নিত্যপণ্যের বাজারে অর্থনীতির নিয়ম অচল। এখানে কার্যকর সিন্ডিকেটের বিধিবিধান। এই চক্রটি নিজেদের পকেট ভারী করতে যখন-তখন, যেমন খুশি তেমনভাবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে থাকে। এর মাধ্যমে ভোক্তাকে জিম্মি করে বেআইনিভাবে নিজেরা লাভবান হয়।
আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হলেও প্রশাসন বা ভোক্তার স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত সরকারের নির্দিষ্ট সংস্থাগুলোও এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। উলটো তারা নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে। খোদ বাণিজ্যমন্ত্রীও প্রকাশ্যেই এই সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা স্বীকার করেছেন। বলেছেন, ‘তারা (সিন্ডিকেট) নিত্যপণ্যের বড় ব্যবসায়ী। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে বাজার থেকে সব পণ্য উধাও হয়ে যাবে। তখন ভোক্তা আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে।
এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে কি সিন্ডিকেটের কাছে সবাই জিম্মি হয়েই থাকবে। সিন্ডিকেট ভাঙার দায়িত্ব কে নেবে? সরকারের এত বড় প্রশাসনযন্ত্রও কি তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে? এ প্রসঙ্গে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, বাজার সিন্ডিকেটের হাতে ভোক্তা জিম্মি। পণ্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে সেই চক্র খুব শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে ভোক্তাকে নাজেহাল করছে। তারা চিহ্নিত। অনেক সময় সরকারের একাধিক সংস্থা তাদের চিহ্নিত করেছে।
সরকারের একাধিক মন্ত্রী এই সিন্ডিকেট থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। যে কারণে তারা বারংবার ভোক্তাকে ঠকাচ্ছে। তাই এ থেকে ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে হলে সরকারের একাধিক সংস্থার নিজস্ব আইন আছে, সেই আইনের আওতায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। কারণ, এই সিন্ডিকেট ভাঙার দায়িত্ব যেমন সরকারের, তেমনই ভোক্তাকে সঠিক দামে পণ্য কেনার সুযোগ নিশ্চিত করার দায়িত্বও সরকারের।
তিনি আরও বলেন, তবে এটাও সত্য-এই পরিস্থিতিতে শক্ত অবস্থান নেওয়া না হলে সেই চক্র বাজারে পণ্যের সংকট সৃষ্টি করতে পারে। তাই দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রাইভেট কোম্পানির মাধ্যমে যদি পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব না হয়, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে পণ্যের সরবরাহ প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাহলে কোনো সিন্ডিকেট কার্যকর হবে না।
সূত্র জানায়, দীর্ঘ সময় ধরেই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা হচ্ছে। মাঠ প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ নিত্যপণ্য নিয়ে কারা কারসাজি করে, তাদের শনাক্ত করেছে। তাদের একাধিক তালিকা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। গণমাধ্যমেও এসব তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। তারপরও সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
এই সিন্ডিকেটের কারণে চালের ভরা মৌসুমেও দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার নজির রয়েছে। ২০২১ সালের এপ্রিলে বাজারে নতুন চাল আসার পর মে মাসের শুরু থেকেই এর দাম অস্বাভাবিক গতিতে বাড়াতে থাকে। ওই সময়ে চাহিদার চেয়ে চালের মজুত বেশি ছিল ৩০ লাখ টন। এরপরও চালের দাম কেজিতে গড়ে ৫ থেকে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১৩ মে থেকে ৩০ জুন ৪৯ দিনে ভোক্তার পকেট থেকে ১ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।
গত বছর কারসাজি করে সয়াবিন তেলের মাত্রাতিরিক্ত দাম বাড়িয়েছে মজুতদাররা। এতে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মাঝামাঝি দেড় মাসে ভোক্তার পকেট থেকে বেরিয়ে গেছে গড়ে অতিরিক্ত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এই টাকার বড় অংশই গেছে মিলার ও পাইকারদের কাছে।
এপ্রিলের শেষদিকে যখন পেঁয়াজের কেজি ৪০ টাকা, তখনও সব স্তরের ব্যবসায়ী নিজেদের মুনাফা ধরে তা বিক্রি করতেন। হঠাৎ মে মাসের শুরুর দিকে এর দাম কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৮০ থেকে ৯০ টাকা বিক্রি শুরু হয়। ওই সময়ে চক্রটি কারসাজি করে অতিরিক্ত মুনাফা করেছে। ওই সময়ে চক্রটি ৩০ দিনে ভোক্তার পকেট থেকে অতিরিক্ত ৮১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
গত রোজায় শসার কেজি ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা। কোনো কারণ ছাড়াই ঈদের পর তা বেড়ে একলাফে ১২০ টাকা কেজিতে ওঠে। ওই সময়ও চক্রটি ভোক্তার পকেট থেকে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সিন্ডিকেটের কারসাজিতে চাল, সবজির দাম বাড়লেও কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল্য পাচ্ছে না।
সাম্প্রতিক সময়ে মসলার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। কোনো কোনো মসলার দাম দ্বিগুণ-তিনগুণ বেড়েছে। ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে এসব পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে ২৯ শতাংশ। মসলার দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ৬০০ শতাংশ। ৩৩৫ টাকা কেজির জিরা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকায়, ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজির আদা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। ২৫০ টাকা কেজির কিশমিশ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকায়। ৫০০ টাকা কেজির গোলমরিচ এখন আড়াই হাজার টাকা কেজি। এভাবে বিভিন্ন সময়ে একক পণ্য টার্গেট করে তারা দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার যেভাবে বাড়ছে, এর প্রধান কারণ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এটি না কমাতে পারলে মূল্যস্ফীতি কমবে না। ফলে সিন্ডিকেট ভেঙে দ্রব্যমূল্য কমাতে সরকারকে বেশি জোর দিতে হবে। তা না হলে মূল্যস্ফীতির হার কমানো যাবে না। বর্তমানে টাকার প্রবাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে গিয়ে মানুষের আয় কমে যাবে। এতে আরও বেশি ক্ষতি হবে। ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এভাবে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভোক্তার পকেট কাটার মহোৎসব কতদিন চলবে। এটি বেশি দিন চলতে দেওয়া যায় না।
এদিকে সোমবার সংসদে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নামে অর্থ বরাদ্দের বিল পাশ করার সময় বিষয়টি নিয়ে জাতীয় পার্টি ও গণফোরামের সদস্যরা তীব্র আপত্তি জানান। তারা সিন্ডিকেটের কারসাজির সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী জড়িত বলেও অভিযোগ করেন। কারণ, বাণিজ্যমন্ত্রী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। এজন্য তারা মন্ত্রীর পদত্যাগও দাবি করেন।
জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, নিত্যপণ্য নিয়ে ব্যবসা করে বড় গ্রুপগুলো। তাদের বিরুদ্ধে জেল-জরিমানা করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে হঠাৎ করে ক্রাইসিস আরও বেড়ে যাবে। তখন জনগণের কষ্ট আরও বেশি হবে। এ কারণে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের চেষ্টা করা হয়।
এর আগে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার বলেছিলেন, মন্ত্রীদের ভেতরেও একটি সিন্ডিকেট আছে। তারা সব খাতেই প্রভাব বিস্তার করে।
অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী চাহিদার তুলনায় কোনো পণ্যের সরবরাহ বা উৎপাদন বেশি হলে এর দাম কমবে, আবার উৎপাদন বা সরবরাহ কমে গেলে তার দাম বাড়বে। কিন্তু বাংলাদেশে অর্থনীতির এ নিয়ম অচল। এখানে সিন্ডিকেটের নিয়মই সচল। তারা যখন যা মনে করবে, তার দাম বাড়বে। এর মধ্য দিয়ে ভোক্তার পকেট থেকে হাতিয়ে নেবে মোটা অঙ্কের টাকা। অনেকের অভিযোগ, এ টাকা কি শুধু সিন্ডিকেটের পকেটেই যায়। নাকি প্রশাসন থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক পর্যন্ত পদে পদে দিতে হয়। যে কারণে সিন্ডিকেট আইনের তোয়াক্কা করে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. এম কে মুজেরি বলেন, পণ্যের দাম হঠাৎ করে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এর জন্য একটি কাঠামো থাকতে হয়। এই কাঠামোর মধ্যে থেকে ব্যবসা করতে হয়। বাংলাদেশে এখনো এই কাঠামো গড়ে ওঠেনি। যে কারণে ভোক্তাকে ঠকাতে একাধিক সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। এটি সরকারের জানাশোনার মধ্যেই গড়ে ওঠে। তারা যে মুনাফা করে, সেটির ভাগ অনেকে পায় বলে শোনা যায়।
তিনি আরও বলেন, ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে সিন্ডিকেট ভাঙাটা জরুরি। এটি সরকারেরই দায়িত্ব। এজন্য সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত বছর ভোজ্যতেল নিয়ে আমদানিকারক ও উৎপাদক ছয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কারসাজির প্রমাণ পাওয়া গেছে। অতি মুনাফা করতে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর সিন্ডিকেট করে বাজারে তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেয়। এতে কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি হয়। হুহু করে বেড়ে যায় দাম। অস্থির হয়ে ওঠে ভোজ্যতেলের বাজার। গত বছর মার্চে হঠাৎ করেই বাজারে ভোজ্যতেল একরকম উধাও হয়ে যায়। ওই সময় প্রতি লিটার ১৭৫ থেকে ২১০ টাকা বিক্রি হয়। সরকারের বেঁধে দেওয়া দর ছিল ১৬৮ টাকা। এই বাড়তি দাম চলে প্রায় এক মাস। এই সময়ে কমপক্ষে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ওই সিন্ডিকেট। তেল ইস্যুতে সরকারকে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।