সারা বিশ্বে শান্তির আহ্বানে জি-২০ সম্মেলন সমাপ্ত

সারা বিশ্বে শান্তির আহ্বানের মধ্য দিয়ে বিশ্বের শিল্পোন্নত ও বিকাশমান অর্থনীতির দেশের জোট জি-২০ সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। রোববার সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে নয়াদিল্লিতে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার হাতে আনুষ্ঠানিক ভাবে সভাপতিত্ব তুলে দিয়ে তিনি এ ঘোষণা দেন। খবর জি নিউজ, এনডিটিভি, টাইমস অব ইনডিয়া।

লুলার হাতে গাভেল তুলে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, ‘ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট তথা আমার বন্ধু লুলা দা সিলভাকে অভিনন্দন জানাতে চাই। সভাপতিত্বের এই গাভেল তার হাতেই তুলে দিতে চাই।’ ব্রাজিলের ওপর পূর্ণ আস্থার কথা জানিয়ে মোদি বলেন, ‘ত্রোইকার (ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তৈরি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী গোষ্ঠী) কর্মশক্তিতে আমার আস্থা রয়েছে। আমরা ব্রাজিলকে পূর্ণ সমর্থন করব এবং নিশ্চিত যে, তাদের নেতৃত্বে জি-২০ লক্ষ্য পূরণ করবে।’

সম্মেলনের শেষে জি-২০ সদস্যভুক্ত দেশগুলোকে নভেম্বরে ভার্চুয়াল বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি জানিয়েছেন, নভেম্বর পর্যন্তই জি-২০ সভাপতিত্বের দায়িত্ব ভারতের হাতেই রয়েছে। সে কারণেই নভেম্বরে তিনি ভার্চুয়াল বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছেন। এই সম্মেলনে যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা কতটা কার্যকর হচ্ছে, সেটা খতিয়ে দেখতেই তিনি এ বৈঠকের প্রস্তাব দেন।

মোদি বলেন, আপনারা সবাই জানেন যে, জি-২০ সভাপতিত্বের দায়িত্ব নভেম্বর পর্যন্ত ভারতের কাঁধে রয়েছে। এখনো আড়াই মাস আমাদের কাছে আছে। এই গত দুই দিনে আপনারা অনেক কথা বলেছেন এখানে। অনেক প্রস্তাব দিয়েছেন। আমাদের দায়িত্ব, এই প্রস্তাবের অগ্রগতির বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা। এই আবহে আমি প্রস্তাব রাখছি যে নভেম্বরে আমরা ফের ভার্চুয়াল মাধ্যমে একবার মিলিত হব। আমরা সেই সময় আমাদের আলোচ্য বিষয় ও কাজের সমীক্ষা চালাব। এই সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য আপনাদের হাতে তুলে দেবে আমাদের প্রতিনিধিদল।

‘নতুন বিশ্বের পরকাঠামো’য় যাতে ‘নতুন বাস্তব’ প্রতিফলিত হয়, সে আহ্বানও জানিয়েছেন মোদি। এর পাশাপাশি তিনি জাতিসংঘের মতো বিশ্বজনীন সংগঠনগুলোর সংস্কারের দাবিও জানিয়েছেন। সংস্কৃত মন্ত্রাংশ ‘স্বস্তি অস্তু বিশ্বস্য’ বলে তিনি বক্তৃতা শেষ করেছেন। এই প্রবাদের অর্থ হচ্ছে সারা বিশ্বে আশা এবং শান্তি থাকা জরুরি।

জি-২০ সম্মেলনে শনিবার গৃহীত দিল্লি ঘোষণায় ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মোট সাতটি পয়েন্ট আছে। সেখানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য প্রত্যক্ষভাবে মস্কোর প্রতি নিন্দা জানানোর বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে সব দেশের প্রতি কোনো অঞ্চল দখল না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি শনিবারই এক ঘোষণায় বলেছিলেন, সম্মেলনের প্রথম দিনে জোটভুক্ত দেশগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘জি-২০ লিডার্স সামিট ডিক্লারেশন’ গৃহীত হয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে জি-২০ জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। তাই সব দেশের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ডিক্লারেশনের ঘোষণা এ সম্মেলনের জন্য উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

ডিক্লারেশনে সব দেশকে আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক আইনের নীতিকে অক্ষুণ্ন রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বহুপাক্ষিক ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে।

ঘোষণায় বলা হয় যে, আমরা ইউক্রেনে ন্যায্য ও টেকসই শান্তি অর্জনে সহায়ক এমন সব প্রাসঙ্গিক ও গঠনমূলক উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। একইসঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার কিংবা ব্যবহারের হুমকিকে কোনোভাবেই সমর্থন করি না।

৩৭ পৃষ্ঠার ঘোষণাপত্রকে সর্বসম্মত করে তুলতে ‘পৃথিবী, জনগণ, শান্তি ও সমৃদ্ধি’ শীর্ষক চারটি অনুচ্ছেদ নতুন করে লিখতে হয়েছে। এর প্রতিটি শব্দ খুঁটিয়ে দেখে তবেই প্রতিটি দেশ তা অনুমোদন করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত তা ভারতেরই কূটনৈতিক জয়। ঘোষণাপত্রে অবশ্য ‘ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শব্দবন্ধের বদলে ‘ইউক্রেনে যুদ্ধ’ শব্দ ব্যবহৃত হওয়ায় সমস্যার সমাধান সূত্র বেরিয়ে আসে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

দিল্লি ঘোষণা নিয়ে জি-২০ শেরপা অমিতাভ কান্ত বলেছেন, জি-২০-র ইতিহাসে সবথেকে উচ্চাভিলাষী সভাপতিত্ব করল ভারত। তিনি বলেন, জি-২০-র ইতিহাসে কোনো ঘোষণাপত্রে কখনও ১০০ শতাংশ ঐকমত্য তৈরি হয়নি। তবে এবারে টানা ২০০ ঘণ্টা ধরে আলোচনা ও দর কষাকষির পর শেষ পর্যন্ত দিল্লি ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে সব দেশ।

অমিতাভ কান্ত বলেন, ভারতের সভাপতিত্বে ঐতিহাসিক সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবারের জি-২০ সম্মেলনে। অন্য যে কোনো জি-২০ সম্মেলনের থেকে এবারে দ্বিগুণ কাজ হয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। দিল্লি জি-২০-র ঘোষণাপত্রে মোট ৮৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে জানিয়ে অমিতাভ বলেন, প্রতিটি অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রেই সবকটি সদস্য ১০০ শতাংশ ঐকমত্য প্রকাশ করেছে। এ ঘোষণায় ‘ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’র বদলে ‘ইউক্রেনে যুদ্ধ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এতেই জট খুলেছে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য এরপরও জি-২০ যৌথ ঘোষণার প্রশংসা করেছে। তবে হতাশা প্রকাশ করেছে ইউক্রেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রোববার বলেছেন, এবারের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন প্রমাণ করেছে যে, এ জোট এখনো জলবায়ু সংকট, অস্থিতিশীলতা এবং সংঘাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করতে পারে। এক্স-কে বার্তায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, যে মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতি জলবায়ু সংকট, অস্থিতিশীলতা এবং সংঘাতের ধাক্কায় জর্জরিত, তখন এই বছরের শীর্ষ সম্মেলন প্রমাণ করেছে যে জি-২০ এখনো আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করতে পারে। এবারের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনকে ‘ব্রেকথ্রো ইভেন্ট’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। তিনি বলেছেন, এ সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পথ দেখিয়ে এবং গ্লোবাল সাউথের শক্তি এবং প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেছে। ইউক্রেনসহ অনেক বিষয়ে তাদের মতামত রাশিয়ার ওপর চাপিয়ে দেওয়া থেকে পশ্চিমকে প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তিনি ভারতের প্রশংসা করেন।

লাভরভ বলেন, শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী বিশ্বের সামরিক সংঘাতের সমাধান করতে হবে এবং পশ্চিমা দেশগুলো তাদের নিজস্ব এজেন্ডাকে বিভিন্ন সংকটের ওপর ঠেলে দিতে পারবে না। এটি অনেক দিক থেকেই একটি যুগান্তকারী শীর্ষ সম্মেলন। এটি আমাদের অনেক বিষয়ে এগিয়ে যাওয়ার দিকনির্দেশনা দিয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের আরও অনেক পথ যেতে হবে। তবে, এই শীর্ষ সম্মেলন মাইলফলক হয়ে থাকবে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গ্লোবাল সাউথ থেকে জি-২০ দেশগুলোকে সত্যিকারভাবে একত্রিত করায় আমি ভারতের সক্রিয় নেতৃত্বের ভূমিকার কথা উল্লেখ করতে চাই।

মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান দিল্লি ঘোষণাকে আস্থা অর্জনের জন্য একটি ‘উল্লেখযোগ্য মাইলফলক’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করতে প্রয়োজনে জি-২০ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।

অন্যদিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেছেন, জি-২০ সম্মেলন থেকে দেওয়া যৌথ ঘোষণায় ইউক্রেনের যুদ্ধ সম্পর্কে ‘খুব কঠোর ভাষা’ রয়েছে। এই ঘোষণায় দৃঢ় ভাষা, খাদ্যের দাম এবং খাদ্য নিরাপত্তার ওপর যুদ্ধের প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে।

কিন্তু ইউক্রেন এই ঘোষণায় সন্তুষ্ট নয়। ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওলেগ নিকোলেনকো বলেছেন, জি-২০ জোটের ‘গর্ব করার মতো কিছু নেই’। তিনি বিশেষভাবে ঘোষণার একটি অংশ তুলে ধরেন যেখানে ‘ইউক্রেনের যুদ্ধ’ বলা হয়েছে। আসলে কিয়েভ একে ‘ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বলতে পছন্দ করে।

পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানানোর পক্ষে ছিল। কিন্তু রাশিয়া, চীন তা মানতে রাজি ছিল না। ভারতও এই যুদ্ধে কারও পক্ষই নেয়নি। ফলে তারা এমন একটা অবস্থান নিতে চাইছিল, যাতে সর্বসম্মতভাবে বিষয়টি নিয়ে এগোনো যায়। আর এটাই ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং কূটনীতিকদের জন্য পরীক্ষা ও চ্যালেঞ্জ। শেষপর্যন্ত ভারত সেই পরীক্ষায় সফল হয়েছে। শনিবার সবার সম্মতিতে ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর জানান, রাশিয়ার মিত্র চীনও ডিক্লারেশনের বিষয়গুলো নিয়ে ইতিবাচক ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আলোচনায় সবারই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। কিন্তু আমরা সবাই একটি সাধারণ ক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছি।

LEAVE A REPLY