ভুবনহারা মা-মেয়ের অনিশ্চিত ভুবন

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের রাস্তায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত ভুবন চন্দ্র শীলের মৃত্যুর খবরে হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর স্ত্রী রত্না রানী শীল। পাশেই মেয়ে ভূমিকা রানী শীল বেদনায় বাকরুদ্ধ। গতকাল তোলা। ছবি : মোহাম্মদ আসাদ

‘আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল! মেয়েকে নিয়ে এখন কিভাবে বাঁচব? মেয়েটার কী হবে! বাবাকে নিয়ে মেয়ের কত স্বপ্ন ছিল। আর পূরণ হলো না। বাবা ছাড়া আমার মেয়ে কিছুই বুঝত না। ওরা আমার এত বড় সর্বনাশ করল!’

রাজধানীর ধানমণ্ডির পপুলার হাসপাতালে গতকাল সোমবার সকালে এভাবে আহাজারি করছিলেন সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত ভুবন চন্দ্র শীলের স্ত্রী রত্না রানী শীল।

স্বামীর অভাবনীয় আকস্মিক মৃত্যুতে বিধ্বস্ত তিনি। শোকে মুহ্যমান তাঁদের একমাত্র মেয়ে ভূমিকা রানী শীল।

রত্না রানী কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ‘এভাবে কোনো সন্তানের বাবাকে যেন পৃথিবী ছেড়ে যেতে না হয়। আর কারো স্বামীর যেন এমন পরিণতি না হয়।

সন্ত্রাসীদের কি বিচার হবে না?’ কে দেবে রত্নার এই প্রশ্নের জবাব? খানিক আগে, সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে মারা গেছেন ভুবন চন্দ্র শীল। এর আগে এই আইনজীবী সাতটা দিন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। অচেতন ছিলেন, তবে প্রাণ ছিল। স্ত্রী-কন্যার মনে আশা ছিল, জেগে উঠবে তাদের পরিবারের প্রাণপুরুষ।

পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের দুজনকে নিয়ে যাবেন ভারতে। সেখানে রত্না রানীর চিকিৎসা হবে। বাবার হাত ধরে ভূমিকা ঘুরবে পছন্দের জায়গা আর তীর্থস্থানে। কিন্তু ভুবন চন্দ্র স্ত্রী-কন্যার ভুবন অন্ধকার করে চলে গেলেন। যার জন্য দায়ী তাঁর মাথায় লাগা গুলি।

সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলি!

গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে তেজগাঁও শিল্প এলাকার বিজি প্রেসের সামনের রাস্তায় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ ওরফে মামুনের প্রাইভেট কার লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে একদল সন্ত্রাসী। সেই সময় ওই পথ দিয়ে মোটরসাইকেলে করে আরামবাগে নিজের বাসার পথে থাকা ভুবন মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। এই ঘটনায় এ পর্যন্ত একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পরিবার ও পুলিশ সূত্র জানায়, আহত ভুবনকে প্রথমে শমরিতা হাসপাতালে, পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। রাত দেড়টার দিকে ভুবনকে পপুলার হাসপাতালে স্থানান্তর করে স্বজনরা। সেখানে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। মাথায় আটকে থাকা সেই গুলি শেষ পর্যন্ত অস্ত্রোপচার করেও বের করা যায়নি।

পুলিশ জানায়, গতকাল ভুবনের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হয়। রাতেই মরদেহ ফেনীর পরশুরামে নিজ গ্রামে নেওয়ার কথা।

ভুবনকে হারিয়ে অসহায় পরিবার

গতকাল পপুলার হাসপাতালের দোতলায় গিয়ে দেখা যায়, মেয়ে ভূমিকা রানী শীলকে জড়িয়ে ধরে আহাজারি করছেন রত্না রানী শীল। পাশেই নির্বাক স্বজনরা ভুবনের মরদেহের অপেক্ষায়। 

রত্না রানী তাঁর পরিবারের অসহায়ত্বের বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, ‘এখন দেখবে কে আমাদের? বাবাকে ছাড়া মেয়েটা কিছুই বুঝত না। বাবার হাত ধরে তীর্থে যেতে চেয়েছিল ও, সেটা আর হলো না। এখন কিভাবে আমার মেয়ে তার ইচ্ছা পূরণ করবে?’

বাবার স্মৃতিচারণা করে ভূমিকা বলছিল, ‘আমাকে ব্যবসায়ী বানাতে বাবার অনেক পরিকল্পনা ছিল। শাড়ির ব্যবসা নিয়ে অনেক গল্প হতো বাবার সঙ্গে। এখন আর তা হবে না। তবে বাবার আত্মা সব সময় আমাদের সঙ্গে থাকবে।’

ভূমিকা বলছিল, “আমি খাসির মাংস খেতে পছন্দ করি। তাই বাবা যখনই খাসির মাংস খেত, তখন আমাকে ফোন করে বলত, ‘মা, তোকে রেখেই আজ মাটন খেয়েছি।’ তখন আমি বাবাকে বলতাম, ‘তুমি আমাকে রেখে কেন মাটন খেলে?’ আমি এখন বাবাকে রেখে কিভাবে মাটন খাব?” এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে ভূমিকা।

জটিল রোগে আক্রান্ত রত্না

রত্না রানী শীল ক্যান্সারে আক্রান্ত। গত মে মাসে চিকিৎসার জন্য স্বামীর সঙ্গে চেন্নাই গিয়েছিলেন তিনি। তখন এসএসসি পরীক্ষার কারণে ভূমিকা তাঁদের সঙ্গে যেতে পারেনি। ৩০ সেপ্টেম্বর রত্নার চিকিৎসার জন্য আবার চেন্নাই যাওয়ার কথা ছিল। এবার তিনজনেরই একসঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 

রত্না ভাঙা কণ্ঠে জানান, চেন্নাইয়ে চিকিৎসার পর ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থানে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। মেয়ের ইচ্ছা ছিল, বাবার হাত ধরে ঘুরবে। প্রতিদিন মোবাইল ফোনে এ নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা হতো তার। এখন সবই শেষ। ভূমিকা জানাল, এসএসসি পাস করার পর বাবা তাকে একটি মোবাইল ফোন কিনে দেন। এটা দিয়েই বাবার সঙ্গে কথা বলত সে।

ভুবনের ছোট পরিবার

ভুবনের বাড়ি ফেনীর পরশুরামে। বাবা কৃষ্ণ কুমার শীল মারা গেছেন ২৩ বছর আগে। ভুবনের মা গিরিবালা শীল (৭৫) নোয়াখালীতে রত্না রানী শীলের সঙ্গে থাকেন। তিনিও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। স্মৃতিশক্তি ক্ষীণ, কথা বলতে পারেন না। ভুবন মা-বাবার একমাত্র সন্তান।

ভুবন চন্দ্র শীল গুলশানে গোমতী টেক্সটাইল লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের আইনি পরামর্শক ছিলেন। স্ত্রী রত্না রানী শীল নোয়াখালীর মাইজদীর একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। দুজনের কর্মস্থল আলাদা হওয়ায় ভুবন ঢাকায় থাকতেন। রত্না সদ্য এসএসসি পাস করা একমাত্র সন্তান ভূমিকাকে নিয়ে থাকেন মাইজদীতে। ভুবনের আহত হওয়ার খবর শুনে ঢাকায় ছুটে আসে রত্না ও ভূমিকা।

ভুবনের শ্যালক পলাশ মজুমদার বলেন, তাঁর ভগ্নিপতিই ছিলেন পরিবারের মূল উপার্জনকারী। তিনি ১৫ দিন পর পর নোয়াখালীতে গিয়ে সংসারের খরচ দিয়ে আসতেন। তিনি বলেন, সঞ্চয় বলে তেমন কিছু ছিল না ভুবনের। যা ছিল, সব খরচ হয়ে গেছে চিকিৎসায়। প্রথম দিন ওই হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ হয় ৯৩ হাজার টাকা। দ্বিতীয় দিন বিল এসেছে ৬৭ হাজার টাকা। ধারদেনা করে হাসপাতালের বিল দিয়েছেন জানিয়ে পলাশ বলেন, ‘চিকিৎসায় অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছে। এই টাকা কিভাবে শোধ করবে ওরা?’ তিনি ভুবনের মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবি করেন।

মামলা, তদন্ত ও গ্রেপ্তার

এ ঘটনায় ১৯ সেপ্টেম্বর ভুবনের স্ত্রী রত্না তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় সাত-আটজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেন। গত রাতে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মারুফ বিল্লাহ ওরফে হিমেল নামের একজনকে পুরান ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

পুলিশের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, মারুফ বিল্লাহ ঘটনাস্থলে ছিলেন। তাঁকে কেউ ডেকে এনেছিল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মারুফ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁকে আজ মঙ্গলবার আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে।

LEAVE A REPLY