বিশ্ববাজারে পোলট্রি খাদ্যের দাম কমলেও স্থানীয় বাজারে তা কমছে না। এর প্রভাব পড়ছে দেশের ডিমের বাজারে। ফলে গত এক বছরে প্রতি হালি ডিমের দাম বেড়েছে ২৪ শতাংশ। অথচ শুধু পোলট্রি ফিডের দাম কমানো গেলে প্রতিটি ডিম ১০ টাকায় নামিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বর্তমানে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ টাকায়। তাঁরা বলেন, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো খামার বা পাইকারি পর্যায়ে সিন্ডিকেট করে। আবার কখনো পোলট্রি ফিড সরবরাহে চলে এ সিন্ডিকেট। এর ফলে দফায় দফায় দাম বাড়ছে ডিম ও মুরগির।
সরকারের ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দেওয়া তথ্য মতে, গত বৃহস্পতিবার বাজারে প্রতি হালি ডিম বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৫৩ টাকা। ২০২২ সালের একই সময়ে প্রতি হালি ডিমের দাম ছিল ৪০ থেকে ৪৩ টাকা। সেই হিসাবে গত এক বছরে হালি প্রতি ডিমের দাম বেড়েছে ২৪ শতাংশ।
এদিকে ফিড মিলের মালিকরা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, ফিড ও ওষুধের আমদানি খরচ বাড়তি, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি, পণ্য খালাসে কাস্টমস জটিলতা এবং অভ্যন্তরীণ পরিবহন ভাড়া বাড়ার কারণেই কমানো সম্ভব হচ্ছে না ফিডের দাম।
আর একই কারণে ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। যার প্রভাব পড়ছে আমিষজাতীয় পণ্যের দামে।
দেশের ফিড মিল মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফআইএবি) তথ্য মতে, পোলট্রি খাদ্যের উপকরণ ভুট্টার দাম ১৫ শতাংশ কমলেও সয়াবিনের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। প্রতিবছর প্রায় ৭৫ লাখ টন থেকে ৮০ লাখ টন ফিডের চাহিদা পূরণ করে স্থানীয় উৎপাদকরা।
এ বিষয়ে এফআইএবির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে পোলট্রি খাদ্য ভুট্টা, সয়াবিন মিলসহ ফিড তৈরির অন্যান্য উপকরণ এবং ওষুধের দাম বেড়েছে।
এ ছাড়া ডলার সংকটে এলসি খোলা যাচ্ছে না। প্রকৃত অর্থে এসবের প্রভাব পড়েছে পোলট্রি খাদ্যে।’
এদিকে বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, গত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী পোলট্রি খাদ্যের প্রধান উপকরণ সয়াবিন বিক্রি হয়েছে টনপ্রতি ৫১৯ ডলারে। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪.৯৪ শতাংশ কম। এ ছাড়া প্রতি টন ভুট্টা বিক্রি হয়েছে ২৭৫ ডলারে। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯.৫৯ শতাংশ কম।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য মতে, পোলট্রি ফিডের উপকরণ আমদানিতে শুল্ক নেই। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব পড়া উচিত ছিল। দেশের ফিড ব্যবসায়ীরা ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৭৮ কোটি টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯৭৮ কোটি টাকার শুল্ক ছাড় পেয়েছে কাঁচামাল আমদানিতে। অথচ তারা দেশের বাজারে পোলট্রি ফিডের দাম না কমিয়ে বাড়িয়েই চলেছে।
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে নিজেদের মতো করে পোলট্রি খাদ্যের দাম বাড়াচ্ছে। এভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো রীতিমতো লুটপাট করছে। যদি তারা ফিডের দাম কমায়, তাহলে প্রতিটি ডিম ১০ টাকায় খেতে পারবে ভোক্তারা।’
মধ্যস্বত্বভোগীরা অন্যায্য মুনাফা করছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, ‘চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি দেখা দিলেই বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। খুঁজে বের করতে হবে কারা এর সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দরকার।’
বিপিআইসিসির তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে প্রতিদিন চার কোটি ৮৯ লাখ পিস ডিম উৎপন্ন হয়। সে হিসাবে বছরে হয় এক হাজার ৭৮৫ কোটি। যদিও ২০১০-১১ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০৮ কোটি। দেশের পোলট্রি খাতে ৪০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ১২ শতাংশ হারে এই বিনিয়োগ বাড়ছে। সরাসরি ২৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এই খাতে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ নারী।