বাংলাদেশ দল থেকে কারো বাদ পড়ার পর যা যা হয়, এর প্রথমটি তাঁর মোবাইলে টুং করে বেজে ওঠা নোটিফিকেশন। যা জানিয়ে দেয়, জাতীয় দলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে তাঁকে ‘রিমুভ’ করা হয়েছে। অবশ্য চোট বা অন্য কোনো কারণে দলের বাইরে চলে যাওয়া কারো ক্ষেত্রেই অনুসরণ করা হয় এই নীতি। সেই হিসাবে বিশ্বকাপ দল ঘোষণার পর পর তামিম ইকবালের নতুন করে এই অভিজ্ঞতা হওয়ার কথা নয়।
সেটি হয়ে যাওয়ার কথা গত জুলাইতে তাঁর নিজের শহর চট্টগ্রামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের সময়ই।
ওই সিরিজের প্রথম ম্যাচের পর দিন আচমকা তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণায় হৈচৈ পড়ে যায়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সিদ্ধান্ত বদলিয়ে চলে যান লম্বা ছুটিতে। লন্ডন থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফেরার পর ওয়ানডে নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়ে শুরু হয় তাঁর মাঠে ফেরার লড়াই।
নিউজিল্যান্ড সিরিজ দিয়ে ফিরলেও যে কারণে এত শ্রম, তা এক রকম বৃথাই যায় বিশ্বকাপ দলে তাঁকে রাখা না রাখা নিয়ে নানা ঘটনাপ্রবাহে। বিতর্কের স্ফুলিঙ্গে তপ্ত বাংলাদেশ শিবির এর উত্তাপ এড়িয়ে চলার ক্ষেত্রে এখন ভীষণ সতর্ক। ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে আসার পর থেকে সেই চেষ্টা দৃশ্যমান। অবশ্য দলে না থাকা কাউকে নিয়ে আলোচনা করার রেওয়াজ বাংলাদেশ দলে এমনিতেও তেমন নেই।
দল থেকে বাদ পড়া কারো সঙ্গে জাতীয় দলের কেউ খুব যোগাযোগ রাখেন বলেও কখনো শোনা যায়নি। একসময় এটিকে নিষ্ঠুরতা বলেও মনে হতো কারো কারো কাছে। যে বা যাদের কাছে এরকম মনে হতো, মাশরাফি বিন মর্তুজা তাঁদের অন্যতম। ক্যারিয়ারের লম্বা একটি সময় চোটের জন্য নিয়মিত বিরতিতে দলের বাইরে থাকতে হতো তাঁকে। বাইরে থাকার সময়টিতে জাতীয় দলের কেউ তাঁর খোঁজখবর নিতেন না বলে মন খারাপও করতেন খুব।
মন খারাপ করার সেই সময়ে জাতীয় দলের আরেক সাবেক অধিনায়ক নিজেরও একই রকম অভিজ্ঞতা থেকে মাশরাফিকে সান্ত্বনা দিয়ে বুঝিয়েছিলেন এখানে একার লড়াই কতটা জরুরি।
তামিমের ক্ষেত্রে অবশ্য বিষয়টি ঠিক ওরকম সরল নয়। তাঁর বিশ্বকাপ দলে না থাকার পেছনে খোদ বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের নাম জড়িয়ে যাওয়াতে এই ওপেনারকে ঘিরে পরিবেশ ভারী হয়েছে আরো। বিশ্বকাপ খেলতে দেশ ছাড়ার আগে টি-স্পোর্টসকে দিয়ে আসা সাক্ষাৎকারে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও দূর অতীতের বন্ধু তামিমের সঙ্গে দ্বন্দ্বটা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্য করে দিয়ে এসেছেন। হেড কোচ চন্দিকা হাতুরাসিংহের সঙ্গে তামিমের সম্পর্কের শীতলতা এখন আর নতুন কোনো খবর নয়। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেকজনও কোচ-অধিনায়কের মতের অনুসারী হওয়ায় দলের ভেতর তামিমকে নিয়ে কেউ আলোচনার সাহস দেখাবেন না স্বাভাবিক। তাই তামিমবিষয়ক কথাবার্তা বন্ধ থাকা যতটা না আরোপিত, তার চেয়ে বেশি স্বআরোপিতই!
এ কারণে তামিম ক্রমেই আরো দূরে সরে যাচ্ছেন তাঁর কিছুদিন আগের সতীর্থদের কাছ থেকে। অথচ গত ৫ জুলাই আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে তিনি ছিলেন অধিনায়ক। এর ঠিক তিন মাস পর আগামীকাল (৫ অক্টোবর) সেই আফগানদের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই বাংলাদেশের বিশ্বকাপ অভিযান শুরুর সময় তামিম যেন হয়ে উঠেছেন স্পর্শকাতর এক নামও। তিনি কতটা বিস্মৃত হয়েছেন, টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদের কথায় সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা মিলতে পারে, ‘তামিমকে নিয়ে দলের কেউই কোনো আলোচনা করে না।’
নিজেরা না করলেও বাইরের আলোচনা তো আর থেমে নেই। সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে চলার ক্ষেত্রে সেই বিবেচনাও যে কাজ করে, সে অনুমান বেশি জনপ্রিয়। যদিও গতকাল হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (এইচপিসিএ) স্টেডিয়ামের আউটার নেটে দলের অনুশীলন থেকে বেরিয়ে এসে মাহমুদ দায় চাপালেন গণমাধ্যমের কোনো কোনো অংশের ওপর। বিশ্বকাপ কাভার করতে আসা বাংলাদেশের সাংবাদিকদের বললেন, ক্রিকেটারদের কথা কেটে ‘ভয়ংকর শিরোনাম’ করার কারণেই তাঁরা খেলোয়াড়দের সংবাদমাধ্যম থেকে দূরে রাখছেন। মনোযোগটা শুধুই ক্রিকেটে রাখতে চাইছে বাংলাদেশ দল। তবে এই দূরে রাখায় যে তামিমেরও যোগ আছে, একটু পরে ড্রেসিংরুমে ফিরে যেতে যেতে কালের কণ্ঠকে সে অনুমানের সত্যতা নিশ্চিত করে গেলেন মাহমুদ, ‘ক্রিকেটারদের কথা বলতে পাঠালেই তামিমকে নিয়ে প্রশ্ন করে বসে। এতে করে ছেলেরা হতভম্ব হয়ে যায়। এটি তো ঠিক না।’ এই মুহূর্তে লন্ডনে থাকা তামিমকে তাই ভৌগোলিকভাবেই শুধু নয়, মানসিকভাবেও দূর থেকে আরো দূরে সরে যেতে হয়!