। যদিও তার এই নির্দেশ লোক দেখানো বলে প্রচার করেন খোকন অনুসারীরা।
সাদিক না এলেও তার বাবা পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি নির্বাচনের প্রায় পুরোটা সময় থাকেন বরিশালের গৌরনদীতে। সিটি নির্বাচন সমন্বয়ে কেন্দ্রের করা টিমের প্রধান হিসাবে কাজ করেন নৌকার পক্ষে।
১২ জুনের নির্বাচনে রেকর্ড ভোট পেয়ে মেয়র হন খোকন সেরনিয়াবাত। সাদিকপন্থিদের দাবি, ‘সবার সম্মিলিত চেষ্টার ফসল এই বিজয়।’ অপরদিকে খোকন অনুসারীরা বলেন, ‘সাদিককে ঠেকাতে বিএনপির লোকজনও এবার নৌকায় ভোট দিয়েছে। যে কারণে এত বিপুল ভোট পেয়েছে নৌকা।’
নির্বাচন সম্পন্নের পর থেকেই ‘ফিরছেন সাদিক’ এমন গুঞ্জন ওঠে বরিশালে। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি জেলা চেয়ারম্যান এ্যাড. একেএম জাহাঙ্গীরের দেওয়া এক বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘সুইজারল্যান্ড থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর বরিশালে আসবেন মেয়র সাদিক। তিনি আসলে সবাই মিলে একসঙ্গে যাব নতুন মেয়রকে শুভেচ্ছা জানাতে।’ এরপরই আলোচনার ঝড় ওঠে চায়ের কাপে। সব আলোচনার অবসান ঘটিয়ে বৃহস্পতিবার বরিশাল ফিরেন সাদিক।
দুপুর আড়াইটা নাগাদ ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক ধরে মাদারীপুরের কালকিনি পার হয়ে গৌরনদীর টরকি এলাকায় পৌঁছায় সাদিকের গাড়িবহর। সেখানে তাকে প্রথম জানান বরিশাল জেলা ও মহানগর যুবলীগের নেতারা। সাদিকের সঙ্গে বহরে থাকা যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, কেন্দ্রীয় যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক বদিউল আলম এবং দুই সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী মাজাহারুল ইসলাম ও জহির উদ্দিন খসরুকেও স্বাগত জানান তারা।
এরপর সহস্রাধিক মোটরসাইকেল আর গাড়ির বহর নিয়ে বরিশালে পৌঁছার পথে অন্তত ১০ জায়গায় থামিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয় তাদের। বিকাল ৪টায় নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল হয়ে বরিশাল নগরে ঢোকে সাদিক ও পরশকে বহনকারী গাড়ির বহর। বিএম কলেজ এলাকায় তাদেরকে স্বাগত জানানো হয় রঙিন ধোঁয়া উড়িয়ে ও ফুল ছিটিয়ে। এরপর তারা সরাসরি চলে যান কালীবাড়ি রোডস্থ সেরনিয়াবাত ভবনে। সাদিকের ফেরার খবর পেয়ে সেখানে জড়ো হন কয়েক হাজার নেতা-কর্মী।
উপস্থিত ছিলেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি অ্যাড. তালুকদার মো. ইউনুস, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি জেলা চেয়ারম্যান অ্যাড. জাহাঙ্গীর এবং সদর উপজেলা চেয়ারম্যান চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমান রিন্টুসহ অন্য নেতারা। সেখানে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে যেকোনো পরিস্থিতিতে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান মেয়র সাদিক।
উপস্থিত সবার উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে যুবলীগ চেয়ারম্যান পরশ বলেন, ‘আপনাদের সবার ঐক্যবদ্ধ চেষ্টায়ই আজ বরিশালে নৌকা জয়লাভ করেছে। এই ঐক্য ধরে রাখতে হবে। সবার আগে দেশ। জাতির পিতার দেখানো পথে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে চলব আমরা।’
এদিকে মেয়র সাদিকের বরিশালে আসার বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খোকন সেরনিয়াবাতের নির্বাচন পরিচালনার কমিটির সদস্য মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দিন মোহন।
তিনি বলেন, ‘এখনও বরিশালের মেয়র সাদিক। যতদূর জানি নভেম্বর পর্যন্ত থাকবেন দায়িত্বে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি বরিশালে আসতে পারেন। তবে আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। তার প্রতিটি পদক্ষেপে খেয়াল রাখব। কোনো অবস্থাতেই বরিশালকে আর অন্ধকার যুগে ফিরতে দেওয়া হবে না।’