দাবি আদায়ে রাজপথকেই বেছে নিল বিএনপি। সরকারের পদত্যাগে ‘একদফা’ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে দলটি। বুধবার বিকালে নয়াপল্টনের সমাবেশ থেকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে একদফা দাবি আদায়ে ঘোষণা করা হয় দুই দিনের পদযাত্রা কর্মসূচি। একদফা এবং কর্মসূচি ঘোষণা করে মির্জা ফখরুল বলেন, দফা এক, দাবি এক-শেখ হাসিনার পদত্যাগ। পদযাত্রার মধ্য দিয়ে সরকারের পতন ত্বরান্বিত হবে। এবার আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত।
সরকারকে হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, এটা প্রাথমিক কর্মসূচি। এরপরও আঙুলে ঘি না উঠলে কীভাবে ওঠাতে হয়, দেশের মানুষ তা জানে। এখনো সময় আছে এই ঘোষণার পরেই পদত্যাগ করুন। অন্যথায় বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস পরিষ্কার করে বলে দেয়-তখন কিন্তু পালানোর পথও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
নতুন কর্মসূচির মধ্যে ১৮ জুলাই ঢাকাসহ সব মহানগর ও জেলায় পদযাত্রা। ওইদিন ঢাকায় সকাল ১০টায় গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত এ কর্মসূচি পালন করা হবে। ১৯ জুলাই হবে শুধু ঢাকা মহানগরীতে। ওইদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত উত্তরার আবদুল্লাহপুর থেকে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত হবে পদযাত্রা। রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে সভা-সমাবেশের মধ্য দিয়ে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ৩৫টি দল সরকারের পদত্যাগের একদফার পাশাপাশি নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে। এদিকে সমাবেশ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা ‘যৌথ রূপরেখা’ ঘোষণার কথা থাকলেও সময়স্বল্পতার কারণে তা করতে পারেনি বিএনপি। আজ গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তা তুলে ধরার কথা রয়েছে।
কয়েকটি দাবি সংবলিত একদফা কর্মসূচি ঘোষণা করে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা যারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি, তারা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজকে আমরা একটা যৌথ ঘোষণা দেব যার যার জায়গা থেকে। সেই সিদ্ধান্তটি হচ্ছে-যুগপৎ ধারায় বৃহত্তর গণ-আন্দোলনের একদফার ঘোষণা। একদফা আর কোনো দফা নেই। বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী বর্তমান ফ্যাসিবাদী, কর্তৃত্ববাদী অবৈধ সরকারের পদত্যাগ, বিদ্যমান অবৈধ সংসদের বিলুপ্তি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে তার অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি, মিথ্যা-গায়েবি মামলা প্রত্যাহার, তারেক রহমানের মামলাসহ ফরমায়েশি সাজা বাতিল, সংবিধান রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার একদফা দাবিতে রাজপথে সক্রিয় বিরোধী রাজনৈতিক জোট ও দলগুলো যুগপৎ ধারায় ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা এবং সফল করার ঘোষণা প্রদান করছি।
‘যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে যেসব দল রয়েছে তাদেরও সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানও জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আসুন আমরা একসঙ্গে সমবেত হয়ে আজ গোটা বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে এগিয়ে এসেছে, আপনারা এগিয়ে এসেছেন-আমরা একটা উত্তাল আন্দোলন গড়ে তুলে এই লুটেরা ফ্যাসিবাদী কর্তৃত্ববাদী সরকারকে সরিয়ে সত্যিকার অর্থেই জনগণের একটা সরকার, জনগণের একটা রাষ্ট্র নির্মাণ করতে পারি।
কর্মসূচিতে আসতে বিভিন্ন স্থানে নেতাকর্মীদের বাধা দেওয়ার দাবি করে মির্জা ফখরুল হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে যেভাবে লাখ লাখ মানুষ এখানে সমবেত হয়েছে, আগামী দিনগুলোয়ও ১৮ ও ১৯ তারিখ শুধু নয়, প্রয়োজনে আপনাদের প্রত্যাশিত কর্মসূচি দিয়ে এই ফ্যাসিস্ট অবৈধ লুটেরা সরকারকে সরিয়ে নির্দলীয় সরকারের মাধ্যমে, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করব।
সরকারের অপশাসন, দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও দ্রব্যমূল্যে মানুষের দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।
প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরপেক্ষ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, নইলে এর পরিণতি শুভ হবে না। সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে আপনাদের বিচার করা হবে।
নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে বেলা ২টায় এই সমাবেশ শুরু হয়। সমাবেশের মূল ব্যানারে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবির পাশে লেখা-‘গণতন্ত্রের ঘাতক, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও সর্বনাশা অনাচারে লিপ্ত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পদত্যাগ এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে যুগপৎ ধারায় বৃহত্তর গণ-আন্দোলনের একদফা যৌথ ঘোষণা’। বেলা ২টায় সমাবেশ শুরু হয়। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে লাল-সবুজ-হলুদ টুপি পরে নেতাকর্মীরা ‘একদফা, এক দাবি-হাসিনা তুই কবে যাবি’, ‘দেশ যাবে কোন পথে, ফয়সালা হবে রাজপথে’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়। সমাবেশ উপলক্ষ্যে নয়াপল্টন সড়কের বিভিন্ন গলিতে ব্যাপক পুলিশ ও সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমাবেশ থাকায় সকাল থেকে রাজধানীর সড়কে গণপরিবহণ তেমন দেখা যায়নি। এতে অফিসগামী যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন।
স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমরা যখন সমাবেশ করছি, তখন ওরা শান্তি মিটিং করছে। যারা দেশে খুন-গুম করে দেশে অশান্তি সৃষ্টি করেছে, তারা এখন শান্তি মিটিং করে। কিন্তু শুনলাম সেখানে নাকি লোক হয়নি। এখনো সময় আছে ক্ষমতা ছেড়ে দিন। যারা অশান্তি সৃষ্টি করবে, তাদের প্রতিহত করা হবে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। যারা যাবে, তাদেরও জবাব দিতে হবে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, সাবধান! আপনারা সরকারের ওই ভোট চুরির প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন না।
সভাপতির বক্তব্যে মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান বলেন, জনগণ আজ রাস্তায় নেমে এসেছে। শেখ হাসিনার পায়ের নিচে মাটি নেই। এই সরকারের ক্ষমতায় আর সুযোগ নেই। এ সরকারকে না হটিয়ে আমরা কেউ ঘরে ফিরব না-উপস্থিত নেতাকর্মীদের এমন শপথ পড়ান তিনি।
ঢাকা উত্তরের সদস্যসচিব আমিনুল হক ও দক্ষিণের ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ রবিনের যৌথ সঞ্চালনায় সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর, বরকত উল্লাহ বুলু, এজেডএম জাহিদ হোসেন, শামসুজ্জামান দুদু, আহমেদ আজম খান, নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, কেন্দ্রীয় নেতা ফজলুল হক মিলন, আবদুস সালাম আজাদ, কামরুজ্জামান রতন, রকিবুল ইসলাম বকুল, মুক্তিযোদ্ধা দলের সাদেক আহমেদ খান, মহিলা দলের আফরোজা আব্বাস, যুবদলের সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, স্বেচ্ছাসেবক দলের এসএম জিলানি, শ্রমিক দলের আনোয়ার হোসাইন, কৃষক দলের হাসান জাফির তুহিন, তাঁতী দলের আবুল কালাম আজাদ, জাসাসের জাকির হোসেন রোকন, মৎস্যজীবী দলের রফিকুল ইসলাম মাহতাব, ছাত্রদলের কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ প্রমুখ বক্তব্য দেন। এছাড়াও সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, মীর নাসির, ফজলুর রহমান, মিজানুর রহমান মিনু, হাবিবুর রহমান হাবিব, জয়নুল আবদিন ফারুক, আবদুল খায়ের ভুঁইয়া, মাহবুবউদ্দিন খোকন, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, শামা ওবায়েদ, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, বিলকিস জাহান শিরিন সুলতানা, মীর সরাফত আলী সপু প্রমুখ।