ভিকারুননিসার শিক্ষিকা ও নারী চিকিৎসকের মৃত্যু

এবার ডেঙ্গু কেড়ে নিল তরুণ নারী চিকিৎসক শরিফা বিনতে আজিজ (আঁখি) ও ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা মোরশেদা বেগমের জীবন। শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ডা. আঁখি। একইদিন সকালে রাজধানীর ইনসাফ বারাকাহ কিডনি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান শিক্ষিকা মোরশেদা বেগম। তিনি ক্যানসার আক্রান্ত ছিলেন। ডেঙ্গুর কাছে হেরে গেলেন তিনি। ডেঙ্গু 
আক্রান্ত হয়ে একদিনে একজন চিকিৎসক ও শিক্ষিকার মৃত্যুর খবরে সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গুতে তরুণ চিকিৎসক ও শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশার লোকজনের এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারের দপ্তরগুলোর চরম অব্যবস্থাপনার মূল্য দিচ্ছেন নাগরিকরা। 

চিকিৎসক ও শিক্ষিকার মৃত্যুতে তাদের পরিবার, স্বজন ছাড়াও চিকিৎসক ও শিক্ষক সমাজের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। এর আগে ডেঙ্গুতে আকান্ত হয়ে ৭ আগস্ট ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ডা. আলমিনা দেওয়ান মিশু নামে আরেক নারী চিকিৎসকের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে চলতি বছর দুজন নারী চিকিৎসকের মৃত্যু হলো। 

‘চিকিৎসক আঁখির মৃত্যুর বিষয়ে ঢাকা মেডিকেলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার মো. নাজমুল হক বলেন, তিনি (ডা. আঁখি) ডেঙ্গু আক্রান্ত ছিলেন। আমাদের এখানে আসার আগে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তর করা হয়। তার জন্য আইসিইউর ব্যবস্থা করে দিই। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় তার। আমাদের শত চেষ্টার পরও শুক্রবার ভোরে তিনি মারা যান।’

শরীফা বিনতে আজিজ (আঁখি) রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে এফসিপিএস পার্ট-টু করছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি ঢাকার দোহার উপজেলায়। 

জানা গেছে, শরিফা বিনতে আজিজ (আঁখি) দোহার উপজেলার লটাখোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল আজিজের একমাত্র কন্যা। এক ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। শুক্রবার বিকালে দোহারে শরিফা বিনতে আজিজের (আঁখি) গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে শোকের মাতম দেখা যায়। 

একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে পাগলপ্রায় আঁখির বাবা আব্দুল আজিজ। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমার সারা জীবনের অর্জন শেষ হয়ে গেছে। মাত্র এক সপ্তাহের ডেঙ্গুজ্বরে আমার কলিজার টুকরা মেয়েটা মৃত্যুর কাছে হেরে গেল। আশা ছিল আমার মেয়ে চিকিৎসক হিসাবে মানুষের কল্যাণে কাজ করবে। দেশজুড়ে সুমান কুড়াবে। সে আশা আর পূর্ণ হলো না। ক্ষুদ্র একটি মশা তার জীবনটা কেড়ে নিল। এ কষ্ট আমি কেমন করে সইব!’

এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভিকারুনননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা মোরশেদা বেগমের মৃত্যুর খবরটি জানান প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী। তিনি বলেন, মোরশেদা বেগম ভিকারুননিসা বসুন্ধরা শাখার প্রভাতী শাখার শিক্ষিকা হিসাবে কর্মরত ছিলেন। সম্প্রতি তার শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। প্রথম কেমোথেরাপি নেওয়ার পর তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরই মধ্যে তিনি জ্বরে আকান্ত হন। পরে তার ডেঙ্গু টেস্টে পজিটিভ রিপোর্ট এলে মগবাজার ইনসাফ বারাকাহ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার প্লাটিলেট এক হাজারে নেমে গিয়েছিল। একপর্যায়ে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। সেভানেই তিনি মারা যান।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আরও জানান, মোরশেদা বেগমের রক্তের গ্রুপ ছিল ‘এ’ নেগেটিভ। আট ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন ছিল। তবে নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত হওয়ায় তা জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয় স্বজন ও সহকর্মীদের। রক্ত জোগাড় হলেও চিকিৎসক, স্বজন ও সহকর্মীদের শত চেষ্টা তাকে বাঁচাতে পারেনি। শুক্রবার সকালে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা ফাতেমা বেগম খুকু যুগান্তরকে বলেন, ২ মাস আগে ক্যানসার ধরা পড়ে মোরশেদা বেগমের। এরপর তিনি কেমোথেরাপি নিচ্ছিলেন। প্রথম কেমো নেওয়ার পর তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। রক্তের প্লাটিলেট অনেক কমে যায়। যা ১০০০-এ নেমেছিল। পরে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। শুক্রবার সকালে তিনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ভিকারুরননিসা স্কুলের শোক : ডা. শরিফা বিনতে আজিজের (আঁখি) মৃত্যুতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং শিক্ষক মোরশেদা বেগমের মৃত্যুতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পক্ষ থেকে গভীর শোক জানানো হয়েছে। চিকিৎসক মৃত্যুর ঘটনায় শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মিডিয়া সেল থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ডা. শরিফা বিনতে আজিজ (আঁখি) রংপুর মেডিকেল কলেজের ৪৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়। একইসঙ্গে শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। 

অপরদিকে শিক্ষিকা মোরশেদা বেগমের মৃত্যুতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিবারের পক্ষ থেকে গভীর শোক জানিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী। শোক বার্তায় তিনি বলেন, রশেদা বেগমের অকাল মৃত্যুতে ভিকারুননিসা পরিবার গভীরভাবে শোকাহত। আমরা তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা এবং সহমর্মিতা জ্ঞাপন করছি। 

এদিকে ডেঙ্গুতে আকান্ত হয়ে পরপর দুজন চিকিৎসক ও একজন শিক্ষিকার মৃত্যুর ঘটনাকে অত্যন্ত দুঃখজনক উল্লেখ করেন সরকারের রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইডিসিআর) উপেদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, কোনো রোগের এপিডেমিক (মহামারি) হলে সবাই ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। 

ডেঙ্গুতে তরুণ চিকিৎসক, শিক্ষক ও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মৃত্যু খুবই হৃদয়বিদারক। কোনো অন্তঃসত্ত্বা নারী, ক্যানসার বা অন্য কোনো রোগী ডেঙ্গু পজিটিভ হলে আরও ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু হাসপাতাল সব রোগী রাখতে পারে না। ডেঙ্গু পজিটিভ হলে জটিলতা না থাকলে বাড়িতে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। আবার যখন মৃত্যু হয় তখন বলা হয়, রোগী দেরিতে হাসপাতালে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে রোগীরা যাবেন কোথায়? 

এর আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এক অনুষ্ঠানে বলেন, এডিস মশার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির যারা জীবিকার তাগিদে বাইরে কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেন, তারা মশার কামড়ের শিকার হয়ে বেশি পরিমাণে ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন। এক সপ্তাহের মধ্যে ডেঙ্গুতে দুই তরুণ চিকিৎসক ও এক শিক্ষিকার মৃত্যু যেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথার সত্যতার প্রমাণ দিচ্ছে বলে জনস্বাস্থ্যবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

LEAVE A REPLY