মধ্যরাতে আগুনের খবর পেয়ে হকচকিয়ে ওঠেন কৃষি মার্কেটের ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদিন। পরে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন। ততক্ষণে পুরো মার্কেট দাউ দাউ করে জ্বলছে। তার মতো ব্যবসায়ীদের অনেকেই তখন আগুন নেভাতে ব্যস্ত। হাতের কাছে যা ছিল তা দিয়েই প্রাণপণ চেষ্টা। কিন্তু লেলিহান শিখার কাছে তারা ছিলেন অসহায়। এরপর নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার ছিল না। ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগুন লাগার প্রায় ২৫ মিনিট পর ঘটনাস্থলে আসে ফায়ার সার্ভিস। ততক্ষণে সব পুড়ে ছাই। সাড়ে তিনশ দোকানের একটিও রক্ষা করা যায়নি। এতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছে অন্তত তিনশ কোটি টাকা। বুধবার রাত ৩টা থেকে সাড়ে ৩টায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে আগুন লাগে।
তার আগে রাত ১০টা থেকেই বিচ্ছিন্ন ছিল বিদ্যুৎ সংযোগ। মার্কেটের ভেতরে সিগারেট খাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। এজন্য সেখানে এমন কোনো দোকানও ছিল না। বিদ্যুৎ না থাকায় ঘিঞ্জি মার্কেটের ভেতরে কোনো দোকান মালিক বা কর্মচারীও অবস্থান করেন না। শুধু দুই গেটে ছয়জন সিকিউরিটি গার্ড রাতে দায়িত্ব পালন করেন। এ অবস্থায় গভীর রাতে কীভাবে আগুন লাগল সেই প্রশ্ন ব্যবসায়ীদের। যদিও ফায়ার সার্ভিস বলছে, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট বা মশার কয়েল থেকে আগুন লাগতে পারে। তবে ব্যবসায়ীরা তা মানতে নারাজ। তাদের একটাই কথা-এই আগুন অস্বাভাবিক। সিটি করপোরেশন বলছে, মার্কেটের ভেতরে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। বারবার বলা হলেও ব্যবস্থা না নেওয়ায় এ ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
কৃষি মার্কেটের আগুনের ভয়াবহতা এতই তীব্র ছিল যে, বুধবার রাতের আগুন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ও পুরোপুরি নেভেনি। সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে সারা দিন ধরেই থেমে থেমে জ্বলছিল আগুনের লেলিহান শিখা। ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিটের পাশাপাশি সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর বিশেষ দল আগুন নেভাতে কাজ করে। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার, স্কাউট ও স্বেচ্ছাসেবীরাও অংশ নেন এই কাজে। পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরাও আগুন নেভানোর কাজে হাত দেন। এরপরও বাঁচানো যায়নি ব্যবসায়ীদের সহায়-সম্বল।
কৃষি মার্কেট কয়েকটি অংশে বিভক্ত। এর পূর্ব দিক মুরগিপট্টি হিসাবে পরিচিত। এখানে মুরগি, মাংস ও মাছ বিক্রি হয়। পশ্চিম পাশে রয়েছে চালের আড়ত, মুদি মার্কেট, কাপড়পট্টি এবং কয়েকটি স্বর্ণের দোকান। মার্কেটের পূর্ব ও পশ্চিম ভাগের মাঝ দিয়ে গিয়েছে একটি প্রশস্ত রাস্তা। মূলত এই আগুনে মার্কেটের পশ্চিম দিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুড়ে গেছে সব। একদিকে গভীর রাত, অন্যদিকে পরদিন বৃহস্পতিবার মার্কেট সাপ্তাহিক বন্ধ। এদিন এমন ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে যান ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিন দেখা যায়, আগুন যখন নিয়ন্ত্রণে আসে ততক্ষণে সব পুড়ে ছাই। তখন ব্যবসায়ীরা ভেতরে প্রবেশ করেন। মুদি দোকানগুলোর স্টিলের কাঠামো ছাড়া বাকি সব আগুনে শেষ হয়ে গেছে। কাপড়ের দোকানগুলোতে ছিল ছাইয়ের স্তূপ। পুড়ে যায় স্বর্ণের দোকানও। ক্রোকারিজ আইটেমের দোকানের স্টিল ও লোহার পণ্যগুলোও আগুনের ভয়াবহতায় গলে যায়। আগুন নেভানোর পানিতে ভাসছিল চাল। ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, বস্তায় বস্তায় চাল ছাই হয়ে গেছে। মার্কেটের উত্তর পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল পেঁয়াজ-আলু-আদা-রসুনসহ বিভিন্ন পণ্য। কোনো কোনো দোকানের এই নিত্যপণ্যগুলো পুড়ে গেছে। কোনোটির আবার আগুনের তাপে সিদ্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয় ছিন্নমূল মানুষকে এসব পণ্য সংগ্রহ করতে দেখা যায়।
মার্কেটের খ-২২নং দোকানের নাম রাফসান অ্যান্ড তাহসান করপোরেশন। এর মালিক শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, দোকানে ৭-৮ লাখ টাকার পণ্য ছিল। এসে দেখি, সব শেষ। ক্যাশে কিছু টাকা ছিল তাও পুড়ে ছাই হয়ে আছে। তিনি বলেন, এই মার্কেটের অধিকাংশ দোকানের উপরের অংশ গোডাউন হিসাবে ব্যবহার হতো। এ কারণেই আগুনে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। গোডাউন বাইরে থাকলে ক্ষতি কম হতো। মার্কেটের মাঝ বরাবর ছিল বৈদ্যুতিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। আগুনে সেখানকার প্রায় সবকিছুই পুড়ে যায়। প্রচণ্ড তাপে বৈদ্যুতিক তারগুলো গলে দলা পাকিয়ে যায়। বৈদ্যুতিক সার্কিট ব্রেকার, সুইচবক্সসহ বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের কোনো কিছুই অক্ষত ছিল না।
কীভাবে আগুন, জানে না কেউ : আগুন কীভাবে লেগেছে তা স্পষ্ট করে বলতে পারেনি কেউ। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আগুন লাগানো হয়েছে। মার্কেটের জায়গা দখলের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই পাঁয়তারা করছে একটি চক্র। আগুন লাগিয়েছে তারাই। কেউ কেউ বলছেন, খ ব্লকের একটি দোকান থেকে হঠাৎ আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপর দ্রুত আগুন আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
তবে ফায়ার সার্ভিস বলছে, কয়েল বা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে। তবে যে কারণেই আগুন লাগুক, মার্কেটে অগ্নিনির্বাপণের ন্যূনতম ব্যবস্থা ছিল না। এছাড়া মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে প্লাস্টিক ও কাপড় জাতীয় সামগ্রী মজুত থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দ্রুততম সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। এছাড়া মার্কেটের আশপাশে পানির কোনো উৎস পাওয়া যায়নি। কোনো জলাধার বা ফায়ার হাইড্রেন্টও ছিল না।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, আশপাশে পানি না পেয়ে বেশ কিছুটা দূরে জাপান বাংলাদেশ গার্ডেন সিটির সুইমিং পুল থেকে পানি আনা হয়। এছাড়া আশপাশের বেশ কয়েকটি ভবনের ভূগর্ভস্থ ট্যাংকের পানি ব্যবহার করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদঘাটনে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে আগুনের কারণ জানা যাবে। তবে মার্কেটের একপাশে বেকারির দোকান ছিল। সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। আবার সিগারেট বা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকেও আগুন লাগতে পারে।
ক্ষতি তিনশ কোটি টাকা : আগুনে কৃষি মার্কেটের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় দোকানগুলো থেকে কোনো কিছুই উদ্ধার করা যায়নি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুদি দোকানের পট্টিতে সবচেয়ে ছোট দোকানেও ৮-১০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। কাপড়পট্টির কোনো কোনো দোকানে মালামাল ছিল কোটি টাকার উপরে। স্বর্ণের দোকানের অবস্থাও একই। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশ বড়।
ঢাকা মহানগর দোকান ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি আরিফুর রহমান বলেন, এখানে প্রায় ৪শর মতো দোকান ছিল। প্রায় সবই পুড়ে গেছে। কোনো কিছুই উদ্ধার করা যায়নি। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩শ কোটি টাকার নিচে নয়। সম্প্রতি বিভিন্ন মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা প্রায় প্রত্যেকটি জায়গায় দেখতে পাচ্ছি মার্কেটগুলোতে আগুন লাগছে মধ্যরাতে। শুধু রাতে কেন আগুন লাগছে তা আমাদের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি কি মার্কেটের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, নাকি বাইরে থেকে করা হচ্ছে-তা বের করতে হবে। তবে এই মুহূর্তে আমাদের দাবি হলো, সরকার যেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ায়। তারা যেন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে।
২১৭ দোকান ভস্মীভূত : ঘটনাস্থলে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে তাৎক্ষণিক জরিপ চালায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এ সময় ডিএনসিসি’র পক্ষ থেকে জানানো হয়, ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের সংখ্যা দুইশর বেশি। প্রাথমিকভাবে ২১৭টি দোকানের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তবে এ সংখ্যা কম বেশি হতে পারে। ঘটনাস্থলে ডিএনসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, মার্কেটে সিটি করপোরেশন থেকে বরাদ্দকৃত দোকানের সংখ্যা ৩১৭টি। প্রায় ২শটি দোকান পুড়ে গেছে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ডিএনসিসির পক্ষে যতটুকু সম্ভব তাদের সহযোগিতা করা হবে।
বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের তালিকা করতে দেখা যায়, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সদস্যদের। এছাড়া মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতি, জেলা প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তরফ থেকেও পৃথক তালিকা করা হচ্ছে। দুপুরে মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে দোকানের বিস্তারিত, বরাদ্দ সংক্রান্ত প্রমাণপত্র দেখানোর জন্য মাইকিং করা হচ্ছিল। এক্ষেত্রে কেউ যেন মিথ্যা বা জালিয়াতির আশ্রয় না নেন সেজন্য সাবধান করা হচ্ছিল।
এর আগে সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হবে।
ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা : ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের অনেকেই ফায়ার সার্ভিসের ওপর ক্ষুব্ধ। তারা বলছেন, রাত সোয়া ৩টার দিকে প্রথমে কৃষি মার্কেটের খ-ব্লকে আগুন লাগে। তখনও অন্য দোকানগুলো বাঁচানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঠিক সময়ে আসেনি। পরে পশ্চিম পাশের গ-ব্লকেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। গ-ব্লকে কাপড় ও গয়নার দোকান ছিল।
মার্কেটের নিরাপত্তা প্রহরী মো. দিলশাদ বলেন, হক বেকারির কাছ থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখেন তারা। তখন নিজেরাই পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসেও খবর দেওয়া হয়। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের আসতে ২০-২৫ মিনিট দেরি হয়। এতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তবে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে গাফিলতির অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। তারা জানায়, রাত ৩টা ৪৩ মিনিটে খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। এর ৯ মিনিটের মধ্যে ফায়ার ফাইটিংয়ের একটি টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। ৩টা ৫২ মিনিটে তারা অগ্নিনির্বাপণের কার্যক্রম শুরু করেন।
পরিদর্শনে জিএম কাদের : বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। এ সময় তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ। দেশে সব ধরনের দুর্ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তা নেওয়া হয় না। এখানে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সরকারের উচিত তাদের পুনর্বাসন করা। তারা যেন এখনই উঠে দাঁড়াতে পারে তার ব্যবস্থা করা। তিনি আরও বলেন, এ মার্কেটের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে কর্মচারী সবাই আজ নিঃস্ব। এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। আমরা দেখছি… আগুন লাগছে আবার নিভিয়ে ফেলা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থা আসছে, কিন্তু এসব দুর্ঘটনার পর যেন অতি দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলা যায় সেই ব্যবস্থা থাকা উচিত।