দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ শহরে গতকাল মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী ব্রিকস সম্মেলন। জোটের বর্তমান সদস্যরা হলো ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশসহ ২২টি দেশ জোটভুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এবারের সম্মেলনের মাধ্যমে জোটের ভবিষ্যত্ নির্ধারিত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জোট সম্প্রসারণে কারা লাভবান হবে, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে। ব্রিকস কি নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থা গড়ে তুলবে পারবে—তা নিয়েও চলছে আলোচনা। তাই সামগ্রিকভাবে এই সম্মেলনে নজর থাকবে বিশ্ববাসীর।
এবারের সম্মেলনে যোগ দিতে পারছেন না রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
কারণ ইউক্রেনে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় তাঁকে গ্রেপ্তারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা সম্মেলনটির পটভূমি হিসেবে কাজ করছে। তবে এবারের সম্মেলনের মাধ্যমে সম্ভবত ওয়াশিংটনের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জকারী শক্তি হিসেবে জোটের ক্রমবর্ধমান অবস্থানকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারে ব্রিকস।
আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক মিলিয়ে অন্তত ৪০টি দেশ জোটভুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে।
এই আকর্ষণের মূল কারণ হচ্ছে ব্রিকসের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উত্থান। ক্রয়ক্ষমতার প্রেক্ষাপটে ব্রিকসের পাঁচ সদস্য দেশের মোট জিডিপির পরিমাণ শিল্পোন্নত সাত দেশের জোট জি৭-এর চেয়ে বেশি। মোটা দাগে বৈশ্বিক জিডিপির ২৬ শতাংশ জিডিপি ব্রিকসভুক্ত পাঁচ দেশের। এর পরও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) তাদের ভোট দেওয়ার ক্ষমতা মাত্র ১৫ শতাংশ।
এ ধরনের ভারসাম্যহীনতার সঙ্গে সঙ্গে গ্লোবাল সাউথে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে—নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র, যেমনটা তারা রাশিয়ার সঙ্গে করেছে।
ফলে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো পৃথক ও সম্মিলিতভাবে মার্কিন মুদ্রার ওপর নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি নিজস্ব মুদ্রার মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়াতে চাইছে।
ব্রিকসের দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যেখানে বেইজিংয়ের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সেখানে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ ভারত। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিল পশ্চিমাদের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি চীন ও রাশিয়ার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা চায়।
তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিকল্প অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্তম্ভ হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে? নাকি তাদের অভ্যন্তরীণ মতানৈক্যের কারণে সীমিত হয়ে যাবে জোটের সম্ভাবনা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর প্রভাব বাড়তে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপনের চেয়ে টুকরা টুকরা অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিকল্প প্রস্তাবনায় জোর দিতে পারে ব্রিকস। তা সত্ত্বেও পশ্চিমাদের সঙ্গে জোটটির উত্তেজনা বাড়তে পারে। কারণ ব্রিকস নেতারা নিজেদের জন্য স্বাধীন পথ তৈরি করতে চান। কিন্তু কার্যকর থাকতে চাইলে ব্রিকসকে তার সদস্য দেশগুলোর বৈষম্যমূলক অগ্রাধিকার মোকাবেলা করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা মোটেও সহজ হবে না।
এ ছাড়া এবারের সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে প্রাধান্য পাচ্ছে নতুন সদস্যদের যুক্ত করার বিষয়টি। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা গত রবিবার ব্রিকস জোটের সম্প্রসারণে সমর্থন দিয়েছেন।
গত সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকায় চীনের রাষ্ট্রদূত চেন জিয়াওডং বলেন, নিজেদের বৈধ স্বার্থ রক্ষার জন্য আরো অনেক দেশ ব্রিকসে যোগ দিতে চায়। জোহানেসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ভাসো এনজেন্ডজ বলেন, সম্প্রসারণের বিষয়টি হবে ব্রিকস জোটের জন্য চাপ মোকাবেলার প্রথম চ্যালেঞ্জ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জোটের সদস্য দেশের নেতারা নতুন সদস্য যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কি না এবং কিভাবে সম্ভাব্য সদস্যদের জোটভুক্ত করবেন—এর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বৈশ্বিক প্রভাব থাকবে। চার সদস্য নিয়ে ২০০৯ সালে প্রথমবার সম্মেলন করে ব্রিকস। পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকা জোটে যোগ দেয়। ২০১৫ সালে জোটটি নতুন ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক চালু করে।
ব্রিকসে নিয়োজিত দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত অনিল সুকলাল গত মাসে বলেন, ২২টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে জোটভুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে। অনেক দেশ অনানুষ্ঠানিকভাবে আগ্রহ দেখিয়েছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে আগ্রহ দেখানো কয়েকটি দেশ হলো বাংলাদেশ, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও নাইজেরিয়া। তবে জোটের নতুন সদস্য কিভাবে নির্ধারণ করা হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের মিহাইলা পাপা বলেন, দেশগুলোর জোটভুক্ত হওয়ার আবেদনের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক উদ্যোগে আগ্রহ, বিশেষ করে স্থানীয় মুদ্রার রূপান্তর এবং যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করা এর মধ্যে অন্যতম কারণ।
বেঙ্গালুরুভিত্তিক বিশ্লেষক মনোজ কেওয়ালরামানি বলেন, ব্রিকসকে জলবায়ু পরিবর্তন, সীমিত পুঁজি ও প্রযুক্তির মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপায় হিসেবে দেখছে দেশগুলো। সূত্র : আলজাজিরা, সিএনএন