মেছতা আমাদের দেশের খুবই সাধারণ একটি ত্বক সমস্যা। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই এটি হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে বেশ কম বয়সে; যেমন—১৪ বা ১৫ বছর বয়সেও এটি শুরু হতে দেখা যায়।
মেছতা কী?
মুখের অংশবিশেষে কালচে বা বাদামি ছোপ বা দাগকেই আমরা মেছতা বা মেসতা বলে জানি।
চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় এটিকে ‘মেলাসমা’ বলা হয়। মুখের মধ্যে গালের উপরিভাগে এটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। প্রথম অবস্থায় ছোট আকারে দেখা দিলেও এটি আস্তে আস্তে ছড়িয়ে যায়। অনেক সময় নাকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এটি ছড়িয়ে পড়ে, তখন ত্বকের ওপর অনেকটা প্রজাপতির আকার ধারণ করে।
এ ছাড়া অনেক সময় কপালে ভ্রুর ওপর এবং চিবুকেও এই মেছতা ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।
কেন হয়?
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেছতার প্রাদুর্ভাবের পেছনে বংশগত প্রবণতা দেখা যায়। শতকরা হিসাবে বলতে গেলে প্রায় ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই বংশগত ইতিহাস পাওয়া যায়। আর যেসব ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাঁদের নিকট পূর্বপুরুষদের মধ্যে কারো মেছতা থাকার ইতিহাস জানেন না, তাঁদের ক্ষেত্রে আরো দূরের পূর্বপুরুষ, যাঁদের সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের সাক্ষাৎ ঘটেনি, তাঁদের মধ্যে কারো মেছতা ছিল বলে ধারণা করা হয়।
শরীরের বহু রোগের মতো এই মেছতা রোগটিও ঠিক কী কারণে ত্বকে দেখা দেয় তার সুনির্দিষ্ট কারণটি কিন্তু বিজ্ঞান এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি।
মেছতার প্রকারভেদ
আমরা অনেকেই হয়তো জানি আমাদের ত্বকে তিনটি স্তর রয়েছে।
♦ সবচেয়ে ওপরের অতি সূক্ষ্ম স্তরটিকে ‘এপিডারমিস’,
♦ তার নিচের অধিকতর পুরু স্তরটিকে ‘ডারমিস’ এবং
♦ সবার নিচে মূলত ফ্যাট দিয়ে গঠিত স্তরটিকে ‘সাবকিউটিস’ বলা হয়।
মেছতার দাগটি মূলত ত্বকের এপিডারমিসের তলার দিকে অবস্থিত মেলানোসাইট নামের কোষ কর্তৃক অতিরিক্ত পিগমেন্ট (যা মেলানোসোম নামে পরিচিত) তৈরির কারণে ঘটে থাকে। এই পিগমেন্টগুলো যখন শুধু ত্বকের ওপরের স্তর এপিডারমিসে থাকে, তখন তাকে ‘এপিডারমাল’, দ্বিতীয় স্তরে থাকলে ‘ডার্মাল’ এবং তৃতীয় স্তর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লে ‘মিক্সড’ অর্থাৎ ‘মিশ্রিত মেছতা’ নামে অভিহিত করা হয়।
এপিডারমাল মেছতা সারিয়ে তোলা বেশ সহজ। কেননা ত্বকের কালো দাগ বা পিগমেন্টগুলো ত্বকের একেবারে ওপরের স্তরে থাকলে সেখানে ওষুধ বেশ সহজেই প্রবেশ করতে পারে। যখন ওপর এবং মধ্যকার দুটি স্তরে পিগমেন্টের উপস্থিতি থাকে, তখন ওপরের স্তরের দাগ বেশ ভালোই অপসারিত হয়। কিন্তু মাঝের স্তরে ওষুধ ততটা প্রবেশ করতে সক্ষম হয় না বলে মেছতার দাগ অনেকটা হালকা হয়ে এলেও পুরোপুরি যেতে পারে না। যখন পিগমেন্ট ত্বকের তিনটি স্তরজুড়েই বিস্তৃত থাকে, তখনো ওষুধের ব্যবহারে এই সমস্যা সম্পূর্ণভাবে দূরীভূত হয় না। তবে অনেকটাই হালকা হয়ে আসে।
মেছতার চিকিৎসা
এ রোগের চিকিৎসা নিয়ে রয়েছে বহুবিধ বিভ্রান্তি। যেহেতু মেছতা মুখের ব্যাপক সৌন্দর্যহানি ঘটায় এবং এ রোগের জন্য আক্রান্ত ব্যক্তি প্রচুর মনঃকষ্টের শিকার হয়ে থাকেন, তাই মানুষের মনের এই সংবেদনশীলতাকে অপব্যবহার করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মেছতা চিরনির্মূল করার অঙ্গীকারসমেত অত্যন্ত ক্ষতিকর উপাদানে প্রস্তুত কিছু প্রলেপ বাজারে ছড়িয়ে যাচ্ছেন, যা ব্যবহারে মেছতা চিরতরে নির্মূল তো হয়ই না, বরং ত্বকের ক্ষতিসাধন করে থাকে, যা অনেক সময় প্রতিকারের অযোগ্য হয়ে যায়।
মেছতা প্রতিকারে করণীয় কী?
মেছতার চিকিৎসার কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। অবশ্যই এর চিকিৎসা ত্বক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে হওয়া উচিত। রোগের প্রকারভেদ অনুযায়ী নির্দিষ্ট কিছুদিন একটি চিকিৎসাপদ্ধতি অনুসরণ করার পর যখন সমস্যাটি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, তখন বিশেষভাবে পালনযোগ্য কিছু নিয়ম রোগীকে প্রায় সারা জীবন ধরেই পালন করে যেতে হয়, যা ত্বকবান্ধব এবং সম্পূর্ণ নিরাপদ।
একবার সমস্যা নিয়ন্ত্রণে চলে এলে যাঁরা চিকিৎসকের বলা কথাগুলো আমলে আনেন না, তাঁদের ক্ষেত্রে মেছতার পুনরাবির্ভাব একটি প্রায় অবশ্যম্ভাবী ঘটনা।
লেখক
সিনিয়র কনসালট্যান্ট, ডার্মাটোলজি
উত্তরা স্কিন কেয়ার অ্যান্ড লেজার