দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু শনাক্তে বহুল প্রচলিত এনএস-১ পরীক্ষায় অনেক ক্ষেত্রে সঠিক ফল পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গু ভাইরাসের ধরন বদলে যাওয়ায় এই পদ্ধতিতে সব ক্ষেত্রে ডেঙ্গু শনাক্তে সঠিক ফল আসছে না। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় এর প্রমাণ মিলেছে।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের ৪১ শতাংশের ক্ষেত্রে এনএস-১ পরীক্ষায় প্রকৃত ফল আসছে না।
‘চলমান ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবে ডেঙ্গু এনএস-১ পরীক্ষার কার্যকারিতা এবং ডেঙ্গু ভাইরাসের সেরোটাইপ নির্ধারণ’ শীর্ষক সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে আসে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু এনএস-১ পরীক্ষার রিপোর্ট নানা কারণে পজিটিভ না-ও আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে রোগের উপসর্গ বুঝে সহায়ক পরীক্ষা হিসেবে সিবিসি, ডেঙ্গু অ্যান্টিবডি, ডেঙ্গু পিসিআর পরীক্ষা করানো যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু নেগেটিভ রিপোর্ট মানেই কেউ ডেঙ্গুমুক্ত নয়।
ভাইরোলজিস্টরা বলছেন, রোগীরা নিজ দায়িত্বে এনএস-১ পরীক্ষা করে নেগেটিভ হলে নিজেদের ডেঙ্গুমুক্ত ভেবে জটিলতা বাড়াচ্ছে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ যেমন খাওয়া ঠিক নয়, তেমনি কোনো পরীক্ষা করাও উচিত নয়।
ভাইরোলজিস্ট সোসাইটির সমীক্ষায় এক দিন থেকে সাত দিনের জ্বরে আক্রান্ত মোট ১৯৭ জন সম্ভাব্য ডেঙ্গু রোগীর ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। লিখিত সম্মতিক্রমে সবার ডেঙ্গু এনএস-১, ডেঙ্গু অ্যান্টিবডি ও ডেঙ্গু পিসিআর পরীক্ষা করা হয়।
এর মধ্যে ৬৮ জনের দেহে পিসিআর পদ্ধতিতে ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত হয়, যাদের মধ্যে ২৮ জন (৪১ শতাংশ) রোগীর ডেঙ্গু এনএস-১ পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসে।
সমীক্ষায় ৬৮ জন ডেঙ্গু পিসিআর পজিটিভ রোগীর মধ্যে ৬৩ জন রোগীর দেহে ডেঙ্গু ভাইরাসের ধরন ডেন-২ পাওয়া গেছে। চারজন রোগীর দেহে ডেন-৩ সেরোটাইপ এবং একজন রোগীর দেহে ডেন-২ ও ডেন-৩ উভয় সেরোটাইপ পাওয়া গেছে।
মূল গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ইউএস-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং সোসাইটি ফর মেডিক্যাল ভাইরোলজিস্টস বাংলাদেশের বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ডা. রুখসানা রায়হান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ডেন-৩ সেরোটাইপ সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেলেও এ বছর এখন পর্যন্ত যে কয়টি গবেষণা হয়েছে, সব ক্ষেত্রে ডেন-২ সেরোটাইপ সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে।
ডেঙ্গু শনাক্তে এনএস-১ পরীক্ষার ফল নেগেটিভ হওয়ার পেছনে এটি একটি কারণ হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, এনএস-১ নেগেটিভ বেশি হওয়ার কারণ হলো এবার বেশির ভাগই ডেঙ্গু ভাইরাসের ডেন-২ সেরোটাইপে আক্রান্ত হচ্ছে। এর আগের কয়েক বছরে ডেন-৩-এর প্রকোপ ছিল। ডেন-৩-এর ক্ষেত্রে ডেঙ্গু টেস্ট এনএস-১ পজিটিভের হার বেশি থাকে। ডেন-২-এর পজিটিভের হার খুব কম।
চিকিৎসকরা বলছেন, এনএস-১ পরীক্ষাটি ডেঙ্গু শনাক্তের প্রাথমিক পরীক্ষা হলেও এটি একমাত্র পরীক্ষা নয়। এনএস-১ পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এলেও রোগীর উপসর্গ বিবেচনায় নিয়ে চিকিৎসকরা ডেঙ্গু শনাক্তে আইজিএম ও আইজিজি নামের আরো দুটি পরীক্ষা করিয়ে থাকেন। এ ছাড়া সিবিসি পরীক্ষার ফলাফলে রক্তের বিভিন্ন উপাদানের পরিমাণ বিশ্লেষণ করেও ডেঙ্গুর উপস্থিতি শনাক্ত করেন তাঁরা।
ডা. রুখসানা রায়হান বলেন, মানুষের শরীরে ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা একটি সর্বজনস্বীকৃত পদ্ধতি। তবে চিকিৎসকরা শুধু সন্দেহ করে লক্ষণ বিবেচনায় নিয়ে এনএস-১ নমুনা পরীক্ষা দিয়ে থাকেন। আবার সবার এনএস-১ নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে ডেঙ্গু শনাক্ত না-ও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিপদে পড়ে এমন রোগীরা, যারা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজ উদ্যোগে এনএস-১ নমুনা পরীক্ষা করিয়ে নেয়। ডেঙ্গু নেগেটিভ দেখে তারা নিশ্চিন্ত থাকে। তখনই মূল ঝুঁকি শুরু হয়।
তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর জ্বর সাধারণত পাঁচ-ছয় দিন থাকে এবং তারপর জ্বর ভালো হয়ে যায়। জ্বর কমে গেলে বা ভালো হয়ে গেলে অনেকে মনে করে, রোগ পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর মারাত্মক সমস্যা হওয়ার সময় আসলে এটাই। এ সময় রক্তে প্লাটিলেট কমে যায় এবং রক্তক্ষরণসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। জ্বর কমে যাওয়ার পরবর্তী কিছু দিনকে তাই বলা হয় ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড।
এক দিনে মৃত্যু ৯, হাসপাতালে ২৬১৭
দেশে গত এক দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরো ৯ জন মারা গেছে। একই সময় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দুই হাজার ৬১৭ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে এক হাজার ৯৮৪ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির এমন তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নতুন রোগী নিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৯ হাজার ২৬৫ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। এ নিয়ে চলতি বছর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দুই লাখ ১৬ হাজার ৮৬৪ জন। মারা গেছে এক হাজার ৫৫ জন।