২২ বছরের কারাদণ্ড

অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় আর্থিক খাত থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা লোপাটে জড়িত এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারকে ২২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। রোববার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০-এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে পৃথকভাবে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে পিকে হালদারকে ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ২৭(১) ধারায় ১০ বছর এবং অর্থ পাচারের দায়ে ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত। এসব ধারার সাজা একটার পর একটা চলবে বিধায় পিকে হালদারকে ২২ বছর কারাভোগ করতে হবে বলে বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন। রায়ে কারাদণ্ড ছাড়াও পিকে হালদারকে দুদক আইনের ২৭(১) ধারায় ৩৪৮ কোটি, মানি লন্ডারিং আইনের ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় ৬৯৬ কোটি টাকাসহ ১ হাজার ৪৪ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। পিকে হালদারের বিরুদ্ধে দুদকের করা ৫২টি মামলার মধ্যে এটি প্রথম মামলার রায়। রায়ে পিকে হালদার ছাড়াও তার মা, ভাই, বান্ধবী ও আত্মীয়সহ অপর ১৩ জনের প্রত্যেককে দুই ধারায় ৭ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আসামি পিকে হালদারসহ দণ্ডিত ১০ জন পলাতক রয়েছেন। জেলে বন্দি রয়েছেন চারজন। রায় ঘোষণার সময় তাদের আদালতের কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। তারা হলেন পিকে হালদারের বান্ধবী অবন্তিকা বড়াল, ফুপাতো ভাই শঙ্খ বেপারী ও সুকুমার মৃধা এবং সুকুমার মৃধার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধা। গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে সুকুমার, শঙ্খ ও অনিন্দিতা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। বুধবার বিচারিক আদালত উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের জন্য এ দিন ধার্য করেন।

১৪ আসামির মধ্যে অপর যেসব আসামি দণ্ডিত হয়েছেন তারা হলেন পিকে হালদারের মা লীলাবতি হালদার (ভারতে পলাতক), ভাই প্রীতিশ কুমার হালদার (কানাডায় পলাতক), ফুপাতো বোন পূর্ণিমা রানী হালদার (ভারতে পলাতক), উত্তম কুমার মিস্ত্রী (পলাতক), অমিতাভ অধিকারী (পলাতক), রাজিব সোম (পলাতক), সুব্রত দাশ (পলাতক), অনঙ্গ মোহন রায় (পলাতক) ও স্বপন কুমার মিস্ত্রী (ভারতে পলাতক)।

২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি পিকে হালদারসহ অপরাপর আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী। মামলায় পিকে হালদারের বিরুদ্ধে প্রায় ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয়। ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেন দুদকের উপপরিচালক সালাহউদ্দিন। ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ১৪ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচারকাজ শুরু করা হয়। ওই বছর ২২ সেপ্টেম্বর থেকে সাক্ষ্য শুনানি শুরু হয়। বিচার শুরুর এক বছরের মাথায় রায় দিলেন আদালত।

দুদকের পক্ষে পিপি মীর আহমেদ আলী সালাম আদালতে এ মামলায় শুনানি পরিচালনা করেন। তিনি জানান, এই পিকে হালদারসহ বিদেশে পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে রায়ের বিষয়বস্তু (আদেশের কপি) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পাঠানো হবে। এর আগেও ইন্টারপোলের মাধ্যমে পিকে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখনই তিনি ভারতে গ্রেফতার হন। দেশ থেকে অর্থ পাচার করে কলকাতায় বিপুল সম্পদ গড়ে তোলা এবং প্রতারণার অভিযোগে সে দেশের পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। পিপি জানান, তিনি শুনেছেন ১৪ অক্টোবর পিকে হালদারের বিরুদ্ধে ভারতের একটি আদালত রায় ঘোষণা করতে পারেন। পিকে হালদারের মতো অপর যেসব অপরাধী অর্থ পাচারে জড়িত, তাদের বিচার প্রসঙ্গে দুদকের পিপি বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা (দুদক, এনবিআরসহ যেসব সংস্থা অর্থ পাচারের তদন্ত করে) যদি ঠিকমতো কাজ করে, তাহলে পিকে হালদারের মতো অপরাধীদের বিচার করতে সক্ষম আমরা।

পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের ব্যাপারে দুদকের অভিযোগপত্রে বলা হয়, পিকে হালদার নামে-বেনামে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬ হাজার ৭৯০ শতাংশ জমি কিনেছেন। এ সম্পদের বাজারমূল্য দেখানো হয়েছে ৩৯১ কোটি ৭৫ লাখ ৮১ হাজার ১২ টাকা। যার বর্তমান বাজারমূল্য ৯৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে নিজের নামে জমি কিনেছেন ৪ হাজার ১৭৪ শতাংশ। এর দাম দলিলে দেখানো হয়েছে ৬৭ কোটি ৯৪ লাখ ২০ হাজার ৯৩০ টাকা। অথচ এ সম্পদের বর্তমান মূল্য ২২৮ কোটি টাকা। এছাড়া রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিকে হালদারের নামে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। যে ফ্ল্যাট তিনি বান্ধবীকে উপহার দিয়েছিলেন।

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, পিকে হালদার তার নিকটাত্মীয় পূর্ণিমা রানী হালদারের নামে উত্তরায় একটি ভবন করেছেন। যার দাম ১২ কোটি টাকা। পূর্ণিমার ভাই উত্তম কুমার মিস্ত্রীর নামে তেজগাঁও, তেজতুরী বাজার ও গ্রিন রোডে ১০৯ শতাংশ জমি কেনেন। যার বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকা। নিজের কাগুজে কোম্পানি ক্লিউইস্টোন ফুডসের নামে কক্সবাজারে ২ একর জমির ওপর নির্মাণ করেন ৮তলা হোটেল (র‌্যাডিসন নামে পরিচিত)। যার আর্থিক মূল্য এখন ২৪০ কোটি টাকা। এছাড়া পিকে হালদারের খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী ও অনঙ্গ মোহন রায়ের নামে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ৪০৪ শতাংশ জমি কিনেছেন তিনি, এর বর্তমান দাম ১৬৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও কানাডিয়ান ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্যের বরাত দিয়ে দুদক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পিকে হালদার ২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ভাই প্রীতিশ হালদারের কাছে ১ কোটি ১৭ লাখ ১১ হাজার ১৬৪ কানাডীয় ডলার পাচার করেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৮০ কোটি টাকারও বেশি। কানাডায় ওই অর্থে কেনা অবৈধ সম্পদের পাহারাদার পিকের ভাই।

দুদকের একজন তদন্ত কর্মকর্তা জানান, পিকে হালদারকে অবৈধ সম্পদ আহরণ ও পাচারে সহযোগিতা করেছেন তার মা, ভাই বান্ধবী ও নিকটাত্মীয়রা। পিকে হালদার দুটি ফিন্যান্স কোম্পানি থেকে তাদের নামে-বেনামে ৩৫টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে হাজার কোটি টাকা বের করে পাচারের সুযোগ করে দেন। পিকে হালদারের নেতৃত্বে প্রায় চার হাজার কোটি চাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে দুদকের তদন্তেও প্রমাণ মিলেছে। এই অর্থ তছরুপ, আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মোট ৫২টি মামলা হয়। একটি মামলার রায় হয়েছে। পিকে হালদারসহ ৮০ জনের বিরুদ্ধে বাকি ৫১টি মামলার মধ্যে বেশির ভাগেরই তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনে জমা পড়েছে। কমিশন অনুমোদন দিলেই আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে। অভিযুক্তদের মধ্যে ১১ জন জেলে রয়েছেন। এর মধ্যে ১০ জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে পুরো ঘটনায় জড়িতদের নাম বলে দিয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক দুজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নামও রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান চলছে।

দুদকের ওই তর্মকর্তা আরও জানান, তদন্তে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে অন্তত ৬০০ কোটি টাকা দেশের বাইরে (ভারত ও কানাডা) পাচারের তথ্য মিলেছে। চার হাজার কোটি টাকার মধ্যে বাকি টাকার সম্পদ দেশে রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, দেশেও পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের অনেক সম্পদ রয়েছে। যেগুলো আদালতের নির্র্দেশে ক্রোক অবস্থায় আছে।

দমদম জেলেবন্দি পিকে, ২২ মামলা চলছে ভারতে : আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি কৃষ্ণকুমার দাস জানান, বাংলাদেশ থেকে হাজার কোটি টাকা পাচার করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে এসে গ্রেফতার হওয়া পিকে হালদারের বিরুদ্ধে ভারতীয় আইনে আপাতত ২২টি মামলা চলছে। বর্তমানে কলকাতার উপকণ্ঠে দমদম জেলে বন্দি পিকে বেনাপোলের লাগোয়া উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে ছদ্মবেশে থাকার সময় ২০২২ সালের ১৪ মে গ্রেফতার করে ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। পরে তার সঙ্গেই মেয়েজামাই, আত্মীয়সহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা করে ভারতীয় কেন্দ্রীয় এজেন্সি। পাচার হওয়া বাংলাদেশি অর্থ দিয়ে বিপুল সম্পত্তি ক্রয়ের পর দেখভাল করত ওই আত্মীয়রা। পিকে হালদারের সঙ্গে গ্রেফতার অন্যরা হলেন তার ভাই প্রাণেশ হালদার, ইমাম হোসেন, স্বপন মৈত্র, উত্তম মৈত্র ও আমানা সুলতানা। গ্রেফতার আমানা উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে বাস করতেন শার্লি হালদার নামে। সবাই এখন জেলবন্দি। কলকাতায় ইডিরল দপ্তর সূত্রে রোববার জানা যায়, সব মিলিয়ে ২২টি মামলা শুরু করা হয়েছে গ্রেফতার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইন্টারন্যাশনাল অ্যাক্ট, ফরেন অ্যাক্ট, মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট। এছাড়া ভারতীয় নাগরিক না হয়েও ভারতীয় পাসপোর্ট জাল করা, ভুয়া আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যানকার্ড তৈরিসহ নানা অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। রোববার ছুটির দিন হলেও বাংলাদেশের আদালতে ২২ বছরের কারাদণ্ডের খবর সূত্রমারফত দমদম জেলে পিকের কাছে পৌঁছেছে। কিন্তু পিকের প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।

বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুরোধেই ভারত-বাংলাদেশ অপরাধ দমন চুক্তি থাকায় ঢাকার গোয়েন্দাদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে পিকে হালদারের সন্ধানে তল্লাশি চালায় ইডি। গ্রেফতারের পর ইডির তরফে পাঁচজনকে রিমান্ডে নেওয়ার কারণ হিসাবে প্রথমেই জানিয়েছিল, আরও কিছু তথ্য তাদের থেকে উদ্ধার করা হবে। কারণ, পিকে হালদারের টিমে পৃথ্বীশ হালদার নামে একজন সাগরেদ ছিল, যিনি এখনো অধরা। তার মাধ্যমেই নাকি হুন্ডিতে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে আত্মসাৎ করা ৩০০ কোটি টাকা ভারতে এসেছিল। পিকে হালদারের পাচার করা অর্থে ভারতে কেনা বিভিন্ন সম্পত্তি দেখভালে থাকা গ্রেফতার ব্যক্তিদের জেরায় ও ইডির তদন্তে একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।

LEAVE A REPLY