সন্ধ্যা ৬টায় সংবাদ সম্মেলন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা ক্রমাগত পেছাতে থাকে। একটু পরপরই আইসিসির মিডিয়া ম্যানেজার মাইক্রোফোনে ঘোষণা দিয়ে যেতে থাকেন, ‘বাংলাদেশ দল রাস্তায় আছে। তাদের পৌঁছাতে আরেকটু দেরি হবে।’ এদিকে ডেডলাইন ঘনিয়ে আসতে থাকায় অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বিরক্তি যখন চরমে, তখনই এসে মহারাষ্ট্র ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (এমসিএ) স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলনকক্ষে ঢোকেন চন্দিকা হাতুরাসিংহে।
বিনীত ভঙ্গিতে জানালেন অনিচ্ছাকৃত বিলম্বের কারণও, ‘আজ আমাদের গাড়ি শুধু ফার্স্ট গিয়ারেই চলছিল!’
অফিস ছুটির সময়ে পুনে শহরের তীব্র যানজট ঠেলে অনেক দূরের স্টেডিয়ামে আসার পথে টিম বাস বিকলও হয় একবার। সব মিলিয়ে যাত্রাপথে ঢিমেতাল থাকলেও বাংলাদেশ দলের হেড কোচ জানেন, পরদিনই তাঁর দলের জন্য ‘গিয়ার’ বাড়ানো একরকম বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। জয় দিয়ে শুরু করলেও টানা দুই হারে বাংলাদেশ এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে আরেকটি হারে বিশ্বকাপে টিকে থাকার লড়াই কঠিন থেকে কঠিনতম হয়ে যেতে পারে। নিজেদের মাটিতে টানা তিন ম্যাচ জিতে উড়তে থাকা ভারত আজকের প্রতিপক্ষ বলে নিজেদের ফিরে পাওয়ার লড়াই হয়ে উঠেছে আরো কঠিন।
বিশ্ব ক্রিকেটে অবস্থান এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিতে দুই দলের ব্যবধান এত যে তাদের ম্যাচকে ঘিরে লড়াইয়ের আবহই তৈরি হওয়ার কথা নয়। রেকর্ড-পরিসংখ্যানও তা-ই তুলে ধরে। এখন পর্যন্ত ৪০ বারের দেখায় ভারতের জয় যেখানে ৩১ ম্যাচে, সেখানে বাংলাদেশের আটটি। বিশ্বকাপে চারবারের দেখায়ও ভারত এগিয়ে ৩-১ ব্যবধানে।
তবে এসব তথ্যের সাধ্য কী যে ভারত-বাংলাদেশ লড়াইয়ের গভীরতা বোঝায়। সেই ২০০৭ বিশ্বকাপে ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেনে প্রথমবারের দেখায় ভারতের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়া জয়ের এমন মহিমা যে এর পর থেকে এই দুই দলের দেখা হওয়াটা জমজমাট ম্যাচের সম্ভাবনাই জাগিয়েছে।
সময়ে একে একে ভারতের বিপক্ষে আরো সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। দ্বিপক্ষীয় সিরিজে ভারতকে হারিয়েছে, এশিয়া কাপের মতো বহুজাতিক আসরেও জিতেছে সম্প্রতি। ২০১৬-র টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জিততে জিততেও হেরে যাওয়ার বেদনায় নীল হয়েছে।
এর আগে ২০১৫-র ওয়ানডে বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালের আম্পায়ারিং বিতর্ক এই দুই দলের লড়াইয়ের আবেদন তুঙ্গে পৌঁছে দিয়েছে। তাদের লড়াইপূর্ব আবহ জমে যাওয়ার রসদের তাই অভাব নেই কোনো। তবে এবার এর সবই উধাও। ভারতের বিপক্ষে সর্বশেষ চার ওয়ানডেতে ৩-১ ব্যবধানে এগিয়ে থাকলেও আলোচনাটি এমন যে বাংলাদেশ আজ জিতলে সেটি অঘটনই হবে।
ভারতীয় দলের ফাস্ট বোলিং কোচ পরশ মামব্রের গতকাল দুপুরের সংবাদ সম্মেলনে তা নিয়ে প্রশ্নও হলো। ভারতীয় সাংবাদিকের প্রশ্নের আগে-পরের কথায় বোঝা গেল, এই আসরে তাঁদের গত দুই ম্যাচের পারফরম্যান্সের নিক্তিতেই এখন সাকিব আল হাসানদের মাপা চলছে। তাতে দারুণ ছন্দে থাকা ভারতের সঙ্গে পার্থক্যটি এমন বড় হয়ে উঠেছে যে বাংলাদেশ যেন এক নিমেষেই নেমে গেছে আফগানিস্তান ও নেদারল্যান্ডসের কাতারে। না হলে কেন সাকিবদের সম্ভাব্য জয়ে আগেই অঘটনের মোড়ক পরিয়ে দেওয়া হবে!
তবে এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত দুটো অঘটনের নায়কদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়ার আছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশ তা নিচ্ছেও। ভারতে আসার আগে টিম মিটিংয়ে নেদারল্যান্ডসের খেলোয়াড় বাস ডি লিড বলে এসেছিলেন, ‘চলো ভারত যাই এবং বিশ্বকে দেখিয়ে দিই যে আমরা ফেলে দেওয়ার মতো দল নই।’ সেটি তাঁরা দেখিয়েছেও। তবে আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপ সুপার লিগ নামের বাছাই পর্ব তিনে থেকে শেষ করা বাংলাদেশের নতুন করে সে রকম কিছু দেখানোর নেই। আছে যা, সেটি কেবলই এই আসরে নিজেদের সামর্থ্য ও সক্ষমতা মেলে ধরার। পারবেন সাকিবরা?
হাতুরাসিংহে অন্তত পারার আশাই দেখালেন। সেই আশার পালে হাওয়া দিচ্ছে এই বিশ্বকাপের আফগান ও ডাচ রূপকথাও, ‘আমরা সবাই এখন থেকে প্রতিটি ম্যাচই জেতার জন্য অনুপ্রাণিত। গত সপ্তাহজুড়ে কী ঘটেছে, তা তো আপনারা জানেনই। বিশ্বকাপটি সত্যিই উন্মুক্ত হয়ে গেছে। ওদের (আফগানিস্তান ও নেদারল্যান্ডস) কাছ থেকে আমরাও অনুপ্রেরণা নিচ্ছি। এখনো আমাদের ছয়টি ম্যাচ বাকি। আমরা বিশ্বাস করি, এখান থেকে বাকি সব কয়টি ম্যাচই আমাদের পক্ষে জেতা সম্ভব। কালকের ম্যাচের জন্য এটিই আমাদের অনুপ্রেরণা।’
অবশ্য এই ম্যাচে সাকিব খেলবেনই, সংবাদ সম্মেলন থেকে সে নিশ্চয়তা দিয়ে বের হলেন না হাতুরাসিংহে। গতকাল বাংলাদেশ অধিনায়ক কেবল নিজের বাঁ ঊরুর এমআরআই স্ক্যান করানোর জন্য হোটেল থেকে বেরিয়েছিলেন। সন্ধ্যার অনুশীলনেও আসেননি। আজ সকালে তাঁর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার কথাও বলে গেলেন হেড কোচ। অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে নিয়ে প্রতিপক্ষকে অন্ধকারে রাখার রেওয়াজও ক্রিকেটে বহু পুরনো। হাতুরাসিংহেও সেই পথ অবলম্বন করলেন কি না, কে জানে। কারণ আগের দিন একই মাঠের অনুশীলনে লম্বা সময় ব্যাটিং করা সাকিবকে অস্বস্তিতে ভুগতে দেখা যায়নি। হেড কোচ যদিও বললেন যে, ‘আমরা এখনো ওকে বোলিংটা করাইনি।’ চেন্নাইতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাটিংয়ের সময় চোট পাওয়া সাকিব কিন্তু পরে পুরো ১০ ওভারই বোলিং করেছিলেন!
আর হাতুরাসিংহে আজ যে ‘কমপ্লিট পারফরম্যান্স’ চাইছেন, সে জন্য নিজে খেলতে চাওয়া অধিনায়ককে বাইরে রেখে নামার অসম্পূর্ণতার সম্ভাবনাও সামান্যই। ‘গিয়ার’ বাড়াতেও তো এই অলরাউন্ডারকে চাই-ই চাই!