অন্যদেরও পথ দেখান সাকিব

ফাইল ছবি

প্রতিপক্ষের উইকেট পড়লে উদযাপন করেন ঠিক, তবে বুনো উল্লাস করতে তাঁকে দেখা যায় কমই। সেদিক থেকে এই বিশ্বকাপের আফগানিস্তান ম্যাচে সাকিব আল হাসান ব্যতিক্রম। নিজে উইকেট নিয়ে যেমন হাত-পা ছুড়ছিলেন, তেমনি সতীর্থ বোলারদের সাফল্যেও একই প্রতিক্রিয়া। কেন এই বদল? দারুণ এক জয় দিয়ে বিশ্বকাপ শুরুর পর বাংলাদেশ অধিনায়ক সংবাদ সম্মেলনে এলেন না বলে সরাসরি সে বিষয়ে জানার সুযোগ ছিল না।

অগত্যা মিক্সড জোনে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হতে আসা শরিফুল ইসলামের কাছেই জিজ্ঞাসা। এই ফাস্ট বোলার অবশ্য হাসতে হাসতে ছোট্ট এক জবাবেই কাজ সারতে চাইলেন, ‘আরে, এটা বিশ্বকাপের ম্যাচ না!’

শুধুই কি বিশ্বকাপের ম্যাচ! এতটা সরলও বোধ হয় নয়। অন্তত বিশ্বকাপের দল ঘোষণা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে সাকিব নিজেও সর্বমহলে একইভাবে স্বীকৃত হননি। বাইরে থেকে ধিক্কারের হলকা ছুটে গেছে তাঁর দিকে।

এই অবস্থায় দারুণ একটি জয়ই যে পারিপার্শ্বিকতা বদলে দিতে পারে, সেটি সাকিবের চেয়ে ভালো আর কে জানেন? নিজের জীবন দিয়েই তো শিখেছেন যে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও পারফরম্যান্স ঠিকঠাক করলে হাওয়া ঘুরে যেতে সময় লাগে না। কত বিতর্কই না এভাবে তাঁর ঝলসে ওঠা কীর্তির আড়ালে চাপা পড়ে গেছে! সে কারণেই কিনা আফগানিস্তান ম্যাচের শুরু থেকেই সাকিব অনেক বেশি সম্পৃক্ত, সেই সঙ্গে ভীষণ উন্মুক্তও। এমনই যে বোলিংয়ের শুরুতে ছন্দে না থাকা বোলারের কাছে তৎক্ষণাৎ ছুটে গেছেন। নানা পরামর্শে তাঁকে দেখিয়েছেন প্রবলভাবে ফিরে আসার পথও।

আফগানিস্তান ম্যাচে এ রকম উদাহরণ একটিই নয়, একাধিক। শরিফুলের কথাই ধরা যাক। আফগানদের বিপক্ষে তাঁর মতো অন্য পেসাররাও শুরুতে কিছুটা আলগা বোলিং করছিলেন। সেই সময়ে তাঁদের কাছে ছুটে গিয়ে বলা সাকিবের কথাগুলো শুনে নিতে পারেন এই পেসারের মুখ থেকেই, ‘আমরা শুরুতে চেষ্টা করছিলাম ভালো জায়গায় বল করার। দুর্ভাগ্যবশত সেটি হয়নি।

অধিনায়ক এসে তখন আমাদের বললেন যে আমরা কোথাও একটি ভুল করছি। সম্ভবত একটু বাইরেই বোলিং করছিলাম আমরা। বললেন, পরেরবার বোলিংয়ে ফিরে যেন আমরা নিয়ন্ত্রিত বোলিং করি। পরে আমরা সেভাবেই বোলিং করার চেষ্টা করেছি।’

শুরুতে ফুল লেন্থের বোলিংয়ে সুবিধা করে উঠতে না পারা পেসাররা পরে কৌশলও বদলান। তা-ও আবার একবার নয়, বারবার। শরিফুল বলছিলেন সে কথাও, ‘পরে আমরা শর্ট বলে গিয়েছি। ওটাও পরিকল্পনা করেই করা। এরপর যখন দেখলাম এতে কাজ হচ্ছে না, তখন আবার আঁটসাঁট লেন্থে চলে গেছি।’

পেসারদের ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখানো অধিনায়ক সাকিবের কথায় ম্যাচসেরা মেহেদী হাসান মিরাজের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে গিয়েছিল রাতারাতি। ২৫ রানে ৩ উইকেট নেওয়ার পর রান তাড়ায় ফিফটিতে এই জয়ের সবচেয়ে আলোচিত পারফরমারের মনোজগতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল সাকিবের এমন বাক্য, “প্রথম ওভারটি একদমই ভালো করিনি আমি। ৯ রান দিই। একটু নার্ভাসও ছিলাম। সাকিব ভাই তখন এসে আমাকে বলেন, ‘নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে বল করলে কখনোই সফল হওয়া যায় না। সব সময় ইতিবাচক থাকতে হবে। ওরা যদি মেরে দেয়, সমস্যা নেই। ওরা যেন তোকে চার্জ করে মারে এবং তুই শুধু ভালো জায়গায় বল করে যেতে থাক।’ কোন কোন জিনিস করলে ভালো হয়, তা দেখিয়েও দেন। তখনই আমার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়।” সাকিবের দেওয়া ছোট ছোট পরামর্শ মেনেই ২৫ রানে ৩ উইকেট নিয়ে শেষে মিরাজ দলের সফলতম বোলার। 

সতীর্থদের মনোবল ফিরিয়ে আনা অধিনায়ক তো পারফরম্যান্সে পথ দেখাতে জানেনই। ম্যাচ শুরুর পর যখন আফগানিস্তানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙাই সমস্যা হয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি নিজে আক্রমণে এলেন। দ্বিতীয় ওভারেই দলকে উপহার দিলেন সাফল্য। এরপর আরেকটি জুটিতে আফগানদের ঘুরে দাঁড়ানোও বাধাগ্রস্ত তাঁর বাঁহাতি স্পিনেই। ৩০ রানে ৩ উইকেট নেওয়া পারফরম্যান্সে তাঁর আরেকটি বিশ্বকাপের শুরুও আশাব্যঞ্জক। ২০১৯ বিশ্বকাপে ৬০৬ রান করার পাশাপাশি বল হাতে ১১ শিকার ধরার অবিশ্বাস্য সাফল্যের পেছনে ছিল ভেতরে ভেতরে একটি ‘কিক’ অনুভব করার গল্প। কে জানে এবারও বিশ্বকাপ দল ঘোষণার পর নানা ঘটনায় তেমন কিছুই ভেতরের সাকিবকে জাগিয়ে তুলেছে কি না!

ধর্মশালা স্টেডিয়ামে গতকালের সাকিবে অন্তত তেমন কিছুরই ইঙ্গিত। আগের বিশ্বকাপে অধিনায়ক ছিলেন না অবশ্য। এবার সেই দায়িত্ব যুক্ত হওয়ায় পারফরমার সাকিবকে সতীর্থদের কথাও ভাবতে হচ্ছে, যাঁদের পথ দেখাতে হচ্ছে, বের করে আনতে হচ্ছে পারফরম্যান্সও।

LEAVE A REPLY