এবার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ৯ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ নিয়ে পঞ্চম মামলায় তার সাজা হলো। রায়ে তারেক রহমানের সঙ্গে তার স্ত্রী জোবাইদা রহমানকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। এটিই জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে প্রথম কোনো মামলার রায়। এ রায়ে কারাদণ্ডের পাশাপাশি তারেক রহমানকে ৩ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার টাকা না দিলে তাকে আরও ৩ মাস সাজা ভোগ করতে হবে। জোবাইদাকে ৩ বছর কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৩৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার অর্থ অনাদায়ে তাকে আরও ১ মাস দণ্ড ভোগ করতে হবে। এছাড়া এই দম্পতির অপ্রদর্শিত সম্পদ হিসাবে ২ কোটি ৭৪ লাখ ৯৩ হাজার ৮৭ টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দেন আদালত।
বুধবার ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. আছাদুজ্জামান জনাকীর্ণ আদালতে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে আইনের দৃষ্টিতে পলাতক দুই আসামিকে গ্রেফতারের জন্য পরোয়ানা জারিরও আদেশ দেন বিচারক। তারেক রহমানকে ২০০৪ সালের দুদক আইনের ২৬(২) ধারায় ৩ বছর এবং ২৭(১) ধারায় ৬ বছরসহ ৯ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দুই ধারার সাজা একসঙ্গে চলবে বলে বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন।
অপরদিকে দুদক আইনের ২৭(১) ধারায় জোবাইদা রহমানকে ৩ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৬(২) ধারার অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ বছর এবং ২৭(১) ধারায় অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের বিধান রয়েছে।
এদিকে বুধবার তারেক-জোবাইদার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সকাল থেকে আদালত চত্বর ও এজলাসে অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা। রায় ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করেন। রায় ঘোষণার পর তারা খুশিতে উল্লাস প্রকাশ করেন। অন্যদিকে রায় ঘোষণার পর আদালতের সামনে ব্যাপক হট্টগোল করে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। তাদের অনেকের মাথায়, মুখে কালো কাপড় ও হাতে কালো পতাকা দেখা যায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের মধ্যে এ সময় হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা আদালত চত্বরে বিক্ষোভ মিছিলও করেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম, ঢাকা বার ইউনিটের ব্যানারে আয়োজিত এই বিক্ষোভের ব্যানারে লেখা ছিল : ‘তারেক রহমানের মিথ্যা মামলা মিথ্যা রায় মানি না, মানব না।’ তাদের স্লোগান ছিল ‘ফরমায়েশি রায় মানি না’, ‘তারেক-জোবাইদার কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’ ইত্যাদি। এ সময় আদালতে বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি নেতা, ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, এ ফরমায়েশি রায় আমরা মানি না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে এ রায় দিয়েছে সরকার। তারেক রহমান দেশে এসে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।
এই মামলায় দুদকের পক্ষের আইনজীবী ছিলেন মোশাররফ হোসেন কাজল। অন্যদিকে তারেক ও জোবাইদা পলাতক থাকায় তাদের পক্ষে কোনো আইনজীবী শুনানির সুযোগ পাননি। তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা চিকিৎসক হিসাবে সরকারি চাকরিতে ছিলেন। ছুটি নিয়ে যাওয়ার পর আর কর্মস্থলে না ফেরায় ২০১৪ সালে তাকে বরখাস্ত করে সরকার। এ মামলায় তার বিরুদ্ধে স্বামীর অপরাধে সহযোগিতা এবং মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। চলতি বছর ১৩ এপ্রিল তারেক রহমান ও ডা. জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে মামলায় চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। এরপর থেকে বিএনপিদলীয় আইনজীবীরা এ বিচারকে প্রহসনের বিচার বলে দাবি করে আসছিলেন। এ বিচারকে প্রহসনের বিচার দাবি করে তারা নানা কর্মসূচি পালন করেন।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় দুদক প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, আমরা রায়ে খুশি। তবে একটি ধারায় সর্বোচ্চ সাজা ছিল ১০ বছর, সেখানে আদালত তারেক রহমানকে ৬ বছর সাজা দিয়েছেন। রায়ের অনুলিপি পেলে তা পর্যালোচনা করে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে দুদক। এদিন সন্ধ্যায় তিনি যুগান্তরকে বলেন, এই রায়ে মোট ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকার মতো বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ লাখ টাকা জোবাইদা রহমানের। বাকি টাকা তারেক রহমানের। অনাদায়ে তাদের আরও সাজা ভোগ করতে হবে।
২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার কাফরুল থানায় এ মামলাটি করে দুদক। তখন মামলার এজাহারে বলা হয়, তারেক ও জোবাইদা রহমান দুদকের কাছে ঘোষিত আয়ের বাইরে ৪ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬১ টাকার অবৈধ সম্পদ রয়েছে। মামলায় জোবাইদার মা ইকবাল মান্দ বানুকেও আসামি করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে তিনজনের বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়। পরে উচ্চ আদালত ইকবাল মান্দ বানুর বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম বাতিল করেন। অন্যদিকে জোবাইদা রহমানের পক্ষেও অভিযোগপত্র দাখিলের পর তার পক্ষে মামলা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করা হয়। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন। এ বিষয়ে চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল জোবাইদার বিরুদ্ধে মামলার অংশটুকু বাতিলের আবেদন খারিজ করে রায় দেন হাইকোর্ট। উচ্চ আদালতের এ খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে ওই বছরই আপিলের আবেদন করেন জোবাইদা। এরপর প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ লিভ টু আপিল খারিজ করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রাখেন।
ফলে ফের গতি পায় মামলা। ২০২২ সালের ১ নভেম্বর অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে তারেক রহমান ও জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এরপর চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. আছাদুজ্জামান। ২১ মে মামলার বাদী জহিরুল হুদার জবানবন্দি গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এ মামলায় ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪২ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। ২৪ জুলাই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। ২৭ জুলাই এ মামলায় যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য ২ আগস্ট দিন ঠিক করেন আদালত। পূর্বনির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী বুধবার বিচারক এ রায় ঘোষণা করেন।
১৯টির মধ্যে ৫ মামলায় সাজা-যাবজ্জীবনসহ ২৮ বছরের কারাদণ্ড ঝুলছে তারেক রহমানের মাথায় : লন্ডনে নির্বাসিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৯ মামলার মধ্যে অবৈধ সম্পদের মামলার রায়সহ এ পর্যন্ত পাঁচ মামলার বিচার শেষ হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে একটিতে যাবজ্জীবন এবং অবৈধ সম্পদের মামলায় ৯ বছরসহ চারটিতে বিভিন্ন মেয়াদে ২৮ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বাকি ১৪টি মামলার বিচারকাজ বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। বুধবার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলায় তারেক রহমানের সঙ্গে তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানকেও ৩ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, একই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ড, ২০১৬ সালের ২১ জুলাই মানি লন্ডারিং মামলায় হাইকোর্টে ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নড়াইলে মানহানির এক মামলায় ২ বছরের কারাদণ্ড হয়।
তারেক রহমান উন্নত চিকিৎসার জন্য উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে ২০০৮ সালে লন্ডন যান। এরপর থেকে তিনি সেখানেই বসবাস করছেন। উচ্চ আদালতের অনুমতি নিয়ে লন্ডনে গেলেও তার জামিন বাতিল করে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন দেওয়া হয়। তিনি না আসায় পলাতক হিসাবে এসব বিচারাধীন মামলায় তার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হয়। ঢাকার আদালতগুলোতে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অন্তত ১৯টি মামলা বিচারাধীন। এসব মামলার প্রায় প্রত্যেকটিতে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল যুগান্তরকে বলেন, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মোট ১৯টি মামলার মধ্যে পাঁচটিতে সাজা হয়েছে। যতগুলো মামলা দায়ের করা হয়েছে সবগুলোই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো দায়ের করা হয়। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম কোর্টে চারটি মানহানি মামলা (৪৯৯/৫০০ ধারায়) চলমান রয়েছে। এই মামলাগুলোর মধ্যে একটিতে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।